শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

নাগরিক মতামত

জীবিকার তরে ধুঁকছে ওরা

আপডেট : ১০ জুলাই ২০২০, ১১:০৮

কেউ কি জানতো, পৃথিবীটা একদিন এভাবে থমকে যাবে বিনা নোটিশে? নিরুপায় হয়ে পড়বে জাগতিক সব মানুষ ? জানতো না।  জানলে হয়তো, ঝড়ের পূর্বাভাস পেয়ে প্রশাসন যেমন বিপদগ্রস্ত মানুষকে নিরাপদ আশ্রয়ে সরিয়ে নেয়, নিশ্চয়ই তেমন কোনো  পূর্ব প্রস্তুতি নিতো?

সেই ছেলেবেলা থেকে জেনে এসেছি, বাংলাদেশ নদীমাতৃক দেশ। তবে এখন আর নদী কোথায়? চারদিকে বড় বড় দালানকোঠা। তবুও ঝড়, বন্যা, খরা, জলোচ্ছ্বাস  এদেশের অন্যতম এসব প্রাকৃতিক বিপর্যয় থেকে পরিত্রাণ নেই।  সরকার  প্রতি বছর তার সামর্থ্য অনুযায়ী এসব দুর্যোগ মোকাবেলার চেষ্টা করে। কৃষক থেকে শুরু করে সচেতন করে  তোলে মজুদদারদের, যেন খাবারের অভাব না হয়। দুর্ভিক্ষ নেমে না আসে। সর্বপরি বিপদ মোকাবেলায় সারা বছর সরকার থাকে সচেষ্ট।

কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো,প্রাকৃতিক  বিপর্যয় হিসেবে দেখা দেয়া  কোভিড-১৯  কেবল বাংলাদেশেই  নয় বিশ্বজুড়ে আজ দীর্ঘমেয়াদী এক  মহামারিতে রূপ নিয়েছে। প্রায় নিঃশব্দে ছড়িয়ে পড়া এই অদৃশ্য শত্রু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী সবচেয়ে  বড় সংকট হয়ে দেখা দিয়েছে।  যার জন্য পূর্ব প্রস্তুতি বাংলাদেশ কেন বিশ্বের  মহারাষ্ট্রগুলোও নিতে পারেনি।

তবে হ্যাঁ, আমরা  হয়তো কিছুটা সুযোগ পেয়েছিলাম! প্রকৃতিতে শীত বা বসন্ত যেমন খানিকটা জানান দিয়ে আসে তেমনি নতুন নভেল করোনা ভাইরাস জনিত প্রাণঘাতী এ রোগও ( কোভিড-১৯) জানান দিয়েছিলো হেমন্তের পড়ন্ত বিকেলে। গায়ে কাঁটা দেয়া সে অনুভূতির  বাংলাদেশে প্রথম প্রকাশ ৮ মার্চ ২০২০।

ঠিক তার আগের দিন ৭ মার্চ বাংলাদেশের প্রথিতযশা ও ক্ষমতাধর  নারীদের সাথে আমি একটা সম্মেলনে অংশ নিয়েছিলাম বিশ্ব নারী দিবস উপলক্ষে। সেদিন সেখানে উপস্থিত প্রায় সবাই তাদের মূল্যবান বক্তব্যের পাশাপাশি কথা বলেছিলেন সদ্য আগত এই ভাইরাস নিয়ে। তবে সেদিনের আলোচনায় নারীর গুরুত্ব ছাপিয়ে যেতে পারেনি কোভিড-১৯ এর আগমনী বার্তা।

তবে টেলিভিশনের পর্দায় আমরা রোজ দেখতাম ট্রাক ভর্তি অসংখ্য লাশ সৎকার করা  হচ্ছে ইউরোপ আমেরিকার দেশগুলোতে।দেখেছিলাম, কানাডায় প্রথম কোনো করোনা আক্রান্ত  বাঙালি তরুণীর মৃতদেহ ক্রেনের সাহায্যে নামানো হচ্ছে কফিন সহ কবরে। রোজ স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক শোনাতেন, দেশব্যাপী  আক্রান্তের তালিকা। মন্ত্রী এমপিরা বলতেন, ভয় নেই করোনা আসবে না আমাদের দেশে। আমরা সম্ভবত করোনার চেয়েও শক্তিশালী। কাজেই আপনারা একটু সাবধানে থাকুন, সুরক্ষিত থাকুন। আমরা করোনা মোকাবেলা করতে সক্ষম।

তাই আমরা মনে প্রাণে বিশ্বাস করতে লাগলাম, আমরা বীরের জাতি মুক্তিযুদ্ধ করে জয়লাভ করা জাতি। হাঁটে মাঠে ঘাটে দুরন্ত কৈশোর দাপিয়ে বেড়ানো বলিষ্ঠ বাঙালি জাতি। কাজেই করোনা কে তুচ্ছ জ্ঞান করি। এজন্য নুন্যতম প্রস্তুতি নেবার প্রয়োজন আমরা বোধ করিনি। আমাদের প্রথম দিকে না ছিলো পর্যাপ্ত চিকিৎসক, না ছিলো পিপিই, না ছিলো আইসোলেটেড প্লেস, না ছিলো টেস্ট কীট, আইসিইইউ ইত্যাদি ।  ছিলো শুধু  গাল ভরা বুলি আর বুক ভরা সাহস। ছিলো কি এখনো আছে!

যে দেশে ঋণখেলাপীর সংখ্যা ২ লাখ ৬৬ হাজার ১১৮ জন ( ২০১৮ সালের ডিসেম্বরের পরিসংখ্যান মতে)এবং কোটি পতির সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৮৪ হাজারে (২০১৯ সালের ডিসেম্বরের পরিসংখ্যান অনুযায়ী), এতদিন ধনী বলে জেনে আসা এই 'তথাকথিতদের' অভাব দেখছি দেশের প্রায় ৩ কোটি দরিদ্র মানুষের চেয়েও বেশি। এরা শুধু বলে নাই আর নাই! তাই তারা কেবল চায় আর চায়!

খুব জানতে ইচ্ছে করে, তথাকথিত এই ধনীরা দেশের গাড়ি -বাড়ি- বাগান -খামার গড়ে আর দেশ-বিদেশের ব্যাংকে জমানো টাকার পাহাড় দিয়ে সারাজীবন ধরে যে এত বিপুল পরিমাণ অর্থ- সম্পদ অর্জন করলেন, এসব কি শুধু বুদ্ধি আর লগ্নি দিয়েই অর্জিত হয়েছে, পরিশ্রম লাগেনি শ্রমিকের? তাহলে প্রশ্ন করা যেতেই পারে, যাদের শ্রমের টাকায় ঘামের টাকায় এত ধনী বনেছেন আপনারা, সেই সব সম্বলহীন মানুষের পাশে বিপদের সময় না দাঁড়িয়ে অসময়ে তাদের চাকরিচ্যুত করছেন কেন? প্রকৃতপক্ষে, আমাদের বিবেক নিষ্পেষিত লোভের মোহে। সত্যিই ভাবতে অবাক লাগে, ওপরে উঠতে গেলে বুঝি এমন অমানবিক হওয়া ছাড়া আর কোনো গত্যন্তর থাকেনা।

বৈশ্বিক মহামারি করোনায় সবচেয়ে বেশি বিপদগ্রস্ত যাদের কথা বলবো বলে আমার আজকের লেখা, এবার সেই সব খেটে খাওয়া মানুষদের  বাস্তব জীবনের  গল্প বলি, শুনুন।

দেশে ৩ কোটি ৪০ লাখ দরিদ্র মানুষ আছে। এদের মধ্যে পৌনে দুই  কোটি মানুষ হত-দরিদ্র (বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর হিসাব মতে)।রাজধানীর দুই সিটি কর্পোরেশন উত্তর -দক্ষিণের বস্তিতে বসবাসকারী মানুষের সংখ্যা সাড়ে ৬ লাখ(বিবিএস পরিচালিত ২০১৪ সালের জরিপ মতে)।এর মধ্যে ভাসমান শ্রমিকের সংখ্যা প্রায় দেড় লাখ। রিকশাচালক ও গণপরিবহনের সঙ্গে যুক্ত রয়েছে আরও ৬ লাখ মানুষ। আর ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীর সংখ্যা দেড় লাখ।এছাড়া এর বাইরে আরও বিভিন্ন পেশার স্বল্প আয়ের মানুষ আছে প্রায় ১৬ লাখ।

দেশ অর্থনৈতিকভাবে এখনো তেমন স্বাবলম্বী না হওয়ায় করোনাকালীন এই সংকটে দরিদ্র এই মানুষগুলোকে লম্বা সময় ধরে ভরণপোষণের সামর্থ্য আমাদের নেই। বিধ্বংসী এই মহামারির ছোবলে আয় -রোজগার বন্ধ হয়ে যাওয়ায় হত-দরিদ্র, ছিন্নমূল, দিনমজুর ও নিম্ন আয়ের ব্যবসায়ীরাসহ অসহায় এই মানুষগুলো এখন মানবেতর জীবনযাপন করছে।

ঢাকা শহরের প্রাণকেন্দ্র শাহবাগ,টিএসসি, চারুকলা ইনস্টিটিউট। পথের ধারেই চলে এই ছিন্নমূল মানুষগুলোর অস্থায়ী ব্যবসা-বাণিজ্য। বিষণ্ণ দিনে অথবা অবসরে, প্রায়ই আমি রাস্তাঘাটে একা হাঁটি। জীবনকে ওদের সাথে মিলিয়ে দেখি। কার দুঃখ বেশি আমার না ওদের? হতাশা বা বিষণ্ণতা মরে যাবার মতো কার বেশি।  আমার না ওদের? বাস্তবতা কাকে বেশি কষ্ট দেয়।আমাকে না ওদেরকে?

তারপর ঘরে ফিরতে ফিরতে মনে মনে একটা  পক্ষ বিপক্ষ ছক তৈরি করি। হাকিম চত্বর এসে গরম গরম ডিম চপ আর কড়া দুধ চা বন্ধুদের সাথে শেয়ার করে খেতে খেতে মনে হয় আরে আমি তো প্রিন্সেস! কি দারুণ একটা জীবন নিজের মতো উপভোগ করছি । কোনো দ্বায় নেই, নেই কোনো পিছুটান। মিথ্যে বিষণ্ণতা  অকারণ  হতাশা আর দুঃখ বিলাস ঢেকে যায় কিছুক্ষণ কথা বলে আসা রোজকার খেটে খাওয়া মানুষগুলোর জীবন যুদ্ধের কাছে।

দীর্ঘদিন শাহবাগে মেট্রোরেলের কাজ চলছে। যাতায়াতের অসুবিধার পাশাপাশি জীবন চলার জন্য যারা এখানে রোজ সাজিয়ে বসেন জীবিকার সামগ্রী, কথা হলো তাদের সাথে।
জানতে চাইলাম কেমন আছেন ?  কেমন চলছে  ব্যবসা? খুব হতাশা আর দুঃখ নিয়ে তারা প্রত্যেকেই  বললো,কি হবে আমাদের কথা জেনে? আমাদের কথা তো আপনাদের মতো অনেকেই এসে শুনে যায়। তারপর কাগজে লেখে কিন্তু আমাদের জীবন তো আর বদলায় না।

আমি চুপ করে থেকে বললাম, হয়তো বদলাতে পারবো না। তবুও চেষ্টাটুকু তো  করতে পারবো। সেই সুযোগটা দিলে একটু কথা বলতাম। সম্মতি মিললো অবশেষে ।
কথা শুরুর আগেই বেশ কিছু ছেলেমেয়ে  তাদের দোকানের সরঞ্জাম দেখতে লাগলো। সেই ফাঁকে আমি  কিছু ছবি তুলে নিলাম।

মামা,  কত বছর হলো এই ব্যবসা?
তাও ধরেন ১৪/১৫ বছর তো হবেই।
কেমন আয় হয়, সংসার চলে?
আগে ভালোই হতো কিন্তু এই মেট্রোরেলের  কাজ শুরু হওয়ার পর থেকে আয় রোজগার খুবই কম।আগের মতো আর কাস্টমার আসে না।তাছাড়া পুলিশ ও খুব বিরক্ত  করে।
কি রকম বিরক্ত?  টাকা পয়সা চায়?
না টাকা চায়না তবে বসতে দিতে চায় না। তারপর ধরেন ঝড় বৃষ্টি এসব তো আছেই।
কাউকে উদ্দেশ্য করে কিছু বলতে চান?
কারে বলবো কন?  কে শুনবে আমাদের কথা। গরীবের জীবনটাই তো দুঃখ দিয়ে গড়া তার জন্য আবার আলাদা করে কি বলবো?  কিছুই বলতে চাই না। ওপরওয়ালা যেমন চালাচ্ছে তেমন চলছি। আপনাগো এসব লেখালেখিতে আমাগো কিছুই হইবো না।

বুঝতে পারলাম খুব অভিমান জমে আছে ওঁদের বুকের ভেতর।তাই আর কথা বাড়ালাম না। আস্তে করে চলে এলাম দেয়ালের গায়ে দোকান সাজাতে ব্যস্ত আরেকজনের  কাছে।

কেমন আছেন?  একটু কথা কথা বলতে পারি?
জি মামা অবশ্যই কথা বলতে পারেন। আছি- ভালোই আছি।
কেমন চলছে আপনার বেচাকেনা? কারা নেয় এসব?
চলছে কোনোরকম। তবে আগে ভালো হতো। এইযে রেলের কাজ হওয়াতে একদম বেচাকেনা নাই। আগে কত আপারা আসতো। যারা পাশ করে চলে গেছে তারাও আসতো।
যে টাকা আয় হয় তা দিয়ে সংসার চলে?
আগে হতো ধরেন ২ থেকে ৩ হাজার টাকা রোজ। কিন্তু এখন সারাদিনে ৫০০ টাকা হওয়াই কঠিন।তাছাড়া প্রশাসনও জ্বালাতন করে।  কোনোরকমে দিন পার হয় আর কি!
এখানকার ছাত্রছাত্রী বা শিক্ষকরা কিছু বলেননি?
হ্যাঁ উনারা বলেছেন কিন্তু সরকার যদি একবার একটা সিদ্ধান্ত নেয় আপা,  সেইডা কি আর কেউ বদলাইতে পারে কন?
এবারের ফাল্গুনে তো তেমন বেচাকেনা করতে পারেননি করোনার জন্য , সামনে বৈশাখ প্রস্তুতি কেমন?
জি মামা, খুব খারাপ অবস্থা গেছে। দেখি বৈশাখে কি হয়। যা সব রোগ বালাই দেশে আসতেছে।বৈশাখের মালা দুল অবশ্য বানানো শুরু করে দিছি।
মামার সাথে কথা বলার ফাঁকে পাথর কেটে বানানো একটা  মূর্তির মালা আমার  খুব পছন্দ হলো। নিয়ে গলায় পড়ে ফেললাম। তারপর আবার কথা শুরু করলাম।
আচ্ছা মামা, ক'দিন আগেই তো বই মেলা শেষ হলো। নিশ্চয়ই  তখন খুব ভালো বিক্রি হয়েছে?
না মামা, আমদের তো মেলার সময় এখানে বসা বারণ।বইমেলা, ফাল্গুন, বৈশাখ কোনো অনুষ্ঠানেই বসতে দেয়না। তাছাড়া আগে এখানে ছবির হাঁটে কত রকম মানুষ আসতো। এখন তো ছবির হাঁটও বন্ধ।
ছবির হাঁট বন্ধ কেন মামা ?
কারণ তো খুব ভালো জানিনা । তবে যে বছর মেলায় আমাদের  অভিজিৎ স্যার কে হত্যা করলো সেই বছর থেকে  বন্ধ। এখন একমাস ব্যাপী বই মেলায়ও আমাদের ঢুকতে দেয়না।
তখন কোথায় বসেন?
তেমন কোথাও বসি না। ফেরি করে বেচি।
তখন  শিক্ষকরা কি বলেন  ?
স্যারেরা বলেন তোমরা ক্যাম্পাসের ভেতর এসে বসো। কিন্তু আমরাই যাইনা। কি দরকার  অযথা উনাদের বিরক্ত করার।
এত কষ্ট তবু এ কাজ ছেড়ে দেন না কেন?
মায়া মামা মায়া। মায়া আর ভালোবাসা দিয়েই তো আপনাদের মতো মানুষদের জন্য এই গহনা বানাই।তাছাড়া ছোট বেলা থেকে আমার বাবাকেও এই কাজ করতে দেখেই বড় হইছি। আর তো কোনো কাজ শিখি নাই। আমার বাবা মমিনুল মৃধা কে এই ক্যাম্পাসের সবাই চেনে।  জয়নুল স্যারের সাথে আমার বাবা কাজ করতেন। কত আন্দোলন দেখেছে বাবা।এমনকি মাইরও খাইছে। কত লোকে কত আজেবাজে কথা কইছে। বলতো নাস্তিক গো লগে থাকো মাটির মূর্তি বানাও। তাও বাবা ভালোবাসার টানে এই কাজ ছাড়ে নাই। আমারও বাবার মতো সেই  ভালোবাসায় পাইছে। যারা পাশ করে চলে গেছে তারাও আসে খোঁজ খবর নেয়।এটাই তো বড় প্রাপ্তি মামা।
নিজেদের এই করুন অবস্থা সম্পর্কে কারও উদ্দেশ্যে কিছু বলবেন?
জানি বলে লাভ নাই। তবুও যদি পারেন তো লিখেন। সরকার যদি আমাদের জন্য একটা স্থায়ী  দোকানের ব্যবস্থা করতো তাহলে আমরা একদিকে যেমন এই শিল্প টাকে বাঁচিয়ে রাখতে পারতাম তেমনি পরিবার টাকেও ভালো রাখতে পারতাম।

মামার কাছ থেকে নেয়া মালার দামটা মিটিয়ে হাঁটতে শুরু করলাম টিএসসির দিকে।  চোখ আটকে গেলো রঙ -বেরঙ এর সাজানো চুড়িতে । কাছে যেতেই জিজ্ঞেস করলো, খালা কোনটা দিমু কন?
বললাম, খালা ঐ যে কাঁচা হলুদ আর সাদা ঐ রঙেরটা দিন। চুড়ি কিনতে কিনতে গল্প হলো।
খালা আপনারা কি স্বামী স্ত্রী ?
জি খালা উনি আমার বাড়িওয়ালা।
কোথায় থাকেন?
চরে থাকি গো খালা কামরাঙ্গির চরে।
ওহ!
কত বছরের ব্যবসা?
তাও তো মেলা বছর।
তা মামা কেমন চলছে আজকাল চুরির ব্যবসা?
আগের মতো আর ব্যবসা নাই গো খালাম্মা।
আগে ইউনিভার্সিটির মেয়েরা ছাড়াও কত্ত মাইয়ারা  রোজ আসতো বেড়াইতে। এই যে ব্রিজ টা হইতাছে ( মেট্রোরেল)  এইডার লাইগা এহন আর তেমন কেউ আহেনা। এহন তো পেট চালানোই দ্বায়।তারপর এবারের ফাল্গুনে তো কিছুই বেচতে পারলাম না করোনা না কি জানি রোগের লাইগা।
আপনারা কি চান না দেশের উন্নতি হোক? যানজট কমে যাক?
অবশ্যই চাই খালা কিন্তু আমাগো গরীবগো একটা ব্যবস্থা করলে খুব ভালো হইতো। খালাম্মা আপনে কি কাগজের লোক?
না আমি আপনাদের লোক। পথে পথে হাঁটি আর মানুষের গল্প শুনি। চুড়ির দাম টা মিটিয়ে আবার হাঁটতে শুরু করলাম।

কয়েক পা এগোতেই চোখে পড়লো মাথার ক্লিপের  পসরা সাজিয়ে রাখা এক অল্প বয়সী ছেলেকে।কথা না বলে ক্লিপ দেখতে লাগলাম। নিলামও একটা। কৌতুহল বশত জানতে চাইলাম, বেচা বিক্রি ভালো?
না আপা।একদম ভালো না। আগে ইডেন কলেজের সামনে বসতাম। সেখানে তো আর বসতে দেয় না তাই এখানে আসি।লোকজন কম তাই এখানেও তেমন কিছু বিক্রি করতে পারি না। সংসার তো আর সে কথা বোঝে না, তাই আসতে হয়।

"সংসার তো আর  সে কথা বোঝেনা " কথাটা মাথার ভেতর ঝনঝন করে লাগলো। কোনো কথা না বাড়িয়ে হাঁটতে লাগলাম। একপা দু'পা করে সোজা রোকেয়া হলের সামনে এসে রিকশা নিলাম। পেছনে ফেলে আসলাম কিছু দরিদ্র অসহায় খেটে খাওয়া মানুষের ম্লান মুখের ছবি।

আজ প্রায় চার মাস দেশ করোনা ঝুঁকিতে আবদ্ধ। বেশ কয়েকদিন ধরে শাহবাগের ঐ ফুটপাতে  রোজ বসা মানুষগুলির কথা মনে পড়ছে। মনে হচ্ছে বৌ ছেলেমেয়ে নিয়ে কিভাবে কাটছে ওদের দিন?  যেখানে মেট্রোরেলের জন্য কমে গিয়েছিল ওদের দৈনন্দিন জীবনের আয় রোজগার সেখানে এতগুলো দিন পুঁজি বিহীন ব্যাংকব্যালান্সহীন দুঃখী মানুষগুলো শুধুই কি সরকারের দেওয়া কিছু ত্রাণের ওপর নির্ভর করে দিন গুজরাচ্ছে নাকি অনাহারে অর্ধাহারে করছে দিনাতিপাত?শহরের মধ্যবিত্ত মানুষগুলোই যেখানে আজ উদ্বাস্তু হয়ে ফিরছে শেকড়ের কাছে সেখানে এইসব দিন এনে দিন খাওয়া মানুষগুলো কোথায় যাবে কার কাছে দাঁড়াবে তা ভাবতে গেলে নিজের হতাশা বিষণ্ণতা নিমিষেই কর্পূরের মতো উড়ে যাচ্ছে,  মিলিয়ে যাচ্ছে ধুলোয়।

বিল গেটস একটা কথা বলেন, "আপনি যদি গরীব হয়ে জন্ম নেন তাহলে এটা  আপনার দোষ নয়, কিন্তু যদি গরীব হয়ে মারা যান তবে সেটা আপনার দোষ "।
ঐ লোকগুলো যদি না খেয়ে গরীব অবস্থাতেই  মারা যায় তবে কি সত্যি সেটা ওদের দোষ হবে?

নাকি কোলরিজ এর ভাষায় , "একজন দরিদ্র লোকও ভালো থাকার জন্যে প্রার্থনা করতে পারে "।

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন