বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

শেখ হাসিনার কারান্তরীণ দিবস আজ

অবরুদ্ধ হয়েছিল বাংলাদেশের গণতন্ত্র

আপডেট : ১৬ জুলাই ২০২০, ১১:১৫

১৬ জুলাই গণতন্ত্রের মানসকন্যা শেখ হাসিনার কারান্তরীণ দিবস। সেদিন বাংলাদেশের গণতন্ত্রকেই অবরুদ্ধ করা হয়েছিল। ইয়াজউদ্দিন-ফখরুদ্দিন-মইনুদ্দিনের নেতৃত্বে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দ্বারা আওয়ামী লীগের সভানেত্রী দেশরত্ন শেখ হাসিনাকে গ্রেফতার ছিল জনগণের কণ্ঠ রোধ ও অধিকার হরণ করার প্রক্রিয়া। কিন্তু এ প্রক্রিয়া চালু হয়েছিল ২০০১ সালে বিএনপি-জামায়াত জোট ক্ষমতায় আসার পর থেকেই। বাংলাদেশে আওয়ামী লীগের রাজনীতি চিরতরে ধ্বংস করার জন্য মহাপরিকল্পনা নিয়ে আগাতে থাকে বিএনপি-জামায়াত চক্র। অথচ শেখ হাসিনাই স্বাধীনতা, মুক্তিযুদ্ধ ও গণতন্ত্রের স্তম্ভ। তিনি যত দিন থাকবেন তত দিন পাকিস্তানি ভাবধারায় রাষ্ট্র গঠন করা যাবে না। সেই পরিকল্পনা থেকেই ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট আওয়ামী লীগের জনসভায় শেখ হাসিনাকে হত্যার উদ্দেশ্যে গ্রেনেড হামলা করা হয়। জননেত্রী শেখ হাসিনা প্রাণে বেঁচে গেলেও নারী নেত্রী আইভি রহমানসহ ২৪ জন নেতাকর্মী নিহত ও পাঁচ শতাধিক নেতাকর্মী আহত হন। তিনি এভাবে ১৯ বার নিশ্চিত মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে এসেছেন।

২০০৬ সালের ৬ অক্টোবর অষ্টম জাতীয় সংসদের মেয়াদ শেষ হয়। কিন্তু বিএনপি জামাত ক্ষমতাকে আঁকড়ে রাখার জন্য নির্বাচনের নীল নকশা তৈরি করে। বিচারপতিদের বয়স বাড়িয়ে দলের সাবেক আন্তর্জাতিক সম্পাদক কে এম হাসানকে তত্ত্ববধায়ক সরকারের প্রধান, আজিজ মার্কা নির্বাচন কমিশন গঠন, ১ কোটি ২৩ লাখ ভুয়া ভোটার তৈরি করে পাতানো মঞ্চে নির্বাচন—সবই ছিল সাজানো নাটক। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী দলগুলোর ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনে কে এম হাসান দায়িত্ব পালনে অপারগতা প্রকাশ করায় সংবিধানেরর চারটি উপধারা লঙ্ঘন করে তত্কালীন রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিন আহমেদ নিজে একই সঙ্গে রাষ্ট্রপতি ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হয়ে যান। তিনি পরিচিতি পান খালেদা জিয়ার ইয়েস উদ্দিন হিসেবে। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোটের আন্দোলনে জনগণ ইয়াজউদ্দিন সরকারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায়। একদিকে যে কোনো মূল্যে নির্বাচন করার পাঁয়তারা, অন্যদিকে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে জনগণের যে কোনো মূল্যে নির্বাচন প্রতিহতের ঘোষণা। জনগণ আর সরকার যখন মুখোমুখি, তখনই সশস্ত্র বাহিনীর হস্তক্ষেপে ইয়াজউদ্দিন তত্ত্বাবধায়কের প্রধান থেকে পদত্যাগ করেন। বিএনপি মনোনীত বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ফখরুদ্দিন আহমেদ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। সেই সময়ের সেনাপ্রধানও ছিলেন বিএনপির খুবই আস্থাভাজন। বিএনপি যে ১ কোটি ২৩ লাখ ভুয়া ভোট তৈরি করেছিল, সেজন্য ভোটার লিস্ট সংশোধন করার অজুহাতে সংবিধানে নির্ধারিত ৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচনের বাধ্যবাধকতা থাকলেও তারা একটু সময় চেয়েছিলেন। জনগণ তাতে সায়ও দিয়েছিল। কিন্তু অনির্বাচিত সরকার যখন ক্ষমতার স্বাদ পেয়ে যায়, তখনই ফন্দি আঁটে কীভাবে দুই নেত্রীকে মাইনাস করে ক্ষমতা দীর্ঘস্থায়ী করা যায়। তিন উদ্দিনের সরকার প্রথমেই বুঝে ফেলে তাদের ক্ষমতাকাল দীর্ঘায়িত করার ক্ষেত্রে বড় প্রতিবন্ধকতা শেখ হাসিনা। তখন কিছু বুদ্ধিজীবীর মাধ্যমে সংস্কারের ধুয়া তুলে ‘মাইনাস টু’ ফর্মুলা বাজারে ছেড়ে দেয়। কিন্তু মাইনাস টুর আড়ালে মূল টার্গেট হলো মাইনাস ওয়ান, মানে শেখ হাসিনা।

ব্যক্তিগত সফরে জননেত্রী শেখ হাসিনা যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থানকালে সরকার খালেদা জিয়াকে বিদেশে যাওয়ার জন্য চাপ দেয়। তিনি রাজি হন। তখনই বঙ্গবন্ধুর কন্যা দেশে ফেরার উদ্যোগ নেন। নেত্রীর দেশে ফেরার খবরে উদ্বিগ্ন ও বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে সরকার। দেশরত্ন শেখ হাসিনাকে রাজনৈতিকভাবে হত্যার ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে মিথ্যা দুর্নীতির অভিযোগ তুলে চরিত্র হননের চেষ্টা করা হয়। এর পরও যখন তিনি আরো দৃঢ় অবস্থান নেন, তখন সরকার ১৮ এপ্রিল ‘বিপজ্জনক ব্যক্তি’ হিসেবে দেশে ফেরার নিষেধাজ্ঞা জারি করে, সব এয়ারলাইনসকে বলে দেয় শেখ হাসিনাকে বহন করলে ঢাকায় তাদের ল্যান্ড করতে দেওয়া হবে না। তখন দেশরত্ন শেখ হাসিনা আলজাজিরা টেলিভিশনে এক সাক্ষাত্কারে বলেছিলেন, ‘বাংলাদেশের মাটিতে আমার জন্ম, ঐ মাটিতেই আমার মৃত্যু হবে। যে কোনো ভয়ভীতি আমাকে দেশে ফেরা থেকে বিরত রাখতে পারবে না।’ কোনো অপশক্তিই সেদিন বঙ্গবন্ধুর কন্যাকে দেশে ফেরা থেকে বিরত রাখতে পারেনি। ৭ মে তিনি দেশে ফিরে আসেন। জরুরি অবস্থা ও সরকারের কঠোর প্রতিরোধ উপেক্ষা করে লাখ লাখ জনতা বঙ্গবন্ধরু কন্যাকে সংবর্ধনা দিয়ে বিমানবন্দর থেকে মিছিল করে বঙ্গবন্ধু ভবন হয়ে সুধা সদনে নিয়ে আসে।

সরকার যখন দেখল কোনো বাধাতেই শেখ হাসিনাকে দাবিয়ে রাখা যাচ্ছে না, তখনই গ্রেফতার করার চূড়ান্ত সিন্ধান্ত নেয়। ১৬ জুলাই, সকালে অন্ধকার নেমে এসেছিল বাংলাদেশের গণতন্ত্রের ভাগ্যাকাশে। বাংলাদেশের স্বাধীনতার নেতৃত্বদানকারী সংগঠনের সভাপতি, জাতির পিতার কন্যাকে কোনো প্রকার পরোয়ানা ছাড়াই গ্রেফতার করা হলো। দেশরত্ন শেখ হাসিনা গ্রেফতার হওয়ার পূর্বে দুটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ করেছিলেন—একটি হলো দীর্ঘদিনের পরীক্ষিত বিশ্বস্ত জিল্লুর রহমানকে ভারপ্রাপ্ত সভাপতির দায়িত্ব প্রদান; অপরটি দলীয় নেতাকর্মীদের উদ্দেশে একটি চিঠি লিখে করণীয় সম্পর্কে নির্দেশনা প্রদান। তিনি বলেছিলেন—

প্রিয় দেশবাসী, আমার সালাম নিবেন। আমাকে সরকার গ্রেফতার করে নিয়ে যাচ্ছে কোথায় জানি না। আমি আপনাদের গণতান্ত্রিক অধিকার ও অর্থনৈতিক মুক্তির লক্ষ্যে সারা জীবন সংগ্রাম করেছি। জীবনে কোনো অন্যায় করিনি। তার পরও মিথ্যা মামলা দেওয়া হয়েছে। ওপরে আল্লাহ রাব্বুল আলামিন ও আপনারা দেশবাসী, আপনাদের ওপর আমার ভরসা।

আমার প্রিয় দেশবাসী, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীদের কাছে আবেদন, কখনো মনোবল হারাবেন না। অন্যায়ের প্রতিবাদ করবেন। যে যেভাবে আছেন অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবেন। মাথা নত করবেন না। সত্যের জয় হবেই। আমি আছি আপনাদের সাথে, আমৃত্যু থাকব। আমার ভাগ্যে যা-ই ঘটুক না কেন, আপনারা বাংলার জনগণের অধিকার আদায়ের জন্য সংগ্রাম চালিয়ে যাবেন। জয় জনগণের হবেই। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়বই। দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটাবই। জয় বাংলা জয় বঙ্গবন্ধু। শেখ হাসিনা (১৬.০৭.২০০৭)

বঙ্গবন্ধুর কন্যার এই চিঠি জাতিকে প্রেরণা ও শক্তি দিয়েছে। নেতাকর্মীদের ঐক্য সুদৃঢ় ও মনোবল চাঙ্গা রাখতে সাহস জুগিয়েছিল। জাতির পিতা ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ গ্রেফতারের পূর্বে যেমনিভাবে চূড়ান্ত বিজয় না হওয়া পর্যন্ত সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়ার নির্দেশনা দিয়েছিলেন, ঠিক বঙ্গবন্ধুর সুযোগ্য উত্তরসূরি দেশরত্ন শেখ হাসিনাও অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর আহ্বান জানিয়েছেন। পাকিস্তানের কারাগারে ৯ মাস বন্দি থাকাকালে এদেশের মুক্তিকামী বাঙালি যেভাবে বাংলাদেশের স্বাধীনতা এনেছিলেন, ঠিক তেমনি বঙ্গবন্ধরু কন্যার ৩৩১ দিন কারাবাসের সময় আওয়ামী লীগের নিবেদিত কর্মীরা জনগণকে ঐক্যবদ্ধ করে তাদের প্রিয় নেত্রী শেখ হাসিনার মুক্তি ও নির্বাচন দিতে সরকারকে বাধ্য করেছিল।

সেই থেকে শুরু। টানা তিন মেয়াদে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ রাষ্ট্র পরিচালনা করছে। জাতির পিতার অসম্পূর্ণ কাজ নিরলসভাবে করে যাচ্ছেন তারই সুযোগ্য কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার ও যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের মাধ্যমে জাতি হয়েছে কলঙ্কমুক্ত। মহাকাশে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট উেক্ষপণের মাধ্যমে মহাকাশে স্যাটেলাইট ক্লাবের গর্বিত সদস্য বাংলাদেশ। জিডিপিতে বিগত কয়েক বছরই দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে সর্বোচ্চ অবস্থানে। বাংলাদেশ শুধু উন্নয়নের রোল মডেলই নয়, একটি মানবিক রাষ্ট্র হিসেবেও আন্তর্জাতিক বিশ্বে স্বীকৃত। ১০ লাখ রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দিয়ে শেখ হাসিনা আজ বিশ্বমানবতার মা। করোনা মোকাবিলায়ও আন্তর্জাতিক বিশ্বে প্রশংসা কুড়িয়েছে বাংলাদেশ। আজ বাংলাদেশ সারা বিশ্বে অপার বিস্ময়ের নাম। ‘রূপকল্প-২০২১’-এ মধ্যম আয়ের দেশ বাস্তবায়ন করে ‘রূপকল্প-২০৪১-এর মাধ্যমে একটি উন্নত, সমৃদ্ধ, অসাম্প্রদায়িক সোনার বাংলা গঠনে দুর্বার দুরন্ত গতিতে এগিয়ে চলেছেন বঙ্গবন্ধুর কন্যা শেখ হাসিনা।

লেখক : সদস্য, সম্প্রীতি বাংলাদেশ ও সাবেক ছাত্রনেতা

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন