শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

বাবার স্মৃতি-কর্ম পথ চলার প্রেরণা

আপডেট : ০৪ সেপ্টেম্বর ২০২০, ১৩:৫৭

৪ঠা সেপ্টেম্বর, ২০২০, আমাদের বাবা, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঘনিষ্ঠ সহকর্মী, স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক, সংবিধান প্রণেতাদের অন্যতম, স্বাধীনতা পদক প্রাপ্ত (মরণোত্তর) এম. আব্দুর রহিমের ৪র্থ মৃত্যুবার্ষিকী। বাবার জন্ম ২১ নভেম্বর, ১৯২৭ দিনাজপুর সদর উপজেলার জালালপুর গ্রামে। পড়ালেখা শেষ করে ১৯৬০ সালে দিনাজপুরে আইন পেশায় নিয়োজিত হন। ১৯৫২ সালে রাজশাহী কলেজের ছাত্র থাকাবস্থায় ঐতিহাসিক ভাষা আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশ গ্রহণ করেন। আইন পেশায় সক্রিয় হওয়ার পাশাপাশি আওয়ামীলীগের রাজনীতির সাথে জড়িত হন। ১৯৬৬ সালে বঙ্গবন্ধু ঐতিহাসিক ছয় দফা ঘোষণা করলে বৃহত্তর দিনাজপুর জেলা আওয়ামীলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক হিসেবে বাঙালির স্বাধিকার ও স্বায়ত্তশাসনের আন্দোলনে এবং আওয়ামীলীগের প্রার্থী হিসেবে ১৯৭০ সালে প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হয়ে ১৯৭১ এর মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে বৃহত্তর দিনাজপুর অঞ্চলের মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। মুক্তিযুদ্ধে তাঁর অবদান অবিস্মরণীয়। ১৩ এপ্রিল’৭১ পর্যন্ত দিনাজপুর হানাদার মুক্ত ছিল। ২৬ মার্চ মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে বাবাকে আহ্বায়ক করে দিনাজপুরে “মুক্তিযুদ্ধ সংগ্রাম পরিষদ” গঠন করা হয়। মানবিক মূল্যবোধ আর দেশাত্মবোধের চেতনায় উজ্জীবিত হয়ে তিনি ভারতের পশ্চিমবঙ্গের পতিরাম, রায়গঞ্জ, কালিয়াগঞ্জ, বালুরঘাট, গঙ্গারামপুরসহ বিভিন্ন এলাকার শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় নেওয়া মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে ছিলেন।

৭১’এ ১৭ এপ্রিল মুজিবনগর সরকার গঠিত হলে বেসামরিক প্রশাসন পরিচালনার জন্য ১১টি জোনে ভাগ করা হয়। বাবা পশ্চিম জোন-১ এর জোনাল চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন সংশ্লিষ্ট জোনের জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের সদস্যদের দ্বারা। শরণার্থী শিবিরের সার্বিক ব্যবস্থাপনা, ইয়ুথ ক্যাম্প পরিচালনা, মুক্তিযোদ্ধাদের রিক্রুটমেন্ট এবং প্রশিক্ষণ ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব ছিল তাঁর উপরে। দেশ হানাদার মুক্ত হওয়ার পর বাবা ১৭ই ডিসেম্বর সদ্য স্বাধীনতাপ্রাপ্ত দেশে পশ্চিম জোন-১ এর চেয়ারম্যান হিসেবে বগুড়া জেলার প্রশাসনিক দায়িত্ব গ্রহণ করেন এবং ১৮ ডিসেম্বর সকাল ১১ টায় দিনাজপুর গোর এ শহীদ বড় ময়দানে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীন দেশে বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করেন। এ সময় মিত্রবাহিনীর এই অঞ্চলের অধিনায়ক ব্রিগেডিয়ার ফরিদ ভাট্টি ও কর্নেল শমসের সিং এর নেতৃত্বে একটি চৌকস দল তাঁকে গার্ড অব অনার প্রদান করে। স্বাধীনতার পর তিনি যুদ্ধবিদ্ধস্ত বৃহত্তর দিনাজপুর অঞ্চল পুনর্গঠনে আত্মনিয়োগ করেন এবং ত্রাণ ও পুনর্বাসন কমিটির চেয়ারম্যান এর গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেন।

মুক্তিযুদ্ধের চলাকালে বাবার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগ এনে তৎকালীন পাকিস্তানী সেনাশাসক তথাকথিত সামরিক ট্রাইব্যুনালে একতরফা বিচার করে সাজা প্রদান করে। সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধান প্রণয়ন কমিটির ৩৪ জন সদস্যের অন্যতম সদস্য হিসেবে সংবিধান প্রণয়নে অবদান রাখেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যখন স্বাধীনতাত্তোর বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সভাপতি ছিলেন, তখন কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। পঁচাত্তর পরবর্তী সামরিক শাসকদের কোন প্রলোভনই তাঁকে বঙ্গবন্ধু রাজনৈতিক আদর্শ থেকে বিচ্যুত করতে পারেনি। ৭৫ পরবর্তীতে বেগম জোহরা তাজউদ্দিনকে আহ্বায়ক করে কেন্দ্রীয় আওয়ামীলীগ-এর সাংগঠনিক কমিটি গঠন করা হলে তিনি কমিটির সদস্য এবং পরবর্তীতে দীর্ঘদিন কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৮৪ এবং ১৯৮৬ সালে সামরিক শাসন বিরোধী গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে সামরিক শাসক গোষ্ঠী তাঁকে গ্রেফতার করে দীর্ঘদিন কারাগারে আটক রাখে।

বাবা, ১৯৯১ সালে দিনাজপুর সদর আসন থেকে পুনরায় জাতীয় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। তিনি দীর্ঘদিন দিনাজপুর জেলা আওয়ামীলীগের সভাপতি ও দিনাজপুর জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৯৫ সালে চাঞ্চল্যকর কিশোরী ইয়াসমিন ধর্ষণ ও হত্যার প্রতিবাদে গড়ে ওঠা আন্দোলনের বলিষ্ঠতা তাঁকে দিনাজপুরের গণমানুষের কাছে আলোকিত করে। রাজনীতিকে মানুষের সেবা-কল্যাণ আর মঙ্গলের মাধ্যম হিসেবে গ্রহণ করে তিনি সমাজ সেবায় ছিলেন একনিষ্ঠ। দিনাজপুর ডায়াবেটিক হাসপাতাল, চক্ষু হাসপাতাল, রেডক্রিসেন্ট হাসপাতাল সহ নানা সেবামূলক প্রতিষ্ঠান এবং স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা, মসজিদ ও হিন্দু উপাসনালয়সহ দিনাজপুরের সার্বিক উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে তিনি কাণ্ডারির ভূমিকা পালন করেছেন। তিনি রেডক্রস/রেডক্রিসেন্ট সোসাইটি ও হলি ফ্যামিলি হাসপাতালের ম্যানেজিং কমিটির সদস্য ও বগুড়া পল্লী উন্নয়ন একাডেমীর বোর্ড অব গভর্নস এর সদস্য এবং জাতীয় অন্ধ কল্যাণ সমিতি, বাংলাদেশ পরিবার পরিকল্পনা সমিতি ও জাতীয় যক্ষ্মা নিরোধ সমিতির জেলা ও কেন্দ্রীয় কমিটির সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন। তিনি সর্বশেষ বাংলাদেশ আওয়ামীলীগ কেন্দ্রীয় কমিটির উপদেষ্টা পরিষদের অন্যতম সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তাঁর লেখা ‘ধর্মের মুখোশ’ ও ‘৫ম সংশোধনীর মোজেজা’  দুটি গ্রন্থ ব্যাপক সাড়া জাগায়।

তিনি ১৯৭২ সালে বাংলাদেশ আওয়ামীলীগের প্রতিনিধি হিসেবে দিল্লীতে সর্বভারতীয় কংগ্রেসের জাতীয় সম্মেলনে যোগদান করেন। ১৯৭৪ মস্কোয় অনুষ্ঠিত বিশ্ব শান্তি সম্মেলনে বাংলাদেশ প্রতিনিধি দলের উপনেতা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭৮ সালে কুয়ালালামপুরে অনুষ্ঠিত বিশ^ রেডক্রস সোসাইটি কর্তৃক আয়োজিত মানবাধিকার বিষয়ক এক সম্মেলনে যোগদান করেন।

বাবাকে একজন আদর্শ অনুকরণীয় পিতা হিসেবে পেয়েছি-জেনেছি। ‘রাজনীতি ত্যাগের জন্য, ভোগে বা বিত্ত-বৈভব তৈরির জন্য নয়’- তা বাবাকে অনুসরণ করতে দেখেছি। আমার দাদার প্রায় ৭০০/৮০০ বিঘা সম্পত্তি ছিল। দাদার মৃত্যুর পর বাবা ভাগে পেয়েছিলেন ১০০ শত বিঘার উপরে। কিন্তু মৃত্যুর পর আমার ভাই-বোনেরা (ছয় ভাই-বোন) উত্তরাধিকার হিসেবে পেয়েছি ৭৩ বিঘার মত। বাবা সিভিল ল’ইয়ার হিসেবে জেলার প্রথম সারির কয়েকজনের মধ্যে অন্যতম ছিলেন। আইন পেশায় তাঁর রোজগারও কম ছিল না। কিন্তু রাজনীতি-সমাজসেবা করতে গিয়ে বাবার সম্পত্তি কমেছে, বাড়েনি; সম্পত্তি বিক্রি করেছেন। বর্তমান সময়ে জনপ্রতিনিধিরা নির্বাচিত হবার পর পরেই রাজউকের একটি প্লট পাওয়ায় জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়েন। বাবার নামে রাজউকের কোন প্লট ছিল না কিংবা রাজধানীতে অন্য কোন জায়গা সম্পত্তিও ছিলো না। বাবাকে যখন বলতাম, পেশাগত কারণে আমাদের তো ঢাকায় থাকতে হবে, জায়গা কেনা প্রয়োজন; তখন তিনি বলতেন-‘আমি কৃষকের ছেলে, লেখাপড়া শিখে দিনাজপুর শহরে বাড়ী করেছি, তোমাদের লেখাপড়া শিখিয়েছি, যদিও পারো তোমরা তোমাদের টাকায় ঢাকায় বাড়ী করিও’। বাবার কখনই বিশাল অংকের কোন ব্যাংক ব্যালেন্সও ছিল না।

বাবা আমাদের ভাই-বোনদের নিজের সততা, ন্যায় নিষ্ঠা ও মানবিকতার আদর্শে বড় করতে চেষ্টা করেছেন। আমরা যেন পরিবার-আত্মীয়স্বজন-সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন না হয়ে সমাজের সকলের কল্যাণে মানবিক দৃষ্টি ভঙ্গি নিয়ে কাজ করতে পারি, এগিয়ে আসি সেভাবে আমাদের উদ্বুদ্ধ করতেন। আমাদের দিনাজপুর শহরের বাসার ঠিক উল্টো দিকে ‘সদর হাসপাতাল’ যা এখন জেনারেল হাসপাতাল। ৯০-এর  দশকের পূর্বে দিনাজপুর জেলার প্রত্যন্ত অঞ্চলে বিশেষত: ঘোড়াঘাট, নবাবগঞ্জ, বিরামপুর, হাকিমপুর থানার সাথে জেলা শহরের যোগাযোগ ব্যবস্থা খুবই খারাপ ছিল। আত্মীয়-স্বজন ছাড়াও জেলার বিভিন্ন অঞ্চলের অসুস্থ লোকজন অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হলে বাবা আমাদের ঐ সব রোগীদের খোঁজ-খবর নেয়ার জন্য নিয়মিত হাসপাতালে পাঠাতেন। রোগী মহিলা হলে বোনদের পাঠাতেন, তাদের সুবিধা-অসুবিধা জানার জন্য। রোগীদের সাথে থাকা অন্যান্য লোকজনের থাকা-খাওয়ার কোন অসুবিধা আছে কিনা সেসব তথ্য আমাদের এনে দিতে হতো। বর্তমানের মত ২০/২৫ বছর পূর্বে হাসপাতালে বিভিন্ন ধরনের সেবা-মূলক সুযোগ-সুবিধা ছিল না। সে সময় রোগীর পথ্য/খাদ্য ছিল সাগু, বার্লি, জাউ ভাত, হরলিক্স। হাসপাতালে সাগু, বার্লি, জাউ ভাত তৈরি বা পানি গরম করার কোন ব্যবস্থা ছিল না। রোগীদের চাহিদা অনুযায়ী বাবার নির্দেশে বাসায় আমার মা ঐ সব তৈরি করে দিলে আমরা হাসপাতালে রোগীদের কাছে পৌঁছে দিতাম। ফ্লাক্সে গরম পানিও সরবরাহ করতাম। দূর-দূরান্তের রোগীদের সাথে থাকা লোকজন রাতে বাসার বাহির দিকের খোলা বারান্দায় ঘুমানোর ব্যবস্থাও ছিল অন্যান্য মোয়াক্কেলের সাথে।

’৭৩/’৭৪ সাল হবে; বাবা আমাকে একদিন দিনাজপুর প্রধান ডাকঘরে গিয়ে কয়েকটি ‘মানি অর্ডার ফর্ম’ নিয়ে আসতে বললেন। সে সময় কোথাও টাকা পাঠাতে হলে ডাকঘরের মাধ্যমে ‘মানি অর্ডার’ করে পাঠাতে হতো। বর্তমানের মত কুরিয়ার, নগদ, বিকাশ, রকেট ছিল না। পোষ্ট অফিসের মাধ্যমই ছিল টাকা পাঠানোর একমাত্র উপায়। আমি ফর্ম নিয়ে এলে আমাকে শেখালেন কিভাবে মানি অর্ডার ফর্ম পূরণ করে টাকা পাঠাতে হয়। ’৯০ দশকের পূর্ব পর্যন্ত কাউকে কোন জরুরী সংবাদ দিতে হলে  টেলিগ্রামই ছিল একমাত্র ভরসা। টেলিগ্রামের ফর্ম কিভাবে পূরণ করতে হয় তাও বাবা আমাকে শিখিয়েছিলেন। ছোট বেলায় খুব বই, পেপার-পত্রিকা পড়তাম। আমাকে বলতেন, বই বা পেপারের যে কথাগুলি ভালো লাগবে তা একটি খাতায় লিখে রাখতে।

স্বাধীনতার পরে বাবা বৃহত্তর দিনাজপুর জেলার ত্রাণ পুনর্বাসন কমিটির চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করেছিলেন। সে সময়ে তাঁর ব্যবহারের জন্য একটি সরকারী জীপ দেয়া হয়। সত্য এটাই যে, তিনি ঐ জীপ ব্যক্তিগত কাজে কোন দিন ব্যবহার করেননি। দিনাজপুর শহরে সে সময় ৫/৬ জনের প্রাইভেট কার ছিল। ছোট বেলায় গাড়ীতে উঠার শখ সকলেরই থাকে। ভাই-বোনসহ মায়ের আক্ষেপ ছিল সরকারি গাড়িতে উঠতে না পারার। আত্মীয়-স্বজন, বাবার বন্ধু-বান্ধবরা মাকে এসে নানা ধরনের কথা বলতেন। মা বলতেন, ‘রহিম সাহেবকে আপনারা চেনেন না’! তবে একবার ঐ গাড়িতে চড়ে সপরিবারে আমরা ঢাকায় এসেছিলাম। সেটার পিছনেও একটি কাহিনী আছে। বাবার এক আইনজীবী বন্ধু যিনি আওয়ামীলীগেরও নেতা ছিলেন, তাঁর এক ছেলে, বয়স সে সময় বয়স ১০/১২ হবে; জন্মগত ভাবে হার্টের সমস্যা ছিল। স্বাধীনতা পরবর্তীতে সময়ে ঢাকার সাথে দিনাজপুরের যোগাযোগের মাধ্যম ছিল বিআরটিসির একটি মাত্র বাস ও ট্রেন, যা সময় রক্ষা করে চলতো না-, আবার অসম্ভব ভিড় হতো। বাবাকে অনুরোধ করলে তিনি তাঁর ঐ বন্ধুর স্ত্রী ও অসুস্থ ছেলেকে গাড়ীতে করে ঢাকায় নিয়ে আসেন। এ বিষয়টিকে আমার মায়ের কান ভারী করলেন কেউ কেউ ইচ্ছাকৃত ভাবে। আর এ কারণেই পরবর্তীতে বাবা সরকারী গাড়ীতে আমাদের সকলকে ঢাকায় নিয়ে এসেছিলেন। ঢাকায় এসে উঠেছিলাম এখন যেটা ‘গণভবন’ সেখানে, তখন সেটা ভিআইপি রেস্ট হাউস ছিল।

বাবার সব সময় ঘড়ি ধরে চলতেন। কোর্ট, মিটিং-মিছিলে সময়মত হাজির হতেন। সংবাদ পেলে যেকোনো মৃত ব্যক্তির জানাজায় উপস্থিত থাকার চেষ্টা করতেন। অনুষ্ঠানের নিমন্ত্রণ পত্রে উল্লেখিত সময়ে হাজির হয়ে অনেক সময় দেখতেন আয়োজকরাই উপস্থিত নেই। সভা-সমাবেশে নির্ধারিত সময়ে হাজির হয়ে দেখতেন, নেতা-কর্মী কেউ আসেনি। আমার একটি ঘটনা মনে পড়ে। সম্ভবত: এপ্রিল/মে, ১৯৮০ হবে। জেলা আওয়ামীলীগের উদ্যোগে দিনাজপুর গোরে শহীদ ময়দানে জনসভা আহ্বান করা হয়েছে বিকাল ৩.৩০ ঘটিকায়। তখন ছিল গ্রীষ্মকাল। প্রখর রোদ। জনসভায় যোগদানের জন্য দিনাজপুর শহরের মিশন রোড এলাকায় অবস্থিত পানি উন্নয়ন বোর্ডের রেস্ট হাউসে দুপুরে খাবার পর বিশ্রাম নেয়ার উদ্যোগ নিচ্ছিলেন আওয়ামীলীগের তৎকালীন সভাপতি আব্দুল মালেক উকিল, সাধারণ সম্পাদক আব্দুর রাজ্জাক ও সাংগঠনিক সম্পাদক তোফায়েল আহমেদ। বাবা উনাদের স্মরণ করিয়ে দিলেন যে, সোয়া তিনটায় বের হতে হবে- মিটিং ঠিক সাড়ে তিনটায় শুরু হবে। নেতৃবৃন্দ একটু অপ্রস্তুত হলেন, চেহারা দেখে বুঝতে পারলাম। আমিও সেখানে উপস্থিত ছিলাম। রাজ্জাক সাহেব শুধু বললেন, এই প্রচণ্ড রোদে জনসভায় কি লোক হবে? সে সময় জনসভার আয়োজন করতে হতো ২০/৩০ দিন আগে থেকে। জনসভার লোক আনার জন্য বাস-ট্রাক বা অন্যান্য যানবাহনের ব্যবস্থা থাকতো না, এখনকার মত। মানুষ আপন ইচ্ছায় ১০/১৫ মাইল দূর থেকে পায়ে হেঁটে আসতেন নেতাদের বক্তব্য শোনার জন্য। বাবার কারণে নেতৃবৃন্দ সাড়ে তিনটার আগেই সভামঞ্চে উঠলেন। গোরে-শহীদ, বিশাল ময়দান, প্রচণ্ড রোদ, মাঠ শূন্য খাঁ খাঁ করছিল। মঞ্চের  আশে পাশে ও দূরবর্তী  গাছের নীচে সব মিলিয়ে ১৫০/২০০ জন লোক হবে। নেতৃবৃন্দ হতাশ; কিন্তু সভায় শুরু হল ঠিক সাড়ে তিনটায়। তৎকালীন শহর আওয়ামীলীগের সভাপতি বোরহানউদ্দিন সাহেব পবিত্র কোরান এবং দুর্গা বাবুর (সাবেক এমএলএ) গীতা পাঠের মাধ্যমে। সময় গড়াতে লাগলো; ধীরে ধীরে মাঠ পরিপূর্ণ হয়ে গেল হাজার হাজার মানুষের উপস্থিতিতে। নেতৃবৃন্দ বক্তব্য রাখলেন। জনসমাগম ও মানুষের স্বতঃস্ফুর্ততায় নেতৃবৃন্দ অভিভূত ও বিস্মিত হয়ে ভুলে গিয়েছিলেন বাবার অনুরোধে প্রচণ্ড রোদে অস্বস্তিকর অবস্থায় যথাসময়ে মিটিং-এ আসার অপ্রকাশিত বিরক্তি।

বাবা খুব বেশী সামাজিকতা রক্ষা করতেন। সাপ্তাহিক ছুটির দিন সহ অন্যান্য ছুটির দিন সাধারণত: সকাল বেলা বের হয়ে ২/৩ ঘণ্টার মধ্যে ১০/২০ জন আত্মীয়-স্বজন ও স্থানীয় নিজ দলসহ অন্যান্য রাজনৈতিক দলের নেতৃত্ববৃন্দের বাড়ীতে গিয়ে বেড়িয়ে আসতেন, তাদের কুশলাদি জেনে। স্থানীয় অন্যান্য রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দের সাথে তাঁর খুব ভাল সম্পর্ক ছিল এবং তিনি নিয়মিত তাদের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করতেন এবং তাঁরাও বাবাকে আস্থা ও বিশ্বাসের মানুষ মনে করে যথেষ্ট শ্রদ্ধা করতেন। ৪৭-এর পরে দিনাজপুর শহরে তেভাগা ও ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের নেতা সংসারত্যাগী গুরুদাস তালুকদার, রুপনারায়ন, তেজেন নাগ-সহ কয়েকজন বসবাস করতেন। তাঁদের শেষ জীবনের একাকীত্বের সময় বাবা প্রায় তাঁদের খোঁজ-খবর নিতেন। বাবা ধর্ম পালন করতেন, বিভিন্ন ইসলামী ধর্ম সভায় নিয়মিত যেতেন, বক্তব্য দিতেন, কিন্তু ছিলেন অসাম্প্রদায়িক। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পরবর্তীতে সময়ে হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজনকে মাঝে মধ্যেই রাজনীতিসহ বিভিন্ন কারণে বিব্রতকর এবং নিরাপত্তাহীন অবস্থার সম্মুখীন হতে হতো। এ ধরনের পরিস্থিতি সৃষ্টি হলে বাবা কখনও একা, কখনও নিজ  দলের নেতা-কর্মীদের সঙ্গে করে তাদের পাশে দাঁড়াতেন; সাহস যোগাতেন, প্রশাসনকে সক্রিয় ও তৎপর করতে চেষ্টা করতেন।

২০০১ সালের পরে বর্তমান মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ভোট ও ভাতের অধিকার আদায়ের সংগ্রাম শুরু হলে ৭৫/৭৮ বয়সেও বাবা নিয়মিত মিছিল, মিটিং, ধর্মঘট, হরতাল কর্মসূচীতে কর্মীদের সাথে থাকতেন, উৎসাহ দিতেন। হরতালের দিন ফজরের নামাজের পরে কর্মীদের নিয়ে পিকেটিং-এ বের হতেন। রাস্তার পাশে বসে কর্মীদের সাথে পাউরুটি, বিস্কুট, মুড়ি, চা খেতেন। বয়সের কোন ক্লান্তি ছিল না।

বাবা খুব দৃঢ়চেতা ও স্পষ্টভাষী মানুষ ছিলেন। ঘুরিয়ে ফিরিয়ে বা কৌশলী কথা না বলে যে কোন বিষয়ে তাঁর মতামত স্পষ্ট করে সরাসরি প্রকাশ করতেন। যেহেতু রাজনীতি করতেন অসংখ্য মানুষ নানা প্রয়োজনে বিভিন্ন বিষয়ে ‘তদ্বির’ নিয়ে এলে যেটা সম্ভব বা করতে পারবেন সেখানে ‘হ্যাঁ’ বলতেন; আর যেটা সম্ভব নয় তা স্পষ্ট করে ‘না’ বলে দিতেন। ‘না’ শোনা মানুষগুলি অপ্রস্তুত এবং রুষ্ট হলেও বাবা নিজের অবস্থান বা সিদ্ধান্তে অনড় থাকতেন। তাঁর চারিত্রিক দৃঢ়তা ও স্পষ্টতার কারণেই হয়তোবা বঙ্গবন্ধু তাঁর সমবয়সী এবং বয়সে ছোট সহকর্মী স্বল্প যে ক’জন ব্যক্তিকে ‘আপনি’ বলে সম্বোধন করতেন, বাবা তাঁদের মধ্যে ছিলেন একজন। বঙ্গবন্ধু সাধারণত: তাঁর সমবয়সী ও বয়সে ছোট সহকর্মীদের ‘তুই’ বা ‘তুমি’ বলে সম্বোধন করতেন।

বাবা খুব অতিথিপরায়ণ মানুষ ছিলেন। ঢাকা থেকে নিজ দলের তো বটেই, অন্যান্য প্রগতিশীল রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দ বা বিশিষ্ট কোন ব্যক্তি দিনাজপুর সফরে এলে তাঁদের সাথে দেখা করে বাসায় আসার জন্য আমন্ত্রণ জানাতেন, চেষ্টা করতেন তাঁদের আপ্যায়ন করতে। বাবার আমন্ত্রণে আমাদের দিনাজপুরের বাসায় অতিথি হিসেবে পেয়েছি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সহ (১৯৬৯) জাতীয় চার নেতাদের অন্যতম ক্যাপ্টেন মুনসুর আলী ও এ এইচ এম কামরুজ্জামান, বিশিষ্ট আন্তর্জাতিক পরমাণু বিজ্ঞানী ওয়াজেদ আলী মিয়া, বিচারপতি শাহাবুদ্দিন আহমেদ (রেডক্রিসেন্ট সোসাইটির চেয়ারম্যান থাকাকালীন), বিচারপতি বি এ সিদ্দিকী (রেডক্রিসেন্ট সোসাইটির চেয়ারম্যান থাকাকালীন), বিচারপতি কে এম হাসান, বিশিষ্ট রাজনীতিবিদগণের মধ্যে আব্দুল মালেক উকিল, আব্দুস সামাদ আজাদ, মিজানুর রহমান চৌধুরী, মোল্লা জালালউদ্দিন, বেগম জোহরা তাজউদ্দিন, আবদুর রাজ্জাক, তোফায়েল আহমেদ, কমরেড মনি সিংহ, অধ্যাপক মোজাফ্ফর আহমেদ, কমরেড মোহাম্মদ ফরহাদ, মোহাম্মদ নাসিম, বেগম মতিয়া চৌধুরী, কর্নেল (অব:) শওকত আলী, আব্দুল মোমিন তালুকদার, সরদার আমজাদ হোসেন, ফজলে রাব্বী মিয়া, আব্দুল মতিন খসরু, রাশেদ খান মেনন, মিসেস আই ভি রহমান, সাহারা খাতুন, আবু সায়ইদ, শীর্ষ আইনজীবীগণের মধ্যে মির্জা গোলাম হাফিজ, শফিক আহমেদ, জমিরউদ্দিন সরকার, এম. আমিরুল ইসলাম, খন্দকার মাহবুব উদ্দিন আহমেদ, আবদুল বাসেত মজুমদার, খন্দকার মাহবুব হোসেন, মাহবুবে আলম, রোকনউদ্দিন মাহমুদ, ইউসুফ হোসেন হুমায়ুন, সৈয়দ রেজাউর রহমান সহ অনেক বিশিষ্ট ও গুণী ব্যক্তিবর্গকে।

বাবার মৃত্যুর পর মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দিনাজপুরের সর্বস্তরের মানুষের অভিপ্রায়ের প্রেক্ষিতে দিনাজপুর মেডিকেল কলেজটির নাম ‘এম. আব্দুর রহিম মেডিকেল কলেজ’ এবং মরণোত্তর স্বাধীনতা পদক প্রদান করায় তাঁর প্রতি দিনাজপুরবাসী এবং আমাদের পরিবার কৃতজ্ঞ।

বাবা খসড়া সংবিধান প্রণয়নে ভূমিকা রেখেছিলেন; মুল সংবিধানে স্বাক্ষর করেছেন। বিচারপতি হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের সময় শপথ নিয়েছি- ‘সংবিধান ও আইনের রক্ষণ, সমর্থন ও নিরাপত্তা বিধান’ এবং ‘ভীতি বা অনুগ্রহ, অনুরাগ বা বিরাগের বশবর্তী না হয়ে সকলের প্রতি আইন-অনুযায়ী যথাবিহিত আচরণ’ করার। সংবিধান হাতে নিলে প্রতিটি শব্দে, বাক্যে, অনুচ্ছেদে বাবার স্পর্শ-অস্তিত্ব অনুভব করি। এ অনুভূতি যেমন প্রচণ্ড আবেগ সৃষ্টি করে, তেমনি সংবিধান রক্ষা এবং শপথ অনুযায়ী বিচার করার কঠিন দায়িত্ব ও কর্তব্যটিও স্মরণ করিয়ে দেয়। বর্তমানে বাবার স্মৃতি ও কর্ম আমার পথ চলার প্রেরণা।

 

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন