শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

লেখাপড়ার সুখ-দুঃখ এবং অপমান

আপডেট : ০৪ সেপ্টেম্বর ২০২০, ০৯:৩৬

আমি খুব আশাবাদী মানুষ। খুব মন খারাপ করা কোনো ঘটনাও যদি ঘটে, তখনো আমি নিজেকে বোঝাই, এটি বিচ্ছিন্ন একটি ঘটনা; তখনো আমি ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখে অপেক্ষা করতে পারি। আমি সহজে হতাশ হই না, আশাহত হই না, মনে দুঃখ পাই না। বেশি আশাবাদী হয়ে আমার কোনো ক্ষতি হয় কিন্তু সবচেয়ে বড় কথা, যেসব বিষয় নিয়ে আশাবাদী ছিলাম তার প্রায় সবগুলোই সত্যি হয়েছে। তার পরও সেদিন একটা ছেলের একটা ইমেইল পড়ে আমার মন খারাপ হয়ে আছে, ইমেইলে সে যে বিষয়গুলো লিখেছে তার মধ্যে একটিও নুতন কিছু নেই, আমি সবগুলোই বহুদিন থেকে জানি, তার পরও সেটা আমি আমার মাথা থেকে সরাতে পারছি না। আমি নাম-পরিচয় গোপন রেখে তার ইমেইলটি তুলে দিচ্ছি:

“আসসালামু আলাইকুম স্যার। কেমন আছেন? আশা করি ভালো আছেন। আমার শিক্ষাজীবনের কিছু ঘটনা তুলে ধরলাম। আশা করি এইসব ঘটনা শুধু আমার একার না অনেকেরই :

১. ক্লাস ৫ জীবনের প্রথম বোর্ড পরীক্ষা পিএসসি (এই পরীক্ষার কী প্রয়োজনীয়তা আমি আজও বুঝলাম না) ২০১৩ সাল প্রশ্ন ফাঁসের স্বর্ণযুগ। পরীক্ষার এক-দুই দিন আগেই সব প্রশ্ন পাওয়া যায়। সেই সব প্রশ্ন পেয়ে অভিভাবকের সহায়তায় সুন্দর করে পরীক্ষা দিয়ে এলাম। কেউ আমাকে একটি বারও বলল না, এটা কোরো না।

২. ক্লাস ৬/৭ আমার জীবনের কাটানো কিছু সুন্দর সময়, এই সময় আমি পড়ালেখা খুবই কম করতাম। যার কারণে আমি এই সময় সাইকেল চালানো শিখি, কোডিং শিখি, কিছু সুন্দর বই পড়ি। কিন্তু আমি ছিলাম ক্লাসের লাস্ট স্টুডেন্ট। এই সময় আমি দেখলাম, অন্য সবাই স্কুলের টিচারের কাছে পড়ে। আমাদের যে গণিত শিক্ষক, তিনি তার কাছে পড়ে সব স্টুডেন্টদের পরীক্ষার আগেই প্রশ্ন দিয়ে দিতেন। তিনি তার কোচিংয়ে সেই প্রশ্ন সলভ করাতেন। তারা সেই প্রশ্ন টিফিন টাইমে বসে বসে মুখস্থ করত। টিফিন টাইমে পড়ে, ক্লাসে তারা বসে বসে সেই প্রশ্নে পরীক্ষা দিত। যেহেতু আমি তার কাছে পড়তাম না, তাই আমি সেই পরীক্ষায় কখনো উত্তর করতে পারতাম না। কারণ প্রশ্নগুলো ছিল খুবই কঠিন। আমার কাছে কোনো গাইড ছিল না। প্রশ্নগুলো হতো ক্লাস এইটের বই থেকে। তাই পরীক্ষা আমি ০-এর বেশি পেতাম না (কিন্তু নিজে নিজে অঙ্ক করার ফলে এর উপকার আমি আজ পাচ্ছি)।

৩. ক্লাস এইট জেএসসির পরীক্ষা, এ সময় প্রশ্ন ফাঁস হতো। তবে প্রশ্নফাঁসের পদ্ধতি ছিল খুবই অদ্ভুত। পরীক্ষায় দু-তিন ঘণ্টা আগে কেন্দ্র থেকে প্রশ্ন ফাঁস হয়। এ প্রশ্ন দুই ধরনের স্টুডেন্ট নিত—

এক : যারা কিছুই পারে না, দুই : পড়ালেখায় ভালো roll ১, ২, ৩রা। যাদের অভিভাবকের কাছে পড়ালেখা সব! এমসিকিউ পরীক্ষায় সকল উত্তর পাওয়া যেত, কিন্তু কেউ প্রশ্ন জানত না। সবাই শুধু উত্তরটা জানত যেমন, ১-২-৩-৪-এর answer ক-খ-গ। কৃষিশিক্ষা পরীক্ষার দিনে সম্পূর্ণ প্রশ্ন ফাঁস হয়। যেহেতু আমি ইন্টারনেট ব্যবহার করতাম না, শুধু আমার কাছে প্রশ্ন নাই। সবাই মহা খুশিতে পরীক্ষা দিয়ে এলো, শুধু আমি পেলাম দীর্ঘশ্বাস।

৪. ক্লাস নাইন-টেন শুধু ক্লাসের শিক্ষকদের কাছে না পড়ার কারণে কখনোই ব্যাবহারিকে ফুল মার্ক পেতাম না।

৫. এসএসসি পরীক্ষায় স্যাররা বলে দিলেন কেন্দ্রে গিয়ে কিছু টাকা দিলে ব্যাবহারিকে ফুল মার্ক দিয়ে দেয়। সবার অভিভাবক টাকা দিয়ে দিলেন। আমিও দিলাম। (আমি কখনো ভাবতেও পারি না এক শিক্ষকের কথায় আরেক শিক্ষককে ঘুষ দেওয়ার জন্য সবার বাবা-মা ৫০০ টাকা দিতে পারে)। আমিও পরদিন সেই ৫০০ টাকার একটি নোট স্যারকে দিয়ে দিলাম। স্যার খুশি হয়ে বললেন, তোমার যা মন চায় সেই ব্যাবহারিক একটি লিখো। সবাই মিলে গল্প করতে করতে নিচে খাতা রেখে ব্যাবহারিক খাতা দেখে তুলে দিলাম। এটাই নাকি স্বাভাবিক! সব কেন্দ্রে নাকি এই হয়! এভাবে সেসব ব্যবহারিক পরীক্ষায় দিয়ে দিলাম! আইসিটি পরীক্ষা না দিয়েও ফুল মার্ক পেয়ে গেলাম! কোনো মৌখিক পরীক্ষা ধরল না! এক শিক্ষকের কথায় অন্য শিক্ষককে একজন ছাত্র যখন ঘুষ দেয়, তখন তা জাতিকে ধ্বংস করার জন্য যথেষ্ট নয় কি?

৬. এর পরের ঘটনা কলেজে ভর্তি নিয়ে। দেশের এক নম্বর বয়েজ কলেজ (যে কলেজে ভর্তি পরীক্ষা দিয়ে টিকতে হয়) সেই কলেজে ভর্তি পরীক্ষা দিলাম। টিকে গেলাম। ভাইবাতে ডাক পড়ল। ভাইবা দিলাম। কিন্তু আমি টিকলাম না। অনেকে বলল, কিছু টাকা কিংবা ওপর থেকে ফোন দিলে ভর্তি হতে পারবা। আমারই এক সহপাঠী পরীক্ষায় না টিকেও সে শুধু ক্ষমতা আর টাকার জোরে সেই কলেজের স্টুডেন্ট। আর আমি পেলাম দীর্ঘশ্বাস!

এই যদি হয় দেশের অবস্থা, তাহলে এই দেশে সাহেদ-সাবরিনা কেন তৈরি হবে না? যখনই মনে হয় আমি শিক্ষককে ঘুষ দিয়ে এসেছি তখন লজ্জায় কুঁকড়ে যেতে মন চায়। আরো অনেক ঘটনা হয়তো বলার আছে কিন্তু বললাম না। যখন এসব কথা মনে হয় তখনই দীর্ঘশ্বাস ফেলতে মন চায়। আমি নিজেকে নিজে প্রতিজ্ঞা করেছি কখনো আর দুর্নীতি করব না; কিন্তু যখন দেখি, সবাই মহা উত্সাহে দুর্নীতি করছে, তখন এই দেশ নিয়ে দীর্ঘশ্বাস বের হয় আমি একা কী-বা করতে পারব?

স্যার, এই দীর্ঘশ্বাস থেকে মুক্তি পাওয়ার উপায় কী? আশা করি উত্তর দিবেন

...শিক্ষার্থী, একাদশ শ্রেণি...(নাম পরিচয় গোপন রাখবেন)”

ছেলেটি কী করবে আমার কাছে জানতে চেয়েছে, আমি তাকে বলার মতো কিছু খুঁজে পাচ্ছি না। এই দেশে লেখাপড়ার সঙ্গে সম্পর্ক আছে, এরকম লক্ষ লক্ষ মানুষ রয়েছে। তাদের একজনও কি ছেলেটাকে কিছু বলতে পারবে? পারবে না।

পৃথিবীতে সব সমস্যারই একটা সমাধান খুঁজে পাওয়া যায়, এই সমস্যাটারও একটা সমাধান বের করা যাবে; কিন্তু তার আগে সমস্যাটা যে আছে সেটা মেনে নিতে হবে। আমাদের দেশে আমরা সমস্যা থেকে চোখ ফিরিয়ে নিয় ভান করি, কোনো সমস্যা নেই। কিন্তু একটা শিশুকে যদি অভিভাবক ও শিক্ষকেরা মিলে বুঝিয়ে দিই—অন্যায় করার মধ্যে কোনো দোষ নেই; শুধু তা-ই নয়, তাকে অন্যায় করার কায়দাকানুন শিখিয়ে দিই, অন্যায় করতে সাহায্য করি, তাহলে ভবিষ্যতে কী হবে? এই দেশে যখন কেউ দুর্নীতির বিরুদ্ধে কথা বলে, তখন সেটি যে কত বড় একটা ফাঁকা বুলি সেটা কি কেউ খেয়াল করেছে?

এর ভেতরেও আমি আশাবাদী হওয়ার চেষ্টা করি, কল্পনা করি—ছোট একটা শিশু শিক্ষক আর অভিভাবকের অবাধ্য হওয়ার সাহস পায় না, না বুঝেই একটা অন্যায় করে ফেলে। যখন সে বড় হবে, তার নিজের বিদ্যাবুদ্ধি হবে, তখন তারা সাহসী হতে শিখবে, সত্ হতে শিখবে। আমাদের শুধু একটা পরিবেশ তৈরি করে দিতে হবে, যেন নতুন প্রজন্ম সেই স্বপ্ন দেখার সুযোগ পায়, সাহস পায়।

২.

শিক্ষাসংক্রান্ত কিছু দেখলে আমি সেটা জানার চেষ্টা করি। পত্রপত্রিকায় দেখেছি, যেহেতু ২০১০ সালের শিক্ষানীতিটি প্রায় ১০ বছরের পুরোনো তাই সেটাকে আধুনিকায়ন করার চিন্তাভাবনা হচ্ছে। খবরটা পড়ে আমি একটুখানি কৌতুক অনুভব করেছি। সর্বজনশ্রদ্ধেয় কবীর চৌধুরীর নেতৃত্বে এই শিক্ষানীতিটা করা হয়েছিল, ঘটনাক্রমে আমিও তার একজন সদস্য ছিলাম। সেই হিসেবে শিক্ষানীতির কিছু খুঁটিনাটি আমার এখনো মনে আছে। গত ১০ বছর থেকে এই দেশের শিক্ষা কার্যক্রম দেখে দেখে আমি টের পেয়েছি শিক্ষানীতি আসলে কাগজে লেখা কিছু ভালো ভালো কথা ছাড়া আর কিছু নয়। শিক্ষা কার্যক্রম চালানোর সময় শিক্ষানীতিতে কী লেখা আছে সেটা কেউ ভুলেও পড়ে দেখে না। বাস্তবতার সঙ্গে এই শিক্ষানীতির কোনো যোগাযোগ নেই। একটা ভালো শিক্ষানীতি মানে বড়জোর কিছু ভালো স্বপ্ন, এ ছাড়া আর কিছু নয়।

এই দেশে স্কুল-কলেজে লেখাপড়া করতে গিয়ে শিশুদের দুর্নীতিতে হাতেখড়ি হয়, যদি তাদের লেখাপড়া করতে না হতো তাহলে সেই শৈশবে তাদের পিঠে ‘দুর্নীতিবাজ’-এর সিলটি পড়ত না। সারা জীবন এই অপমানের গ্লানি তাদের বহন করতে হতো না।

তারপরও আমি আশা করে থাকি, এই কলুষিত পরিবেশের মধ্যেও আমাদের কিছু সোনার টুকরো ছেলেমেয়ে থাকবে, যারা এই ক্লেদাক্ত পরিবেশেও খাঁটি মানুষ হয়ে বড় হবে। যাদের দেখে আমরা ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখব।

আমার স্বপ্ন দেখার মধ্যে কে আমাকে বাধা দেবে?

লেখক: কথাসাহিত্যিক ও শিক্ষাবিদ

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন