শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

কুরবানির চামড়ার অর্থায়নে দারিদ্র বিমোচন ভাবনা

আপডেট : ২৯ জুলাই ২০২০, ২৩:৩৭

বিশ্ব মুসলিম উম্মাহর দুটি প্রধান ধর্মীয় উৎসব হল ঈদ-উল ফিতর এবং ঈদ উল-আযহা। ঈদ উল-আযহা যা আমরা সাধারণত  কুরবানির ঈদ বলে অভিহিত করে  থাকি। কুরবানির ঈদের প্রধান বৈশিষ্ঠ্য হল হালাল গরু, ছাগল, মহিষ, উট এবং দুম্বা পশু উৎসর্গের অনুষ্ঠান। ইসলামী দৃষ্টিভঙ্গিতে কুরবানি হচ্ছে নির্দিষ্ট দিনে নির্দিষ্ট ব্যক্তির আল্লাহর সন্তুষ্টি ও পুরষ্কার লাভের আশায় নির্দিষ্ট পশু জবাহ করা। ইসলামে  হিজরী সনের ১২তম চন্দ্র মাসের  জিলহজ্জ্ব মাসের ১০ তারিখ সকালে থেকে ১৩ তারিখ পর্যন্ত কুরবানি করার সময় হিসাবে নির্ধারিত। এ দিন গুলোতে বিশ্ব মুসলিম জাহান পশু জবাহের মাধ্যমে মুসলমানদের আদি পিতা হযরত ইব্রাহিম (সাঃ) এর আত্মত্যাগ স্বরণ করেন। হযরত ইব্রাহিম (আঃ) এর মাধ্যমেই কুরবানির প্রচলন শুরু হয়, যা অতি প্রাচীন ধর্মীয় অনুষ্ঠান বলে মনে করা হয়। তবে এ নিবন্ধনের উদ্দেশ্য কুরবানির ইতিহাস নয়। দারিদ্র বিমোচনে কুরবানির চামড়া কি ভাবে  কাজে লাগানো যায় এ সম্পর্কে আলোকপাত করা।

কুরবানির চামড়া সম্পর্কে বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) বলেন, তোমরা কুরবানির পশুর চামড়া দ্বারা উপকৃত হও ; তবে  বিক্রি করে দিও না। এ হাদীস থেকে বুঝা যায়, যে ব্যক্তি কুরবানি করবে সে কুরবানির চামড়া বিক্রি করে উহার মূল্য নিজের কাজে লাগাতে পারবে না। ইসলামী শরীয়তের দৃষ্টিতে কুরবানির চামড়া দান করা উওম। সাধারণত যাকাত, ফিতরা পাওয়ার উপযুক্ত ব্যক্তিরাই কুরবানির চামড়ার অর্থ পাওয়ার হকদার। তবে এক্ষেত্রে ইয়াতিম, হতদরিদ্র গরীব শিক্ষার্থীকে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে দেয়া যাবে। আমাদের দেশে  কুরবানিদাতারা কুরবানীর চামড়া সাধারণত ব্যবহার করে না। তারা চামড়া বিক্রি করে তা গরীব অসহায় দের মাঝে দান সদকাহ করে থাকে। কুরবানির কয়েকদিন পূর্বে বাণিজ্য মন্ত্রাণালয় চামড়া ক্রয়ের জন্য প্রতি বর্গফুট হিসেবে চামড়ার দাম বেধে দিয়ে থাকে। বিগত ২০১৯ সালে সরকার নিধারিত মূল্য ছিল গরুর চামড়া প্রতি বর্র্র্গফুট ৪৫-৫০ টাকা আর ছাগলের চামড়া প্রতিবর্গফুট ১৮-২০ টাকা। কিন্তু গত কয়েক বছরে অসাধু চামড়া ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেটের কারণে কুরবানীরদাতারা যথাযথ দাম পাইনি বলে বঞ্চিত হয়েছে মূলত অসহায় দরিদ্র জনগোষ্ঠী।

বর্তমানে করোনাকালীন সময়ে দেশে দরিদ্রতার হার বেড়েই চলেছে। গ্রাম অঞ্চলে সমাজভিত্তিক কুরবানী দেওয়া হয় কিন্তু চামড়ার মূল্য যে যার মত করে গরীবদের মাঝে বিতরণ করে থাকে। আমরা যদি ব্যক্তিগত ভাবে চামড়ার মূল্য বিতরণ না করে সমাজভিত্তিক বা  মসজিদ ভিত্তিক একত্র কুরবানির চামড়ার মূল্য সামষ্ঠিকভাবে দারিদ্র বিমোচনে সংগঠিতভাবে চামড়ার মূল্য ব্যবহার করলে তা দারিদ্র বিমোচনে  বিশেষ সহায়ক ভূমিকা পালন করবে। আমরা সামষ্ঠিকভাবে চামড়ার মূল্য ব্যবস্থাপনা গড়ে তুলতে পারি, তাহলে অসহায় হত দরিদ্র জনগোষ্ঠী লাভবান হবে। পরীক্ষামূলকভাবে সমাজভিত্তিক চামড়া  বিক্রির টাকা একত্রিত করে ঐ সমাজে বসবাসরত দরিদ্র জনগোষ্ঠির তালিকা করে তন্মোধ্য কর্মক্ষম ব্যক্তিকে স্থায়ী কর্মসংস্থান ব্যবস্থা  করা যায়। যেমন গ্রামীণ এলাকায় কাউকে দুই বা তিনটি গাভী ক্রয়  বা গরু মোটাতাজা করণের ব্যবস্থা করা, অটো রিক্সা বা অটো ভ্যান ক্রয় করে দেওয়া , ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী শ্রেণী তৈরি করা, মহিলাদের সেলাই মেশিন ক্রয় করে দেওয়া, মৎস্য চাষের ব্যবস্থা করা, ছোট আকারে পোল্ট্রি করে দেওয়া, হস্তচালিত তাঁত  শিল্পের ব্যবস্থা করা, জমি বর্গা নিয়ে ফসল উৎপাদন করা,  ছোট আকারে মুদী মনোহারী দোকান করে দেওয়া, ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প স্থাপন করা, সবজি চাষের ব্যবস্থা করা, সামাজিক বনায়নের ব্যবস্থা করা, কর্মক্ষম শিক্ষিত দরিদ্র যুবকদেরকে কম্পিউটারে প্রশিক্ষণ নিয়ে ফ্রি ল্যান্সিং এর ব্যবস্থা করা, স্বাস্থ্য সম্মত স্যানেটেশনের ব্যবস্থা করা যাতে পরিবেশের উন্নয়ন হয়, কণ্যা দায়গ্রস্থ পিতা-মাতাকে কণ্যার বিবাহের ব্যবস্থা করা, সৌখিন মৎস চাষের ব্যবস্থা করা, নার্সারির ব্যবস্থা করা, ইত্যাদি। 

কর্মক্ষম দরিদ্র জনগোষ্ঠী কে যদি আমরা উপরোল্লেখিত বিভিন্ন উপায়ে স্থায়ী কর্মসংস্থান করা যায়, তা ক্রমান্বয়ে দারিদ্র হ্রাসে গুরুত্বপূর্ণ ভ‚মিকা পালন করবে। এ ছাড়াও সরকার তার প্রশাসনিক ব্যবস্থাপনা তথা জেলা প্রশাসক বা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদের নেতৃত্বে স্ব স্ব জেলা উপজেলায় কুরবানির চামড়া বিক্রির টাকা দিয়ে নিজ নিজ অঞ্চলের প্রান্তিক অসহায় জনগোষ্ঠীকে স্বাবলম্বী করার লক্ষ্যে কর্মক্ষম দরিদ্র গনগণকে স্থায়ী কর্মসংস্থান তৈরি করে দিতে পারে যা বর্তমানে চলমান মহা দুর্যোগ করোনা ভাইরাসের কারনে দরিদ্র হয়ে পড়ে জনগণকে কর্মসংস্থান সৃষ্টি করে গ্রামীণ অর্থনীতিকে পুনরুজ্জীবিত করতে সহায়ক ভূমিকা পালন করবে। 

গ্রামীণ অঞ্চলে সমাজ ভিত্তিক বা মসজিদ ভিত্তিক কুরবানী করা হলেও শহরে জনগোষ্ঠী এক্ষেত্রে নিজ নিজ বাড়িতেই সাধারণত কুরবানি করে। সেক্ষেত্রে শহর অঞ্চলে সিটি কর্পোরেশনের কাউন্সিলর বা পৌর অঞ্চলে পৌর কাউন্সিলরের তত্বাবধানে স্ব-স্ব অঞ্চলে কুরবানির চামড়া একত্রিত করে বিক্রি করে সংশ্লিষ্ট ওয়ার্ডে কর্মক্ষম অসহায় দরিদ্রদের কে স্থায়ী কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা যায়। বছরে প্রায় শতকরা ৫০ ভাগ চামড়া আসে কুরবানি থেকে। গত বছরে গরু, মহিষ, ছাগল ও ভেড়া মিলিয়ে কুরবানি হয়েছে ১ কোটি ১৬ লাখ পশু। কুরবানির পশুর চামড়া কেনা বেচায় প্রায় ১৫০০-২০০০ কোটি টাকার লেনদেন হয় বলে ধারণা করা হয়। 

২০১৬-২০১৭ অর্থ বছরে চামড়া খাতে রপ্তানি আয় ছিল ১২৩ কোটি ৪০ লাখ ডলার। কিন্তু ২০১৭ -২০১৮ অর্থ বছরে আয় অস্বাভাবিক কমে ১০৮ কোটি ৫৪ লাখ ডলারে দাড়ায়। ২০১৯-২০২০ অর্থ বছরে ১১ মাসের হিসাবে রপ্তানি আয় দাঁড়িয়েছে মাত্র ৭৪ কোটি ডলার। যা আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ২২ শতাংশ কম। চামড়া রপ্তানি খাত  ছিল তৈরি পোশাক শিল্পের পরে দ্বিতীয় শীর্ষ স্থানীয় রপ্তানী খাত যা বর্তমানে চতুর্থ নম্বরে নেমে এসেছে। চামড়া খাতের অব্যবস্থাপনা উদীয়মান চামড়া শিল্প খাতের বিপর্যয়ের কারন। বিশেষ করে গত বছর ঈদ উল-আযহায় সরকারি নির্ধারিত মূল্য তৃণমূল থেকে কাঁচা চামড়া না কেনায় অনেক কাঁচা চামড়া নষ্ট হয়ে যায় এমনকি কাঁচা চামড়া বিক্রি না করে মাটিতে পুতে ফেলা হয়। অথচ সরকারের পরিকল্পিত ও সুব্যবস্থাপনার মাধ্যমে চামড়া শিল্পে অভ্যন্তরীণ ব্যবহার বৃদ্ধি এবং রপ্তানি বৃদ্ধির মাধম্যে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করা যায়। এজন্য কুরবানির পশুর চামড়ার বাজারে সরকারের করা নজরদারি বাড়াতে হবে। বিশেষ করে বাণিজ্য মন্ত্রনালয় এবং ট্যানানি মালিক সমিতির যৌথ্যভাবে মনিটরিং করে কাঁচা চামড়ার ন্যায্য মূল্য নিশ্চিত করতে হবে।

বর্তমানে কভিট-১৯ মহামারির কারনে দেশে নতুন করে ১ কোটি ৬৪ লক্ষ লোক দরিদ্র হয়েছে। কুরবানির চামড়ার বাজার মূল্য ১৫০০- ২০০০ কোটি টাকা সামষ্ঠিকভাবে ব্যবহার করা গেলে তা দারিদ্র হ্রাসে সহায়ক হবে। প্রয়োজনে সমন্বিত ব্যবস্থাপনা গড়ে তোলার লক্ষ্যে সরকার যাকাত বোর্ডের ন্যায় চামড়া বোর্ডের মত সংস্থা গড়ে তুলতে পারে। যে বোর্ডের কাজ হবে সম্বলিত ভাবে চামড়ার টাকা সংগ্রহ করে অসহায় হতদরিদ্রর মাঝে স্থায়ী কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা। এ বিষয়ে সরকারের সংশ্লিষ্ট মহলের আশু পদক্ষেপ কামনা করছি।

লেখক: মুহাম্মাদ মাছুদুর রহমান, ব্যাংকার ও গবেষক

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন