শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনে বর্ণবাদের পরীক্ষা

আপডেট : ০১ সেপ্টেম্বর ২০২০, ০৯:৩৪

সাধারণ সময় নির্বাচনে রাজনৈতিক কনভেনশনের সময় আলোড়ন ওঠে। যদিও কনভেনশনের আগে জনগণ বুঝতে পারে যে, কোন দল কাকে প্রেসিডেন্ট এবং কাকে ভাইস প্রেসিডেন্ট পদে মনোনয়ন দিচ্ছে; তার পরও কনভেনশন নিয়ে আগ্রহের কোনো কমতি থাকে না। ডেমোক্র্যাট ও রিপাবলিকান কনভেনশন যুক্তরাষ্ট্রের একটি বড় ঘটনা। হাজার হাজার মানুষ এই কনভেনশনে অংশগ্রহণ করে। সাধারণত রাজনীতিক, সাংবাদিক, বিশ্লেষক, রাজনৈতিক ধারাভাষ্যকাররা কনভেনশনের শহরে এসে উপস্থিত হন। প্রচুরসংখ্যক বক্তব্য, যোগাযোগ এবং সাক্ষাত্কারে সয়লাব। আপাতদৃষ্টিতে এটা না দেখা গেলেও কার্যত ডেমোক্র্যাট ও রিপাবলিকানরা তাদের কনভেনশন সেরে ফেলেছেন।

আমরা দেখলাম, ডেমোক্রেটিক দলে প্রেসিডেন্ট হিসাবে জো বাইডেন এবং ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে কমলা হ্যারিস মনোনয়ন গ্রহণ করলেন। অন্যদিকে রিপাবলিকান দলে নমিনেশন পেলেন প্রেসিডেন্ট পদে ডেনাল্ড ট্রাম্প এবং ভাইস প্রেসিডেন্ট পদে মাইক পেন্স।

এখন কী? এটা একটা ঐতিহাসিক ব্যাপার যে, জো বাইডেন তার ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে কমলা হ্যারিসকে বেছে নিয়েছেন। কিন্তু তার চেয়েও বড় ঐতিহাসিক ব্যাপার হলো আমেরিকানরা কখনো কোনো মহামারির মধ্যে নির্বাচন করেনি। একদিকে করোনার প্রকোপ বৃদ্ধি এবং অন্যদিকে পুলিশের নিষ্ঠুরতা ও তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদের ফলে আমেরিকায় বর্ণবাদ উত্তেজনা চরমে পৌঁছেছে। মুক্ত ভূমি এখন রীতিমতো জরাক্রান্ত।

কিন্তু এর বাইরেও কিছু অভিনব বিষয় আছে :কনভেনশন নিয়ে দুই সপ্তাহ তর্কবিতর্কের পর আমেরিকার জনগণের কাছে নভেম্বরের নির্বাচন বিষয় এখন পরিষ্কার নয়। নির্বাচনে দুই রাজনৈতিক দল শুধু আমেরিকার ভবিষ্যত্ নিয়ে লড়াই করছে না, তারা লড়ছে আমেরিকা কাদের হবে, তা নিয়ে—দেশটি কি শুধু শ্বেতাঙ্গ জনগণের হবে, নাকি সব বর্ণের মানুষের হবে। সাবেক প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা সতর্ক করে বলেছেন, ট্রাম্পের দ্বিতীয় মেয়াদ হবে যুক্তরাষ্ট্রের জন্য ধ্বংসাত্মক। আর প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প বলেছেন, আমেরিকানদের ঐতিহ্যগত সমাজব্যবস্থা নির্ভর করছে ব্যালটের ওপর। তিনি সতর্ক করে বলেছেন, ‘আপনার ভোটের ওপর নির্ভর করবে, আমরা কি আইনের শাসন মেনে চলা আমেরিকানদের নিরাপদ রাখতে পারব, নাকি সবকিছু নৈরাজ্যবাদী, সহিংস বিক্ষোভকারী ও অপরাধীদের নিয়ন্ত্রণে চলে যাবে।’ তিনি আরো বলেছেন, ‘এই নির্বাচনই বলে দেবে, আমরা আমেরিকার স্বাভাবিক চিরাচরিত জীবনকে রক্ষা করতে পারব, নাকি সেটা সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে যাবে।’

আরো একটি বিষয় পরিষ্কার হয়ে গেছে যে, এই বছর আইনের শাসনের দেশ আমেরিকার আইনশৃঙ্খলা ভেঙে পড়েছে। যদিও আমরা দেখেছি, ট্রাম্প নিজেই গত চার বছরে নির্বাচনে রাশিয়ার হস্তক্ষেপ থেকে শুরু করে, ইউক্রেনে ফোন করা থেকে শুরু করে, এমনকি নিজের সন্তানকে চাকরিতে নিয়োগের মধ্য দিয়ে বহুবার আইন ভেঙেছেন। তিনি মহামারির এই সময়ে মাস্ক ব্যবহার না করে, রিপাবলিকান কনভেনশনে সামাজিক দূরত্ব বজায় না রেখে বুঝিয়ে দিয়েছেন যে কম যান না। এটি হলো ট্রাম্পের আমেরিকা এবং এক ব্যক্তির শাসনই এখানে বাস্তবতা।

কিন্তু ডেমোক্র্যাটরা যখন সবার জন্য উন্মুক্ত ভূমি করতে চাইছে, অভিবাসিত সংস্কৃতি সতেজ করে তুলতে চাইছে, তখন ট্রাম্প এবং তার রিপাবলিকান দল দেশটিকে আবার শ্বেতাঙ্গদের জন্য তৈরি করতে চাইছে। আমেরিকার এবারের নির্বাচনের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য দিক হলো দেশটি করোনা ভাইরাসে জর্জরিত, ৪ কোটি মানুষ বেকার হয়ে গেছে, অর্থনীতি চরম ধাক্কা খেয়েছে। এমনকি ট্রাম্পের কোভিড-১৯ ব্যবস্থাপনার চরম ব্যর্থতাকেও ছাপিয়ে সামনে উঠে এসেছে বর্ণবাদ।

আমেরিকা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল এবং সৃষ্টি হয়েছিল শ্বেতাঙ্গ প্রভুত্বের মধ্য দিয়ে। দাসত্ব, বিভাজন, সিভিল রাইটের জন্য আন্দোলন সব ঘটেছিল ২০০ বছরেরও কিছু কম সময় আগে। জনগণ ভুলে গেছে সেই নতুন আমেরিকায় আক্ষরিক অর্থেই কীরকম নৃশংসতা ঘটেছিল, কীভাবে কৃষ্ণাঙ্গ আর অশ্বেতাঙ্গদের দাসে পরিণত করে আমেরিকা গড়ে উঠেছিল। সুতরাং প্রশ্নটি হলো, আমেরিকা কি বাইডেনের সঙ্গে হাঁটবে, নাকি ট্রাম্পকে আবার সুযোগ দেবে শ্বেতাঙ্গ প্রভুত্বের শাসন কায়েম করতে? আমেরিকা কি সবার জন্য উন্মুক্ত দেশ হবে, নাকি শ্বেতাঙ্গদের দেশে পরিণত হবে? আমেরিকার বর্তমান প্রেসিডেন্ট এটা পরিষ্কার করে দেখিয়েছেন যে তার আমেরিকা হবে শ্বেতাঙ্গদের আমেরিকা। আপনি যদি তার সেই চিন্তায় সায় দেন, তাহলে সে হবে আপনার পছন্দের প্রেসিডেন্ট, যিনি আগামী চার বছর দেশটি চালাবেন।

ট্রাম্পের রিপাবলিকান দলের কনভেনশন আমার কাছে এই বার্তা দিয়েছে যে আমেরিকা তাদের দৃষ্টিতে একটি শো-বিজনেস। নির্বাচন কোভিড, অর্থনীতি বা বর্ণবাদের প্রশ্ন দ্বারা নয়, বরং এটা যেন একটা লাইট, ক্যামেরা, অ্যাকশন এবং ধ্বংসের ব্যাপার। এবং এই বিষয়টি ট্রাম্পের চেয়ে ভালো আর কেউ বোঝেন না।

ইংরেজি থেকে অনুদিত

লেখক: যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশি সাংবাদিক, নারী অধিকারবিষয়ক আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞ

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন