বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

রাজনীতি বিষয়ে চাই নতুন চিন্তা

আপডেট : ২২ সেপ্টেম্বর ২০২০, ০৯:৪৪

নোয়াম চমস্কি একজন প্রতিবাদী দার্শনিক। তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে পৃথিবীর যে কোনো রাষ্ট্রে বড় কোনো অন্যায় ঘটলে তার তীব্র প্রতিবাদ করেন। তার প্রতিবাদ প্রচারমাধ্যমে প্রচারিত হয়। তার পরও বলতে হয় যতটা প্রচার তার পাওয়ার কথা, সে তুলনায় তিনি কম পান। আমি অনুসন্ধান করতে গিয়ে দেখলাম, তিনি আত্মপরিচয় দেন নিরাষ্ট্রবাদী বলে। তার একটি বই আছে ‘Anarcho-Syndicalism’ নামে। তাছাড়াও আরো কোনো কোনো বইতে তিনি নিজেকে anarchist বলে পরিচয় দেন। তিনি তার লেখায় বাকুমিনের লেখা থেকে উদ্ধৃতি দেন। বাকুমিন, প্রুধোঁ প্রমুখ দার্শনিক নিরাষ্ট্রবাদ (anarchism) প্রচার করেছেন উনিশের শতকের মধ্যপর্ব থেকে। তাদের প্রচারিত নিরাষ্ট্রবাদ ইউটোপিয়া বা অবাস্তব চিন্তা বলে সমালোচিত হয়েছে। তারা সরকারবিহীন, কর্তৃপক্ষবিহীন স্বতঃস্ফূর্ত সহযোগিতার ওপর প্রতিষ্ঠিত সমাজ চেয়েছেন। তারা শোষণপীড়ন প্রতারণামুক্ত সমাজের চিন্তা করেছেন। তাদের ঐসব চিন্তা অবান্তর কল্পনা বলে বিরোধিতার মুখে পড়েছে।

চমস্কি কিন্তু শতাব্দীর ব্যবধানে তাদের চিন্তাকে পরম মূল্যবান বলে মনে করেছেন এবং প্রচার চালিয়েছেন। আমার মনে হয়, চমস্কির এই দর্শন সাংবাদিককেরা গ্রহণযোগ্য মনে করবে না। চমস্কির লেখায় আছে, ‘আমি এখন পর্যন্ত রাজনীতির ইতিহাসে এমন রাষ্ট্র দেখি নাই, যা মানুষের উপকার করেছে।’ সেই থেকে তিনি রাষ্ট্রবিহীন সমাজের চিন্তা করেছেন। গত ১৫০ বছরের মধ্যে এমন চিন্তা আরো কেউ কেউ করেছেন। এই চিন্তারই এক ধারা নিরাষ্ট্রবাদী। আর এই ধারা উন্নত চরিত্রের রাষ্ট্র গঠনের দিকে অগ্রসর হওয়ার কথা বলেছে। প্রাচীন গ্রিক দর্শনে বলা হয়েছে, State is necessary evil। এরা আশা করেছেন, মানুষ ক্রমাগত নৈতিক দিক দিয়ে উন্নত হবে। মানুষের সৃষ্ট রাষ্ট্রও ক্রমাগত উন্নত হবে। পৃথিবীতে মানুষের জীবনযাপনের শ্রেষ্ঠ উপায় কী, এই প্রশ্নের উত্তরে তারা আদর্শ রাষ্ট্রের কথা ভেবেছেন। প্লেটো এই চিন্তা থেকেই রিপাবলিক রচনা করেছেন।

বাংলাদেশের প্রায় ৫০ বছরের সরকারগুলোর ইতিহাস দেখলে চমস্কি তার নিরাষ্ট্রবাদের পক্ষে অনেক যুক্তি পাবেন। তিনি সিদ্ধান্ত দেবেন, বাংলাদেশকে নিরাষ্ট্রবাদের ধারায় অগ্রসর হওয়া উচিত। কিন্তু বাংলাদেশে আমরা নিরাষ্ট্রবাদ চাইতে পারি?

বিশ্বায়ন যারা প্রচার করেছেন, তারা গণতন্ত্রের নাম দিয়েছেন লিবারেল ডেমোক্রেসি। তাদের আর্থসামাজিক নিও-চিন্তা, নিও-লিবারেলিজম বা নব্য-উদারতাবাদ বলে অভিহিত হয়। এই অবস্থার মধ্যে বাংলাদেশের শাসক শ্রেণির লোকেরা সরকারি ও বিরোধীদলীয় লোকেরা—এখন রাষ্ট্র গঠনে মনোযোগী নন। রাষ্ট্র গঠনের জন্য জাতি গঠন করতে হয়। বাঙালি জাতীয়তাবাদ কিংবা বাংলাদেশি কোনোটা নিয়েই এখন কোনো চিন্তা নেই। বাংলাদেশের জনগণের ওপরও তাদের আস্থা নেই। ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য কিংবা ক্ষমতায় থাকার জন্য তারা বৃহত্ শক্তিবর্গের স্থানীয় দূতাবাসগুলোর কূটনীতিকদের সঙ্গে পরামর্শ করতে যান। আরো অনেক ব্যাপার আছে, যেগুলো শাসকশ্রেণির ক্ষমতাসীন ও ক্ষমতাবহির্ভূত সকলেই করে থাকেন। এতে বাংলাদেশের রাষ্ট্র হয়ে ওঠার সম্ভাবনা নষ্ট হয়ে যায়। গণতন্ত্র বলতে তারা কেবল নির্বাচিত সরকার দিয়ে দেশ শাসন বুঝিয়ে থাকেন। দূতাবাসনির্ভর এই রাজনীতিতে সরকার ও রাজনৈতিক দলগুলো জাতীয় সংসদের একটি নির্বাচনও করতে পারে না। নির্বাচন কমিশনকে তারা বিতর্কিত করে ফেলেছেন। বিতর্কিত নির্বাচন কমিশন নিয়ে কোনো রাষ্ট্রে নির্বাচন হতে পারে? ধর্মনিরপেক্ষতা ও রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম নিয়ে বিতর্ক, তার মধ্যে নির্বাচন স্বাভাবিক হওয়ার কোনো সম্ভাবনা আছে? বাংলাদেশে গণতন্ত্র নেই, সমাজতন্ত্র নেই, জাতীয়তাবাদ ও তার সম্পূরক আন্তর্জাতিকতাবাদ নেই, ভালো রাষ্ট্র গঠনের কোনো চেষ্টা নেই। দুর্নীতি ক্রমাগত বাড়ছে। এই করোনা ভাইরাস কালেও দুর্নীতির ও অনাচারের এবং অসামাজিক কার্যকলাপের কোনো কমতি নেই। দুর্নীতি দমন কমিশন দুর্নীতিবাজদের ধরছে, বিচারের মুখোমুখি করছে। তাতে কারো কারো কারাদণ্ড হচ্ছে। দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দুর্নীতি কমাতে পারছে না। যে দলই ক্ষমতায় আসুক, ক্ষমতাসীন দলের লোকেরাই সমাজের স্তরে স্তরে দৌরাত্ম্য করে। ক্ষমতাসীন দলের লোক বলে পরিচয় দিয়ে দুর্নীতির সুযোগ নেয়। জাতীয় সংসদের নির্বাচনের অবস্থা সকলেই জানেন। আসলে বাংলাদেশে চলছে বংশানুক্রমিক উত্তরাধিকারভিত্তিক নেতৃত্ব। ইউনিয়ন পরিষদ থেকে সর্বোচ্চ পর্যায় মন্ত্রিপরিষদ পর্যন্ত সর্বত্রই বংশানুক্রমিক নেতৃত্ব চালু হয়ে গেছে। মানুষ অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করছে। দেশে বিদেশে অনেক টাকা আয় হচ্ছে। বিদেশে টাকা পাচার হয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশ বিশ্বব্যাংকের হিসাব অনুযায়ী অর্থনৈতিক উন্নতি করে চলছে। কিন্তু মানবিক সব দিক দিয়েই দুর্গত। আর্থিক সমৃদ্ধির মধ্যেও মানবিক সব দিকেই দেখা যাচ্ছে দুর্বলতা ক্রমাগত বাড়ছে। এই অস্বাভাবিক রাজনৈতিক বাস্তবতায় স্বাভাবিকভাবেই মানুষের জীবন স্বাভাবিক ও সুস্থ নেই। সুস্থতা ও স্বাভাবিকতা অর্জনের জন্য প্রয়োজন রাজনীতি নিয়ে নতুন চিন্তা ও কাজ। আধো আধো চিন্তা দিয়ে হবে না, দরকার গভীর ও ব্যাপক চিন্তা। শুধু চিন্তা দিয়েও হবে না, চিন্তার সঙ্গে সঙ্গে কাজ দরকার। বাংলাদেশের প্রধান ও অপ্রধান সব দলের মধ্যেই জনসম্পৃক্ত চিন্তা ও কাজের প্রয়োজন। গুরুত্বপূর্ণ প্রতি ক্ষেত্রেই নতুন চিন্তা ও নতুন কাজ দরকার। বাংলাদেশকে বাংলাদেশের জনগণের স্বাধীন রাষ্ট্ররূপে গড়ে তুলতে হবে। এর জন্য যা-কিছু করা দরকার, সবই করতে হবে। কথিত উদার গণতন্ত্র নয়, প্রতিষ্ঠা করতে হবে সর্বজনীন গণতন্ত্র। সর্বজনীন গণতন্ত্র নিয়ে নতুন চিন্তা দরকার। গণতন্ত্রের জন্য দলভিত্তিক আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বের সরকার গঠন করতে হবে। যেসব সমস্যা জাতীয় জীবনকে পঙ্গু করে রেখেছে, সেগুলো পর্যায়ক্রমে দূর করতে হবে। এসবের জন্য নতুন রাজনীতি দরকার। নতুন রাজনীতির জন্য দরকার নতুন অনুকূল রাজনৈতিক দল। আওয়ামী লীগ, বিএনপি চাইলে তাদের দলের রাজনৈতিক চরিত্র উন্নত করতে পারে। আধুনিক রাষ্ট্রে সরকার গঠিত হয় রাজনৈতিক দল দিয়ে। রাজনৈতিক দলও অবশ্যই আধুনিক রাষ্ট্রের অপরিহার্য উপাদান। বর্তমান বাংলাদেশে যে ধরনের রাজনৈতিক দল আছে তাদের কোনোটি দিয়েই বাংলাদেশের রাজনীতির অভিপ্রেত উন্নতি হবে না। জনসাধারণকে জাগাতে হবে। তার জন্য জনগণের মধ্যে মানবিক গুণাবলির স্ফুরণ ঘটাতে হবে। উন্নত চরিত্রের মহান নেতৃত্ব সৃষ্টি করতে হবে। সবই সম্ভব। মানুষের মধ্যে পারস্পরিক সহযোগিতা-সম্প্রীতি দরকার। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে পারস্পরিক সহযোগিতা ও সম্প্রীতি দরকার। দরকার পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ ও জাতীয় চেতনা। এই লক্ষ্যে পরিচালিত একটি মাসিক, অন্তত একটি ত্রৈমাসিক পত্রিকা দরকার। এ ধারায় অগ্রসর হতে হলে প্রথম পর্যায়ে প্রতিকূলতা খুব বেশি থাকবে। অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে শান্তিপূর্ণ উপায়ে কাজ চালাতে হবে। প্রথমে দরকার চিন্তাগত বা বৌদ্ধিক (intelectual) আন্দোলন। আন্দোলনের জন্য প্রচারমাধ্যম দরকার। জনমত তৈরি করা গেলে এবং নেতৃত্ব সৃষ্টি করা গেলে, সব কাজই সম্ভব হবে। জনগণ ঘুমিয়ে থাকলে হবে না, জাগাতে হবে। জনগণের মধ্যকার মানবিক গুণাবলি, জাগ্রত করতে হবে। যে রকম চলছে সেরকম থাকবে না। গতানুগতিক ধারায় অবস্থা ক্রমেই খারাপ থেকে খারাপতর হবে। আমরা চাই অবস্থার উন্নতি। তার জন্য নতুন ধারার চিন্তা ও কাজ দরকার। নতুনত্বের সূচনা হবে রাজনৈতিক দলের ভেতর থেকে। উন্নত চরিত্রের রাজনৈতিক দল গঠনে এখন কেন্দ্রীয় গুরুত্ব দেওয়া দরকার।

লেখক: বিশিষ্ট চিন্তাবিদ ও সাবেক অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

 

ইত্তেফাক/জেডএইচডি

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন