শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

নিউ নরমাল ও উচ্চশিক্ষায় টেলিভিশন

আপডেট : ১৬ জুলাই ২০২০, ১১:১৩

কোভিড-১৯ মহামারি বিশ্বপরিস্থিতিকে যে এভাবে দুমড়েমুচড়ে ওলটপালট করে ফেলবে সত্যিই তা কেউ ভাবতে পারেনি। এইতো গত ফেব্রুয়ারিতেই কি কেউ ভেবেছিল যে, সাদা-রঙা (White-color) কর্মচারীরা সম্পূর্ণ ঘরে বসেই অফিস চালাবে কিংবা অযুত-নিযুত শিক্ষার্থী ইচ্ছায় হোক আর অনিচ্ছায় হোক, ভার্চুয়াল ক্লাসরুমে বসে পড়া সারবে? জীবন ও জীবিকার প্রয়োজনেই মানুষকে ঘরের বাইরে যেতে হচ্ছে। কারণ কেউই জানে না—মানবজাতির এই অদৃশ্য শত্রু কবে ক্ষান্ত দেবে। কবে মানুষ আবার আগেকার জীবনে ফিরে আসবে। শহর-বন্দর কোলাহলমুখর হবে। মানুষ পরম নিশ্চিন্তে করমর্দন করবে। উষ্ণ আলিঙ্গন করবে। মাস্ক খুলে বুক ভরে শ্বাস নেবে। তবে করোনাভীতি যাক বা না যাক—মানুষকে কিন্তু ফিরে যেতেই হবে স্বাভাবিক (Normal) জীবনে—তা সে সত্যিকার স্বাভাবিকই হোক আর ছদ্ম স্বাভাবিক হোক। হাতে দস্তানা, মুখে মাস্ক পরেই ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে কর্মক্ষেত্রে। এই অনিবার্য প্রত্যাবর্তন যেহেতু স্বাভাবিক নয়, তাই একে তত্ত্ব করে ‘নব্য স্বাভাবিক’, ইংরেজিতে নিউ নরমাল বলা হচ্ছে।

শিক্ষাক্ষেত্রে নিউ নরমাল পরিস্থিতির মোকাবিলার জন্য রকমারি ভার্চুয়াল/রিমোট/পরোক্ষ পদ্ধতির সুপারিশ নিয়ে এসেছেন বিশেষজ্ঞরা। অনলাইন ক্লাসের সাড়া পড়েছে দিকে দিকে; কিন্তু বাংলাদেশের মতো দেশের জন্য যেখানে এখনো আমরা ১৫৬ হাজার বর্গমাইলকে পুরোপুরি ফ্রি ইন্টারনেট সেবার আওতায় আনতে পারি নাই, আবার নিম্নবিত্ত কিংবা নিম্নমধ্যবিত্তদের অনেকে যেখানে এই সেবার ক্রয়ক্ষমতা অর্জন করে উঠতে পারেনি বলে জানাচ্ছেন সেখানে অনলাইন শিক্ষার ইতিমধ্যে গৃহীত উদ্যোগটির সফল বাস্তবায়ন সংশয়ের মুখে পড়েছে। এদিকে সবাইকে সংশ্লিষ্ট না করে তত্পরতা চালিয়ে যাওয়াও এসডিজি-৪ অভিলক্ষ্যের বরখেলাপ হবে। তবে এই অনলাইন শিক্ষাক্রম কোভিড-১৯-এর ঘোর সংকটের কালে—নাই মামার চেয়ে যে কানা মামার ভূমিকায় অতি সফলতার সঙ্গে অবতীর্ণ হতে পারে সে কথা অস্বীকার করায় জো আর এখন নেই। তবে একদিকে দূরবর্তী শিক্ষাকার্যক্রম চালিয়ে যাওয়া এবং অন্যদিকে মধ্য ও নিম্ন আয়ের জনগণ সবাইকে সম্পৃক্ত করা—এ দুয়ের সুসমন্বয় ঘটাতে চাইলে মনে হয় শিক্ষা টেলিভিশনের ধারণা বাস্তবায়নের কোনো বিকল্প নেই।

নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশগুলোতে ১৯৫০-এর দশক থেকেই কমবেশি টেলিভিশনের মাধ্যমে শিক্ষার প্রযুক্তি ব্যবহূত হয়ে আসছে। সম্প্রতি এটি আরো বেশি মিথস্ক্রিয়ামূলক হয়ে উঠেছে। বস্তুত, এডুকেশন প্রযুক্তি বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে আইটি টুলসের বহুমাত্রিক ব্যবহারের মাধ্যমে অনলাইন ক্লাসরুমকে অধিকতর আকর্ষণীয় অংশগ্রহণমূলক এবং প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাপোযোগী করে তোলার চেষ্টা করা হচ্ছে। বর্তমানে সবার মধ্যে এ বিশ্বাস স্থির হয়েছে যে সময়োপযোগী শিক্ষাপদ্ধতি বেছে নিতে শিক্ষাপ্রযুক্তি (Edtech)-এর বহুমাত্রিক ব্যবহার নিশ্চিত করা ছাড়া গত্যন্তর নেই। কিন্তু বাংলাদেশের মতো এশিয়া-আফ্রিকা এবং লাতিন আমেরিকার উন্নয়নশীল দেশগুলোয় যেখানে সব মানুষের পর্যাপ্ত আর্থিক সামর্থ্য পুরোপুরি বিকশিত হতে পারেনি এবং সে কারণে প্রজন্ম জেড (Generation Z) যারা ১৯৯০ থেকে ২০১০-এর মধ্যে জন্মেছে এবং ছেলেবেলা থেকেই ডিজিটাল প্রযুক্তি ব্যবহার করছে; কিংবা প্রজন্ম আলফা (Generation Alpha) যারা ২০১০ থেকে ২০২০-এর মাঝামাঝি সময়ে জন্মেছে এবং ডিজিটাল প্রযুক্তির চামচ মুখে নিয়ে জন্মেছে—তারা ইউরোপ-আমেরিকার উন্নত দেশগুলোতে জন্মানো জেড কিংবা আলফা প্রজন্মের মতো সমভাবে বিকশিত হতে পারেনি। হলে তারাও এডটেকের এই চরম উত্কর্ষের যুদ্ধে ভারী ডেস্কটপ কম্পিউটার ছেড়ে ট্যাবলেট আর স্মার্টফোনের মাধ্যমে খেলাচ্ছলে মিথষ্ক্রীয় অনলাইন শিক্ষা কার্যক্রম চালিয়ে যেতে পারত। সেই সুবর্ণ সময় না আসা পর্যন্ত শিক্ষা টিভি ব্যবস্থার ওপর নির্ভর করাটাই মনে হয় অধিকতর যুক্তিযুক্ত। টেলিভিশন একটি শক্তিশালী অডিও ভিজুয়াল যন্ত্র, যাকে অত্যন্ত কার্যকরভাবে শিক্ষার কাজে ব্যবহার করা যেতে পারে। টেলিভিশনসংক্রান্ত সাম্প্রতিক আবিষ্কারসমূহ যে স্মার্টবোর্ড প্রযুক্তির জন্ম দিয়েছে তা শিক্ষকেরা খুব সহজেই শিক্ষাদানের কাজে ব্যবহার করতে পারে। গবেষকরা বলছেন, অডিও ভিজুয়াল এই মাধ্যমটির মাধ্যমে শিক্ষা প্রদান ইন্দ্রিয় উদ্দীপনা তত্ত্বানুসারে অধিকতর কার্যকর প্রভাব বিস্তার করতে পারে। বস্তুত, মুখোমুখি শিক্ষায় আরো কার্যকরভাবে এই কাজটিই হয়ে থাকে। শিক্ষার্থীদের জন্য প্রত্যক্ষ উদ্দীপক হিসেবে কাজ করে দৃশ্যমান শিক্ষকের পাঠদান। সেদিক থেকে শ্রেণিকক্ষে পাঠদানের একটি অধিকতর গ্রহণযোগ্য বিকল্প হিসেবে টেলিভিশন শিক্ষাই সর্বাধিক গ্রাহ্য। আর শুধু শিক্ষাদানই কেন, একজন শিক্ষার্থীকে সময়োপযোগী সমাজসচেতন পরিবেশ সচেতন হিসেবে গড়ে তুলতে কিংবা তার মধ্যে সফট স্কিলস ডেভেলপমেন্টের জন্যও এই শিক্ষার বিকল্প নেই। কিন্তু প্রশ্ন হলো, কী হবে সেই উচ্চশিক্ষা টেলিভিশনের স্বরূপ? এটি কি কেন্দ্রীয়ভাবে নিয়ন্ত্রিত একটি টিভি হবে—যেমন :বিটিভির একটি চ্যানেলে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষার্থীদের করোনাকালে ক্লাস নেওয়া হচ্ছে। বিষয়টি স্কুল-কলেজের জন্য যতটা সহজ সাধ্য, বিশ্ববিদ্যালয়সমূহের জন্য কি ততটা সহজ হবে। টেলিভিশনের মাধ্যমে উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের দূরশিক্ষণ কার্যক্রম যেভাবে চালানো হয় অন্যান্য সাধারণ বিজ্ঞান-প্রযুক্তি কিংবা ইঞ্জিনিয়ারিং বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য কি সেভাবে করা যাবে?

মোদ্দা কথা হলো, কোভিড-কবলিত শিক্ষাঙ্গনে নিউ নরমাল পরিস্থিতির মোকাবিলায় এডটেকের সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। শিক্ষাপ্রযুক্তির এক চমত্কার রূপায়ণ হলো অডিও ভিজুয়াল টিভিমাধ্যম। সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞদের দিয়ে কনটেন্ট প্রস্তুত করে আপাতত ইউজিসি নিয়ন্ত্রিত একটি শক্তিশালী টিভি কিংবা একাধিক টিভি চ্যানেলের মাধ্যমে পরিবেশন করা গেলে বর্তমান পরিস্থিতিতে একটি বাড়তি সুবিধার দিক খুলত। পরবর্তী সময়ে পোস্ট কোডিভকালেও তা কাজে লাগানো যেত এবং পর্যায়ক্রমে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো নিজস্ব চ্যানেল প্রতিষ্ঠা করতে পারত।

তথ্য, ধারণা, দক্ষতা ও দৃষ্টিভঙ্গি পরিবেশনায় টেলিভিশনের গুরুত্ব গবেষণালব্ধ। বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন শিক্ষা টিভিতে প্রকাশিত বিভিন্ন প্রতিবেদন লক্ষ করলেই শিক্ষা টিভির গুরুত্ব আঁচ করা যায়। বিবিসির পরিচালকের ভাষ্যমতে, ‘গৃহ ও পাঠশালার পর আমি মনে করি, মানবজাতির ওপর গভীর প্রভাব সৃষ্টি করতে অন্যান্য যোগাযোগমাধ্যমের তুলনায় টেলিভিশনের ভূমিকা সর্বাধিক।’ আনুষ্ঠানিক-অনানুষ্ঠানিক সব ধরনের শিক্ষা প্রদানে গণমাধ্যম হিসেবে টেলিভিশনের ভূমিকা অগ্রগণ্য। ইলেকট্রনিক এই মাধ্যমটিকে শিক্ষাপদ্ধতি এবং কোর্স কারিকুলামের চাহিদা অনুযায়ী বিভিন্ন উদ্দেশ্য এবং উপায়ে ব্যবহার করা যেতে পারে। পাঠ্যবস্তুর ব্যবহারিক প্রয়োগ এবং ল্যাবরেটরি পরীক্ষানিরীক্ষা প্রদর্শন করা যেতে পারে। দূরশিক্ষণের মানবিকীকরণ, বাস্তবধর্মী জীবনঘনিষ্ঠ দৃষ্টান্ত প্রদর্শন, কেসস্টাডি প্রভৃতির মাধ্যমে টেলিভিশন আউটকাম বেজড এডুকেশনের উত্স হিসেবে বাস্তব ক্লাসরুম প্রশিক্ষণের যোগ্যতর বিকল্প হতে পারে। তাছাড়া সামাজিক বিজ্ঞান ও ভাষা শিক্ষায় জীবনঘনিষ্ঠ পরিস্থিতি প্রদর্শনের সুযোগ থাকে এই দূরশিক্ষণ মাধ্যমে। নিউ নরমাল পরিস্থিতিতে বিকল্প ধারার শিক্ষারীতি হিসেবে অনলাইন শিক্ষাপদ্ধতির চেয়ে অনেক সময় বেশি কার্যকর হলেও টেলিভিশন শিক্ষাও কোনো অবিমিশ্র পদ্ধতি নয়। এক্ষেত্রেও ডিজিটাল ডিভাইডের সম্ভাবনা থেকেই যাচ্ছে। বাসায় ইন্টারনেট কিংবা স্যাটেলাইট কানেকশন না থাকলে দূরশিক্ষণের এই সুবিধা কাছে আনা যাবে না। শিক্ষার্থীদের জন্য অনলাইন পদ্ধতির চাইতে এই দূরশিক্ষা পদ্ধতিতে প্রতারণার সুযোগ বেশি থাকে। যা-ই হোক, টেলিভিশন শিক্ষা অনলাইন শিক্ষার চেয়ে ভালো না মন্দ—তা বিচারের দায়িত্ব এ লেখার প্রতিপাদ্য নয়। কোভিড পরিস্থিতির শিকার শিক্ষার্থীদের জন্য আপত্কালীন বিকল্প হিসেবে দুটোরই দরকার আছে। তবে স্কুলশিক্ষক আর অস্থিরমতি তরুণ শিক্ষার্থীদের জন্য অনলাইন শিক্ষা ও অপেক্ষাকৃত বয়স্ক শিক্ষার্থী যাদের বিরামহীন প্রযুক্তিসংশ্লিষ্টতা রয়েছে এবং যারা অধিকতর দায়িত্বশীল তাদের জন্য দূরশিক্ষণই অধিক কার্যকর।

বাংলাদেশের জন্য আসলে একটি সুসমন্বিত মিশ্র (blended) শিক্ষাপদ্ধতি দরকার এবং তার একটি শক্তিশালী স্থায়ী অবকাঠামো থাকা দরকার। এড-টেকের সর্বাধুনিক সুবিধাগুলোও ধরাছোঁয়ার মধ্যে থাকা চাই। সবচেয়ে বড় কথা হলো প্রস্তুতি। আজ বিশ্ব জুড়ে করোনা ভাইরাসের যে তাণ্ডব, যে লাগামহীন সংক্রমণ—তার কারণ যতটা না এই ভাইরাসের ভয়াবহতা, তার চেয়ে বেশি মানুষের অপ্রস্তুতি। রবীন্দ্রনাথ তার ‘শেষের কবিতায়’ অমিত রায়ের মুখে এই পরিস্থিতির চমত্কার করে ব্যাখ্যা করেছেন। অমিতের ভাষ্যে—সম্ভব পরের জন্য সব সময় প্রস্তুতি থাকাই সভ্যতা। অসভ্যেরা সব ব্যাপারেই অপ্রস্তুত। অর্থাত্ সভ্যতার আরেক অর্থ প্রস্তুতি। শিক্ষাক্ষেত্রে এই আপত্কালীন প্রস্তুতির মধ্যে টেলিভিশন শিক্ষার গুরুত্ব অপরিসীম।

লেখক :ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন