বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

বিশ্ব পর্যটনদিবস ২০২০

কোভিড-১৯ পরবর্তী পর্যটন: বাংলাদেশের অর্থনীতির সেরা পেনাল্টি শুট..

আপডেট : ২৮ সেপ্টেম্বর ২০২০, ০০:১৮

কোভিড-১৯ বিশ্বকে বদলে দিয়েছে। এই বদল হওয়া অব্যাহত থাকবে দীর্ঘসময় ধরে। স্বাভাবিকভাবেই বিশ্ব-পর্যটনেও এর প্রভাব অনস্বীকার্য। তবে তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হচ্ছে কোভিড-১৯ পরবর্তী বিশ্বে ৫টি খাত ব্যাপকভাবে এবং বহুমাত্রিকতা নিয়ে আবির্ভূত হবে এবং অর্থনীতি ও সমাজজীবনে গতির সঞ্চার করবে। উল্লেখিত ৫টি খাতের একটি হচ্ছে ডোমেস্টিক ট্যুরিজম বা অভ্যন্তরীণ পর্যটন। এখানে হাতেগোনা যে দেশগুলোর সফল হওয়ার সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি তারমধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম বলে আভাস পাওয়া যাচ্ছে। সম্প্রতি জাতিসংঘ মহাসচিবও তার বিশেষ বার্তায় বলেছেন পর্যটন হবে কোভিড-১৯ পরবর্তী বিশ্বে ঘুরে দাঁড়ানোর অন্যতম প্রধান হাতিয়ার। উল্লেখ্য পর্যটনের মাধ্যমে সাফল্যলাভের সম্ভাবনাময় সফল দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম হওয়ার কারণ বহুবিধ। পর্যটন সম্ভাবনা বিবেচনায় বাংলাদেশকে বলা হয় ‘ইউনিক ডেল্টা অফ সেভেন টিএ  (7TA or Seven Tourist Attractions)। এই সেভেন টিএ হচ্ছে নদী, সমুদ্র, পাহাড়, বন, ইতিহাস-ঐতিহ্য-সংস্কৃতি, ঋতু বৈচিত্র্য এবং আতিথেয়তা। অর্থাৎ কোনো স্থানে বা কোনো দেশে এই সেভেন টিএ-এর একটি যদি উপস্থিত থাকে পর্যটনের জন্য তাকে বলা হয়  GOOD, যদি দুইটি থাকে তাকে বলা হয়  BETTER , আর যদি দুইয়ের অধিক থাকে তবে বলা হয় BEST। সেই বিচারে বাংলাদেশের অবস্থান হচ্ছে  BEST +++।  

উপরন্তু বিভিন্ন গবেষণা এবং পরিসংখ্যান বলছে পোস্ট কোভিড-১৯ পৃথিবীতে ১৮-২৪ মাস (সম্ভাব্য ডিসেম্বর ২০২২ সাল পর্যন্ত) সাধারণভাবে কেউ ছুটি কাটাতে বা পারিবারিক অবসর সময় উপভোগ করতে কিংবা যেকোনো প্রকার হলিডে মেকিং করবার জন্য ১০০ থেকে ৩০০ মাইল বা ১৬১কি.মি থেকে ৪৮২কি.মি দূরত্বের ভ্রমণকে প্রথম পছন্দরূপে অগ্রাধিকার দেবেন। ফলে অভ্যন্তরীণ পর্যটন আরও ব্যাপকভাবে বেগবান হবে। ২০১৯ সালে বাংলাদেশ টুরিস্ট পুলিশের হিসাব অনুযায়ী দেশে ডোমেস্টিক টুরিস্টের সংখ্যা ছিলো ১ কোটি ৫৭ লক্ষ। বিভিন্ন সূত্রের তথ্যানুযায়ী এই পর্যটকদের গড় খরচের পরিমাণ ছিলো ৫-১২ হাজার টাকা। একইসময়ে প্রতি বছর বাংলাদেশ থেকে তাৎপর্যপূর্ণ সংখ্যক পর্যটক নানা কারণে বিদেশ ভ্রমণ করেন; যারমধ্যে ভারতে যান প্রায় ২.৯ মিলিয়ন বা ২৯ লক্ষ বাংলাদেশি পর্যটক, থাইল্যান্ডে যান ৬লক্ষ, মালয়েশিয়া ভ্রমণ করেন প্রায় ৩লক্ষ, সিঙ্গাপুর যান ২লক্ষ, এছাড়াও মধ্যপ্রাচ্যের আরব আমিরাত, কাতার, ওমান, সৌদি আরবসহ ইউরোপ, আমেরিকা এবং অস্ট্রেলিয়া ভ্রমণ করেন আরও ৫.৫ লক্ষ মানুষ। অর্থাৎ প্রায় ৪৬ লক্ষ বাংলাদেশি পর্যটক ফি বছর বিদেশে যান। একইসাথে উল্লেখ্য যে, প্রতিবছর শুধুমাত্র মার্কিন যুক্তরাজ্য থেকে সিলেটে আসেন ১.৫লক্ষ বাংলাদেশি ব্রিটিশ নাগরিক এবং তারা সম্পদশালী, পৃথিবীর নানাপ্রান্ত থেকে বিয়ে, উৎসব, পারিবারিক ছুটি কাটাতে দেশে ফেরেন আরও ২মিলিয়ন বা ২০লক্ষেরও বেশি প্রবাসী, এবং এদের বড় অংশই বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের ‘লয়াল’ যাত্রী।

বাংলাদেশের পর্যটন সম্পর্কে প্রয়োজনীয় তথ্যের অভাব, দুর্বল প্রচারের কারণে উল্লেখিত প্রবাসীদের একটি বড় অংশ পারিবারিক ভ্রমণে (বোনাস হিসাবে মেডিকাল চেকআপ), বিয়ে পরবর্তী হানিমুন উদযাপন কিংবা অবসর উপভোগ করতে পার্শ্ববর্তী দেশসমূহে ভ্রমণে চলে যান। এরা সেখানে মোটাদাগে খরচ করেন, প্লেনে উঠেন, স্টার হোটেলে থাকেন, ভালো খাবার খান, উপহার কেনেন। কোভিড-১৯ পরবর্তী ২৪ মাস পর্যন্ত এই তাৎপর্যপূর্ণ পর্যটকগোষ্ঠি স্বাভাবিকভাবেই ছুটি কাটাতে বিদেশে যাবেন না, আবার লকডাউনের কারণে তারা দীর্ঘদিন ঘরবন্দি থেকে ক্লান্ত, উন্মুখ অপেক্ষায় আছেন সুবিধামতো সময়ে পরিবার নিয়ে ভ্রমণে বেরিয়ে যাবার জন্য। এক্ষেত্রে এই বিশাল শক্তিশালী পর্যটকদের কাছে একমাত্র বিকল্প গন্তব্য হচ্ছে অপরূপ ব-দ্বীপের বহু বৈচিত্র্যে ভরপুর বাংলাদেশের বিভিন্ন জায়গা ও কেন্দ্র। জাতিসংঘের পর্যটনবিষয়ক অঙ্গসংগঠন ইউএনডব্লিউটিও ইতোমধ্যে আভাস দিয়েছে বিশ্বে অচিরেই ‘ডোমেস্টিক পর্যটন ট্র্যাফিক’ সৃষ্টি হবে। সর্বসম্প্রতি অক্সফোর্ড ইকোনোমিকস এর রিসার্চ রিপোর্টে বলা হয়েছে কোভিড-১৯ প্রেক্ষাপটে আন্তর্জাতিক পর্যটন ২০১৯ এর অবস্থানে ফিরতে বিশ্বকে অপেক্ষা করতে হবে ২০২৪ সাল পর্যন্ত। অর্থাৎ সার্বিক বিচার বিশ্লেষণে এটা নিশ্চিত লোকাল ট্যুরিজম নজিরবিহীনভাবে গতিশীল হবে।

পর্যটন বা ট্যুরিজম আজকের পৃথিবীতে একক বৃহত্তম শিল্প হিসাবে স্বীকৃত। পৃথিবীর পরীক্ষিত, প্রমাণিত এবং প্রতিষ্ঠিত পরিসংখ্যান বলছে পর্যটন ১০৯টি শিল্পকে সরাসরি প্রভাবিত করে, চালিত করে, প্রসারিত করে। একজন পর্যটক বা টুরিস্ট যখন কোথাও যান তিনি যাতায়াতের জন্য যানবাহন ব্যবহার করেন, প্লেনে উঠেন, হোটেলে থাকেন, চাল-ডাল-রুটি-তেল-নুন-চিকেন-এগ-মিল্কসহ নানাকিছু আহার করেন, স্থানীয় পণ্য কেনাকাটা করেন; অর্থাৎ একজন টুরিস্টের আগমনের ফলে অনেকগুলো ভোগ, উপভোগের সাথে সাথে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড সম্পাদন হয়। পরিবহনে তিনি অর্থ ব্যয় করেন। হোটেলে সাবান-শ্যাম্পু-টাওয়েল-বেডশিট, চিরুনি, কটন বাডস, কাপ-পিরিচ, গ্লাস, টিসু, বাস্কেট, বিদ্যুৎ-পানি-গ্যাস ইত্যাদি ব্যবহার করেন। নানারকম খাদ্য উপভোগ করেন। ফিরে যাওয়ার আগে বিভিন্ন প্রকার উপহার সামগ্রী ক্রয় করেন। এসকল কার্যক্রমের ফলে যাতায়াতের সাথে যুক্ত কোম্পানি, হোটেল, স্থানীয় ব্যবসায় ও সেবা প্রতিষ্ঠানগুলো সরাসরিভাবে ব্যবসা করতে পারছে। আবার সাবান-শ্যাম্পু-টুথপেস্ট ফ্যাক্টরি বা টাওয়াল-বেডশিট ইত্যাদির সাথে যুক্ত উৎপাদক, কর্মী, সরবরাহকারিসহ সংশ্লিষ্টরাও পরোক্ষভাবে উপকৃত হচ্ছেন। অর্থাৎ একজন টুরিস্টের আগমন ও উপস্থিতি কৃষি, পোলট্রিসহ নানাবিধ শিল্প উৎপাদনে অন্যতম সহায়ক ভূমিকা রাখে। একইসাথে জাতীয় অর্থনীতির অগ্রযাত্রায় অন্তর্ভুক্ত হয়ে দেশের উন্নতি ও মানুষের জীবনযাত্রার মানোন্নয়নেও তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা রাখে। ব্যাংকসহ আর্থিকখাতে গতির সঞ্চার হয়।

পৃথিবীতে চলমান নানা দুর্যোগ এবং অর্থনৈতিক বিপত্তির কারণে বহু মানুষ কর্মহীন হওয়ার পরেও পর্যটনক্ষেত্রে প্রতি আড়াই সেকেন্ডে একটি করে কর্মসংস্থান সৃষ্টি হতে যাচ্ছে। একজন পর্যটকের আগমনে সেবাখাতে ১১জন মানুষের সরাসরি কর্মসংস্থান হয়। পরোক্ষভাবে কাজ পান আরো ৩৩ জন। অর্থাৎ ১ লক্ষ পর্যটকের আগমনের সাথে ১১ লক্ষ কর্মসংস্থান যুক্ত। কোনো স্থানে যদি ১০ লাখ নিয়মিত অভ্যন্তরীণ বা আন্তর্জাতিক পর্যটক থাকে সেখানে স্থায়ী কর্মসংস্থান হয় ১ কোটি ১০ লাখ লোকের। ১৭কোটি মানুষের বাংলাদেশে এটি আরো ব্যাপকভাবে হতে পারে। কারণ এই জনগোষ্ঠীর ৬০ ভাগ হচ্ছে তরুণ। সম্প্রতি বিশ্ববিখ্যাত ফোর্বস ম্যাগাজিন এই সংক্রান্ত একটি রিপোর্ট প্রকাশ করেছে। সেখানে ২০১৯ সালে পর্যটনক্ষেত্রে কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে শীর্ষ দশটি দেশের তালিকা প্রকাশ করেছে, যেখানে ভারত, পাকিস্তানকে পেছনে ফেলে বাংলাদেশের অবস্থান প্রথম।  সুতরাং পোস্ট কোভিড-১৯ মোকাবেলায় পর্যটনের এই অপার সম্ভাবনা হচ্ছে সত্যিকারভাবেই বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য ‘পেনাল্টি শুট’।

ফুটবল খেলায় ‘পেনাল্টি শুট’ পাওয়া জয়লাভের জন্য যেমন বড় সুযোগ, বাংলাদেশের সামগ্রিক প্রেক্ষাপটে কোভিড-১৯ ক্রাইসিস ‘পেনাল্টি শুট’ অপরচুনিটি হিসাবে আমাদের দুয়ারে অপেক্ষমাণ। এই অমূল্য পেনাল্টি শুটে গোল করবার নেতৃত্বদানকারী শুটার হচ্ছে সরকারের বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়। তবে এই ধরনের শুট-এ গোল করবার জন্য কুশলী খেলোয়াড় হওয়াই যথেষ্ট নয়, কৌশলী খেলা উপহার দেওয়ার মতো সাহস ও সৃজনশীল পারদর্শিতা থাকাও অপরিহার্য। পরিস্থিতি এবং স্থান-কাল-পাত্রভেদে নিত্যনতুন ট্যাকটিস এবং প্রাকটিস প্রয়োগ করার মতো ‘ওনশিপ’ নেতৃত্বদক্ষতা ও উদ্যোগ না থাকলে এখানে কাঙ্ক্ষিত সাফল্য অর্জন করা নিশ্চিতভাবেই কঠিন হবে, যেটা স্বাধীনতা পরবর্তী ৪৯ বছর ধরে ঘটে আসছে দুর্ভাগ্যজনকভাবে। তবে আশা ও আকাঙ্ক্ষার বিষয় হচ্ছে সেই অবস্থার বদল ঘটবার ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে। উদ্যোগ শুরু হয়েছে। সার্বিক অবস্থা বিবেচনায় কোভিড-১৯ পরবর্তী বিশ্বে বাংলাদেশের পর্যটনের জন্য সেরা পেনাল্টি শুটকে সফল করবার জন্য সুনির্দিষ্ট কিছু কার্যকর উদ্যোগের বিকল্প নেই। সেই কাজগুলো সফলতার সাথে সম্পন্ন করা গেলে শুধু অভ্যন্তরীণ পর্যটন সাফল্যই অর্জিত হবেনা, বাংলাদেশে আন্তর্জাতিক পর্যটনের জন্য পথ বা ক্ষেত্র তৈরি ও সুগম হয়ে যাবে। জাতিরজনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের শততম জন্মবার্ষিকী ‘মুজিববর্ষ’ উদযাপনের অংশ হিসাবে এবং বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলার স্বপ্ন-পূরণের যাত্রায় এটি হবে অতুলনীয় ও অনিবার্য একটি দায়িত্ব সম্পন্ন করা। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য ওয়ার্ল্ড ইকোনোমিক ফোরামের ২০১৯ সালের সর্বশেষ ট্যুরিজম কম্পিটিটিভ রিপোর্ট অনুযায়ী বাংলাদেশ আগের বছরের তুলনায় পর্যটনবান্ধব দেশ হিসাবে পাঁচ ধাপ এগিয়ে ১২০তম স্থানে উন্নীত হয়েছে। বিশ্বের ১৪০টি দেশের মধ্যে ২০১৮ সালে অবস্থান ছিলো ১২৫তম। উপরন্তু ২০১৩ সালে দেশে টুরিস্ট পুলিশের কার্যক্রম শুরু হয়। গত পাঁচ বছরে প্রতিষ্ঠানটির কার্যকর উদ্যোগ ও ভূমিকার ফলে বিশে^র ১৪৭টি দেশের মধ্যে নিরাপত্তা ও সুরক্ষা পর্যটনখাতে বাংলাদেশ ১৮ধাপ এগিয়েছে, ১২৩তম অবস্থান থেকে ১০৫তম স্থানে এসেছে।

বাংলাদেশ আগামী বছর তার পঞ্চাশতম জন্মবার্ষিকীর দ্বারপ্রান্তে। সাম্প্রতিককালে কানাডা, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুরসহ পৃথিবীর প্রায় অধিকাংশ দেশই তাদের ৫০, ১০০ বা ১৫০তম জন্মবার্ষিকী উদযাপন করেছে পর্যটনবর্ষ ঘোষণার মাধ্যমে। বাংলাদেশ সরকারও নীতিগতভাবে দেশের ৫০তম জন্মবার্ষিকীকে পর্যটনবর্ষ হিসাবে উদযাপনের জন্য ঘোষণা দিয়েছে গত ফেব্রুয়ারি মাসে। কোভিড-১৯ এর ফলে সেই অবস্থানে কোনো ব্যত্যয় ঘটেনি বলে ইতোমধ্যেই মন্ত্রণালয় গণমাধ্যমকে নিশ্চিত করেছে। এটি নিঃসন্দেহে খুবই আশার কথা। ২৭ সেপ্টেম্বর ২০২০ সালের আসন্ন বিশ্ব-পর্যটন দিবসে এই বিষয়ে আরও বিস্তারিত ঘোষণা আসবে বলে আশা করা হচ্ছে।

গত প্রায় তিনদশক ধরে বাংলাদেশের পর্যটনের একজন ঘনিষ্ঠ অবজারভার, একজন প্রফেশনাল এবং একজন এজন্য একাডেমিক হিসাবে কিছু জিজ্ঞাসার সম্মুখীন হতে হয়; তারমধ্যে অন্যতম দুটি প্রশ্ন হলো এক. বাংলাদেশে দেখবার মতো কী আছে? আর দুই. এত সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও গত ৪৯ বছরেও পর্যটন কেনো কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছায়নি?

বাংলাদেশে দেখবার কী আছে?

আমি খুব সংক্ষেপে যদি একটি ধারণা দিতে চাই তাহলে সহজেই বলা যায় ছোট্ট এই বাংলাদেশে রূপ-রস-গন্ধে ভরা যে বহু বৈচিত্র্যময় পর্যটনআকর্ষণ বা গন্তব্য রয়েছে তার সংখ্যা ১,৭০০+ বা এক হাজার সাতশ’রও বেশি। শুধুমাত্র ইতিহাস-ঐতিহ্য-সংস্কৃতি বিষয়ক পর্যটন আকর্ষণ সংখ্যা ৫০৩টির বেশি। দেশব্যাপী রয়েছে ১৩৫টিরও বেশি জাদুঘর বা মিউজিয়াম। ভিন্ন বৈশিষ্ট্যময় সমুদ্র সৈকত বা si বীচ রয়েছে ১৯টি। জলকেন্দ্রিক পর্যটন আকর্ষণ যারমধ্যে পৃথিবীর অদ্বিতীয় হাওরও রয়েছে, এমন বিষয় ১৩৭টিরও অধিক। বৈশিষ্ট্যময় পাহাড়-টিলা বা হিল-মাউন্টেইন রয়েছে ৪৯টির অধিক। পৃথিবীতে খুবই অল্পসংখ্যক সোয়াম্প ফরেস্ট বা জলাবনের একটি রয়েছে রাতারগুলে, যেটিকে সিলেটের সুন্দরবনও বলা হয়। ৬৫টিরও বেশি বিশেষায়িত গ্রাম রয়েছে দেশজুড়ে।

উল্লেখ্য ২০২০ সালে বিশ্বপর্যটন দিবসকে ‘গ্রামীণ উন্নয়নের বছর’ হিসাবে মনোনীত করেছে জাতিসংঘের পর্যটন বিষয়ক অঙ্গসংস্থা ইউএনডব্লিউটিও। বিশ্বের সর্ববৃহৎ ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট সুন্দরবন, ষাটগম্বুজ মসজিদ, পাহাড়পুর, মহাস্থানগড়সহ রয়েছে বেশ কয়েকটি স্থাপনা যা ইউনেস্কোর বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ। আছে ইউনেস্কোর ইনট্যানজিবল কালচারাল হেরিটেজ অফ হিউমানিটি পহেলা বৈশাখ। বিশ্ব-স্বীকৃত এবং জাতিসংঘ ঘোষিত পৃথিবীর অদ্বিতীয় আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। আছে ৭৫টিরও বেশি বহুমাত্রিক উৎসব ও আয়োজন (ইভেন্টস)। এছাড়াও মনকে ছুঁয়ে যাওয়া অকৃত্রিম আতিথেয়তাসহ আনরেকর্ডেড আরও বহুকিছু রয়েছে অপরূপ এই বাংলাদেশে।

এখন প্রশ্ন হতে পারে বিশ্বপর্যটন গন্তব্যের বিচারে এগুলোর মান বা অবস্থান কী বা কী হতে পারে?

এক্ষেত্রে দীর্ঘসময়ের বহু বৈচিত্র্যময় ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতাগুলো ভাগাভাগি করা যেতে পরে। কক্সবাজার, পতেঙ্গা এবং কুয়াকাটা ছাড়া আমাদের অন্য ১৬টি সমুদ্র সৈকত সত্যিকারভাবে এখনও অনাঘ্রাত রয়ে গেছে। এবং এগুলো ভিন্ন-ভিন্ন বৈশিষ্ট্যময়। পৃথিবীতে কোনো একটি স্থানে তা বিরল। কক্সবাজারে রোহিঙ্গাদের জন্য চলমান মালয়েশিয়া ফিল্ড হাসপাতালের পরিচালক পদে কিছুদিন আগে দায়িত্ব পালন করে গেছেন এক মালে চিকিৎসক ডা. শামসুল। তিনি যুক্তরাষ্ট্রের মিয়ামি, দক্ষিণ আফ্রিকা, সাউথ কোরিয়াসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে কাজ করেছেন। অতি সম্প্রতি এক সাক্ষাতকারে তিনি আমাকে বলেছেন বাংলাদেশের কক্সবাজারের যে নিরবচ্ছিন্ন সমুদ্র সৈকত তিনি উপভোগ করেছেন, আমেরিকার মিয়ামি বীচের চেয়েও সেটি তাকে বেশি মুগ্ধ করেছে। অস্ট্রেলিয়ার বিখ্যাত কিয়ামা বীচে অনেকেই গেছেন। পৃথিবীময় সমুদ্র সৈকতে সাধারণত ঢেউয়ের মিছিল গর্জন করতে করতে তীরে আছড়ে এসে পড়ে। মানুষ সেই ঢেউয়ের সাথে কেলি করে। ঝাপাঝাপি করে। সমুদ্রস্নান করে। কিন্তু কিয়ামা বীচের ঢেউ আছড়েও আসে না, গর্জনও করে না। সেখানে সমুদ্রের জল নাচতে নাচতে তীরে আসে, তীরে এসে চুমু খায়, চুমু খেয়ে আবার চলে যায়। দিনভর মানুষ সমুদ্রতীরে বসে ফিশ এন্ড চিপস খায় এবং নৃত্যরত সমুদ্রজলের তীরে আসা এবং চুমু খাওয়া উপভোগ করে।

আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে বাংলাদেশের চট্টগ্রামের কাট্টলি সমুদ্র সৈকতের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে অস্ট্রেলিয়ার কীয়ামা বীচের মতো। একইভাবে গুলিয়াখালির সবুজগুচ্ছের ভেতর দিয়ে নেমে যাওয়া সমুদ্রের আরেক রূপ যেকোনো পর্যটককে বিস্মিত করবে। পারকি বা সাতক্ষীরার মান্দারবাড়িয়া, কিংবা খুলনার কটকা, করমজল বা বরগুনার লালদিয়া সমুদ্র সৈকতের বৈশিষ্ট্য ভিন্ন। যারা স্পেনের বিলবাও বা সান সিবাস্তিয়ান ভ্রমণ করেছেন তারা অনায়াসে বুঝবেন বাংলাদেশের সাজেক ভ্যালি হচ্ছে স্প্যানিশ বিলবাও ইন বাংলাদেশ। একইভাবে কাপ্তাইয়ের পলওয়েল পার্কের তুলনা চলে সুইজারল্যান্ডের জুরিখ পার্কের সাথে। ভরা বর্ষায় সুপ্তসুর ঝরনার রূপ যারা দেখেছেন চোখ বুজে তারা বলবেন এটি বাংলাদেশের নায়াগ্রা জলপ্রপাত। স্বচছ জলেঘেরা সুনামগঞ্জকে বলা হয় বাংলাদেশের কাশ্মীর। বান্দরবনে কিছু পথে একদল তরুণ বাইকার আবিষ্কার করেছেন সেখানে যে পথ ও পরিবেশ তা যেন ভারতের বিখ্যাত লাদাখেরই আরেকটি রূপ। গ্রীষ্মের বান্দরবন যেন সামারের অনিন্দ্যসুন্দর সুইজারল্যান্ড হয়ে আবির্ভূত হয়। পিরোজপুরের স্বরূপকাঠির আটঘর কুরিয়ানা বা ভিমরুলিয়ার ভাসমান বাজার হার মানায় থাইল্যান্ড বা কেরালার ফ্লোটিং মার্কেটকে। এই উপজেলার ত্রিশটি গ্রামের ভেতর দিয়ে বয়ে চলা জলপথ ভ্রমণকারীকে বিখ্যাত ভেনিস বা আমস্টারডামের বোট ট্রিপের কথা মনে করিয়ে দেবে নি:সন্দেহে। চট্টগ্রামে ভাটিয়ারির একাংশ কিংবা নীলাচলে পাহাড়ের যে রূপ ও রং তার তুলনা চলে সিডনির ব্লু মাউন্টেইনের সাথে, এতোই চমৎকার। মুগ্ধকর। অলওয়েদার সড়ক নির্মাণের পরে কিশোরগঞ্জের অষ্টগ্রাম, নিকলি আর মিঠামইনের অপরূপ সৌন্দর্য এক কথায় পাগল করা। প্রসঙ্গত ঐতিহাসিক মতে ষষ্ঠ শতাব্দীতে সমুদ্রবক্ষ থেকে উৎপত্তি ঘটা ৮হাজার ৫শ ৯০বর্গকিলোমিটার পরিধির বিশ্বের সর্ববৃহৎ মিঠাপানির একক ‘ওয়াটার বডি’  হচ্ছে বাংলাদেশের হাওরাঞ্চল। এর অল্পকিছু অংশ ভারতের আসামে ছাড়া বিশ্বের আর কোথাও নেই। বিশেষ করে কিশোরগঞ্জের হাওরকে বলা হয়ে থাকে বর্ষার অস্ট্রেলিয়া আর শুকনো মৌসুমের নিউজিল্যান্ড। এছাড়াও সেন্টমার্টিন দ্বীপ, স্বর্ণদ্বীপ, নিঝুমদ্বীপ, শাহ পরীরদ্বীপ, মনপুরাদ্বীপ, কুতুবদিয়দ্বীপ, ভোলার রাণীরদ্বীপ বা কুইন আইল্যান্ড, চর কুকরিমুকরি বা বাংলাদেশের একমাত্র পাহাড়ঘেরা মহেশখালি দ্বীপের যে চোখ জুড়ানো রূপের বাহার তার তুলনা হতে পারে কেবল মালদ্বীপের সাথে। আর সোনদিয়া দ্বীপ হতে যাচ্ছে বাংলাদেশের দুবাই।

পর্যটনের এতো অনুষঙ্গ থাকার পরেও স্বাধীনতার ৪৯ বছরেও বাংলাদেশ পর্যটন কেন কাক্সিক্ষত সাফল্য অর্জন করতে পারেনি?

এখানে একটি বিষয় খুব স্পষ্ট এবং পরিস্কার, সেটি হলো জাতিরপিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হাত ধরে বাংলাদেশে পর্যটন যেসময়টাতে যাত্রা শুরু করেছিলো তা যদি ঠিক গতিতে এগুতো পৃথিবীর পর্যটন মানচিত্রে বাংলাদেশের অবস্থান হতো এক থেকে পাঁচের মধ্যে, পর্যটন বোদ্ধারা এমনটাই মনে করেন। কিন্তু বাস্তবতা অত্যন্ত নির্মম। সর্বোচ্চ রাজনৈতিক সদিচ্ছা থাকা সত্ত্বেও পর্যটনে কাক্সিক্ষত গন্তব্যের ধারে কাছেও যেতে পারেনি। তার মানে এই নয় যে পর্যটন এগুয়নি। দুনিয়াজুড়ে পর্যটন স্পীড বোটের গতিতে চলেছে। বাংলাদেশের পর্যটন এগিয়েছে জলে ভাসা কচুরিপানার মতো, স্লথ এবং খানিকটা লক্ষ্যহীন। অনেকখানি এলোমেলোভাবে। এর অন্যতম প্রধান কারণ হচ্ছে কার্যকর নেতৃত্বের ঘাটতি ছিলো প্রবল। যে কোনো দেশে পর্যটন কার্যক্রম সরকারের অন্য মন্ত্রণালয়গুলো থেকে ভিন্ন। এখানে ট্রেডিশনাল ব্যুরোক্রেসি বা প্রথাগত আমলাতান্ত্রিক কার্যক্রম অনেকখানি অকার্যকর। উপরন্তু পর্যটনকে সফল করার জন্য দেশভেদে ১১-২১টি মন্ত্রণালয়ের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সহযোগিতা ও সংযুক্তি প্রয়োজন হয়। বাংলাদেশে গত ৩৩ বছরে ২৮জন সচিব পর্যটন পর্যটন মন্ত্রণালয়ে দায়িত্বভার নিয়েছেন। এখানে তাদের কাজের সময়কাল ছিলো মাত্র এক বছরের কিছু বেশি। অর্থাৎ ‘পর্যটন চাই’ এই নীতি সচল থাকলেও কার্যকর নেতৃত্বের কোনো ধারাবাহিকতা ছিলনা। বিগত ত্রিশ বছরে আরেকটি বিষয় লক্ষ্যণীয় ছিলো তা হলো এখানে আগত অফিসার বা কর্মকর্তাদের বড় একটি অংশই ছিলেন পলায়নপর। অনেকেরই ধারণা ক্যারিয়ার বা কাজের বিচারে এটি তুলনামুলক দুর্বল মন্ত্রণালয়। ফলে এখানে কাজ করার চাইতে কেমন করে এখান থেকে বদলি হয়ে অন্য কোনো গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ে চলে যাওয়া যায় সেই প্রচেষ্টাই ছিলো বেশি। উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি চোখে না পড়ার অন্যতম কারণ হিসাবে সংশ্লিষ্ট অনেকেই এটিকেও দায়ী করেন। তবে গত দুই বছরে এই পর্যটনবিনাশী প্রবণতা প্রায় থেমে গেছে, এটি দারুন আশার জায়গা বাংলাদেশের পর্যটনপ্রেমীদের জন্য। যথেষ্টসংখ্যক মেধাবী অফিসার পর্যটন মন্ত্রণালয়ে এখন আছেন। নিবেদিত হয়ে তারা কাজ করছেন। এটি বাংলাদেশের জন্য সত্যিকারভাবেই আশাব্যঞ্জক।

এসডিজি বা সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট গোল অর্জনে পর্যটন

বাংলাদেশ মধ্যম আয়ের রাষ্ট্রের মর্যাদা অর্জনের পথে রয়েছে। একইসঙ্গে যে ১৭টি টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা বা এসডিজি বাংলাদেশকে অর্জন করতে হবে তারমধ্যে ৪টি সরাসরিভাবে পর্যটনের সাথে যুক্ত। পরোক্ষভাবে সংযুক্ত আরও ১৩টি। সুতরাং আগামিদিনে পর্যটনে ব্যর্থতার অর্থ দাড়াবে এসডিজি বা সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট গোল অর্জনে ব্যর্থতা। সবকিছু মিলিয়ে আসন্ন সময়গুলো বাংলাদেশের জন্য পর্যটনক্ষেত্রে সামনে তাকানো, সফলতার পথে ছুটে চলা ও তা অর্জন করার উদ্যোগ গ্রহণ ছাড়া কোনোও বিকল্প নেই। কোভিড-১৯ পরবর্তি পর্যটন পরিস্থিতি একদিক থেকে সেই লক্ষ্য অর্জনে সহায়কসঙ্গের আভাস দিচ্ছে।
সঙ্গতভাবে দ্বিধাময় একটি প্রশ্ন যে কোনও পাঠকের মনে উদিত হতে পারে, তা হলো, কোভিড-১৯ পরবর্তি পর্যটনে যে অমিত সাফল্যসম্ভাবনা বাংলাদেশের দরজায় কড়া নাড়ছে তা কেমন করে সফল হবে বা আদৌ সফল হবে কি-না? আমার দৃঢ় বিশ্বাস আগামি তিন বছরের মধ্যে বাংলাদেশের পর্যটনে কাঙ্খিত এবং বিস্ময়কর সাফল্য আসবে ইন-শা-আল্লাহ্, যদি তার যাত্রাপথটা এখনই নির্দিষ্ট করা যায়।

‘ওনশিপ’ ব্যুরোক্রেটিক লিডারশিপ

ইতিহাস বলছে ‘ওনশিপ’ ব্যুরোক্রেটিক লিডারশিপ হচ্ছে পর্যটনসাফল্য অর্জনের প্রমাণিত হাতিয়ার। বর্তমান পৃথিবীতে পর্যটনে এক নম্বর সফল দেশ ফ্রান্স ইউরোপের অন্যদেশগুলোর মতোই ছিলো। স¤্রাট নেপোলিয়ান-৩ স্বপ্ন দেখেছিলেন প্যারিসকে কেন্দ্র করে ফ্রান্সকে তিনি বিশ্বের মানুষের কাছে আকর্ষণীয়রূপে তুলে ধরবেন। সেইলক্ষ্যে তৎকালীন ফরাসি আমলা জ্যাজ ব্যারো ওসমানকে দায়িত্ব দেন। একজন আমলার যোগ্য দূরদর্শী এবং সৃজনশীল নেতৃত্ব গোটা ফ্রান্সকে আজ বিশ্ব দরবারে পর্যটকদের প্রথম গন্তব্যরূপে প্রতিষ্ঠিত করেছে। উল্লেখ্য ২০১৯ সালে ফ্রান্সে ভ্রমণ করেছেন ৯০ মিলিয়ন বা ৯ কোটিরও বেশি বিদেশি পর্যটক। সাম্প্রতিককালে মালয়েশিয়ার উদাহরণও উল্লেখযোগ্য। বাংলাদেশের তুলনায় অনেক কম বৈচিত্রময় দেশটি জিএমটিআই বা গ্লোবাল মুসলিম টুরিজম ইনডেক্সে তুরস্ক ও মিশরকে পেছনে ফেলে পৃথিবীর শীর্ষস্থানীয় মুসলিম টুরিজম ডেস্টিনেশনের আসন লাভ করেছে। মালয়েশিয়ার এই পর্যটন সাফল্যের পেছনেও প্রথম স্বপ্নদ্রষ্টা ছিলেন দেশটির জাতিরজনক টুঙ্কু আব্দুর রহমান এবং পরবর্তিতে চতুর্থ ও সপ্তম প্রধানমন্ত্রী তুন ডা. মাহাথির মোহাম্মদ। নব্বইয়ের দশকে সেই স্বপ্নকে বাস্তবায়নে নের্তৃত্ব দিয়েছিলেন দাইম জয়নুদ্দীন ও দেশটির উদ্যোগী আমলাতন্ত্র।
জাতিরপিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানও সোনার বাংলার পর্যটনের প্রথম স্বপ্ন দেখেছিলেন এবং সেই স্বপ্নের অংশ হিসাবেই গঠিত হয় বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশন। তারই সুযোগ্য কন্যা এযাবৎকালে বাংলাদেশের উন্নয়নে সবচেয়ে সফল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শুধু স্বপ্নই দেখেননা, বাংলাদেশের পর্যটনকে সত্যিকারভাবে বিশ্বের কাছে তুলে ধরবার জন্য নানা উদ্যোগও নিয়েছেন। আগের সময়কালেও নিয়েছিলেন। রূপ-রস-গন্ধে ভরা সোনার বাংলা পর্যটনে শীর্ষ ও অতুলনীয় হওয়ার জন্য সকল প্রাকৃতিক অনুষঙ্গ নিয়েই টইটুম্বুর। শুধু প্রয়োজন একজন জ্যাজ ব্যারো ওসমান। কর্মযজ্ঞ বাস্তবায়নে দরকার দাইম জয়নুদ্দীনের মতো কুশলে ভরা কৌশলী উদ্যোগ।

‘প্রারম্ভ’হীন ‘শুরু’ এবং ‘উইন্ডো ড্রেসিং মেথড’

দুনিয়াজুড়ে সরকারের সব কাজেরই একটি ‘প্রারম্ভ’ থাকে। কিন্তু পর্যটনের কোনো ‘প্রারম্ভ’ নেই। এখানে ‘শুরু’ করতে হয়। এই ‘শুরু’ করবার জন্য যে মেথড সফল হিসাবে পরীক্ষিত, প্রমাণিত ও প্রতিষ্ঠিত তাকে বলা হয় ‘উইন্ডো ড্রেসিং মেথড’। ‘উইন্ডো ড্রেসিং মেথড’ হচ্ছে যেগুলো যে অবস্থায় আছে সেগুলো প্রয়োজন অনুযায়ি সেই অবস্থা থেকেই ঠিকঠাক করা, কিছু সংস্কার করা, যেমনটা ঘরে অতিথি এলে আমরা করি, ঘরের পর্দাগুলো ধুয়ে দেই, দেয়ালে ময়লা থাকলে রং করি, পাপোষটা পুরণো হলে বদল করি, বিছানায় ধোয়া পরিস্কার চাদর বিছাই, ভাত না করে পোলাও রান্না করি, অতিথির পছন্দমতো সঙ্গতি অনুযায়ি  কিছু বাড়তি আয়োজন করি ইত্যাদি। প্রথাগত পদ্ধতিতে ‘প্রারম্ভ’ খুজতে গিয়ে পর্যটনের ‘শুরু’টা আর হয়নি বঙ্গন্ধুর সোনার বাংলাদেশে। ফলে বিশাল পর্যটনভান্ডার বিদ্যমান থাকা সত্ত্বেও স্বাধীনতার ৪৯বছরে বাংলাদেশ তার প্রাপ্য পর্যটনসাফল্য থেকে বঞ্চিত থেকেছে। কোভিড-১৯ পরবর্তি পর্যটন পরিস্থিতি পূর্বাভাস আমাদের জন্য নতুন সুযোগ ও সম্ভাবনা এনে দিয়েছে। সেই সুযোগকে কাজে লাগানোর লক্ষ্যে সাম্প্রতিকসময়ে প্রথমবারের মতো প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পর্যটনস্বপ্ন বাস্তবায়নে ‘প্রারম্ভ’হীন পর্যটন ‘শুরু’র ধারণা নিয়ে অগ্রসর হচ্ছে বাংলাদেশের পর্যটন মন্ত্রণালয়। বাংলাদেশের কোনো কর্মকর্তার ক্ষেত্রে জ্যজ ব্যারো ওসমানের মতো করে কাজ করা হয়তো কঠিন, কিন্তু অসম্ভব নয়। মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী মো: মাহবুব আলী এবং সিনিয়র সচিব মো: মহিবুল হক তাদের চৌকষ দল নিয়ে পর্যটন মন্ত্রণালয়ে নেতৃত্ব দিচ্ছেন যার তাৎপর্যপূর্ণ সুফল পরিলক্ষিত হচ্ছে পোস্ট কোভিড-১৯ পর্যটনে, বিমানসহ বেশকিছু প্রতিষ্ঠানে। কোভিড-১৯ পর্যটন রিওপেনিংয়ে সংশ্লিষ্টদের জন্য সরকার কর্তৃক যথাসময়ে একটি এসওপি বা স্ট্যান্ডার্ড অপারেটিং প্রসিডিওর উপস্থাপন করতে সক্ষম হওয়া সত্যিকারভাবেই আশা সঞ্চারী।

আমরা প্রশংসায় কৃপণ, নিন্দায় পঞ্চমুখ। পর্যটন সাংবাদিকতাকে অনেকক্ষেত্রেই অভিহিত হরা হয় ‘অয়েনন্টমেন্ট জার্নালিজম’ হিসাবে। কোথাও ক্ষত দেখলে তাকে চুলকিয়ে ঘা-এ রূপান্তর না করে সেখানে কী মলম বা অয়েন্টমেন্ট দিয়ে ক্ষত সারানো যাবে তার উপায় খুজে বের করা এবং তুলে ধরার পদ্ধতিই হচ্ছে ‘অয়েন্টমেন্ট জার্নালিজম’। এই প্রেক্ষাপটে কোভিড-১৯ পরবর্তি ক্ষেত্রে বাংলাদেশের পর্যটনের জন্য পাওয়া পেনাল্টি শুটে গোল করবার জন্য নিচের উদ্যোগগুলো বিবেচনা করে উইন্ডো ড্রেসিং মেথডে আশু পদক্ষেপ নেওয়া গেলে অচিরেই বড় সুফল ও সফলতা আসবে বলে আশা করা যায়।

‘এলিফ্যান্ট থিওরি এন্ড উইন্ডো ড্রেসিং মেথড টুরিজম’

পোস্ট কোভিড-১৯ পর্যটন পলিসি প্রণয়ন করা, যেটি হবে ‘এলিফ্যান্ট থিওরি এন্ড উইন্ডো ড্রেসিং মেথড টুরিজম’। যেকোনো দেশের পর্যটনকে বলা হয় হাতি; হাতির যেমন শুর থাকে, মাথা থাকে, বিশাল শরীর, পা, লেজ থাকে, পর্যটনেরও তাই। ডেেিস্টনেশন, সার্ভিস, এভিয়েশনসহ বাংলাদেশের ক্ষেত্রে পর্যটনের মোট বিভাজন সংখ্যা ১৩-১৫টি। এই সবগুলোকে বিবেচনায় নিয়েই এই এলিফ্যান্ট থিওরি পর্যটন।

ডিভিশনাল টুরিজম বাবল প্লান, বাস্তবায়ন কৌশল নির্ধারণ

৭টিএ বিবেচনায় আটটি বিভাগের ডেস্টিনেশন এবং ১৩-১৫টি পর্যটন বিভাজন ও প্রেজেনটেশন, ডেস্টিনেশন স্পেশালিটি, ডাইভারসিফিকেশন, হোটেল, এভিয়েশন, যোগাযোগ ব্যবস্থা, ভ্রমণ গাইড, নিরাপত্তা, অপশনাল ইন্সুরেন্স (আইন অলরেডি আছে) ইত্যাদি বিবেচনায় নিয়ে পরিকল্পনা করা। গত দুই বছরে অভ্যন্তরীণ পর্যটক তার আগের দুই বছরের তুলনায় তাৎপর্যপূর্ণ হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। কোভিড-১৯ পরবর্তি ক্ষেত্রে এই ধারা আরও বেগবান হবে। সুতরাং এই পর্যটন ট্র্যাফিক ওয়েল ম্যানেজমেন্টের জন্য ডিভিশনাল টুরিজম ‘বাবল’ একটি যুৎসই এবং টেকসই উপায় যা আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত এবং বর্তমান প্রেক্ষাপটে প্রবলভাবে প্রচলিত। ডিভিশনাল টুরিজম ‘বাবল’ এর ফলে ওভার টুরিজম যেমন হবেনা আবার পর্যটনটা দেশব্যাপি ছড়িয়ে যাবে। অর্থনীতিতে সামগ্রিক গতির সঞ্চার করবে। একইসাথে যত দ্রুত সম্ভব “ Safe, Clean and Secured /Safety Stamp ” কালেক্ট করা এবং তার প্রচার করা। পৃথিবীময় ডেস্টিনেশনগুলো অলরেডি “ Safe Travel ” স্টিকারিং আরও একমাস আগে থেকেই আন্তর্জাতিক নিয়ম অনুযায়ি শুরু করেছে।

পর্যটনের সাথে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানসমূহ ও তাদের ভূমিকা এবং আশু করণীয়

পৃথিবীময় পর্যটন মন্ত্রণালয় এককভাবে কাজ করতে পারেনা। দেশভেদে ১১-২১টি মন্ত্রণালয় সরাসরিভাবে পর্যটন উন্নয়ন-প্রচার-প্রসার ও সাফল্যের সাথে অঙ্গাঙ্গিভাবে যুক্ত। এছাড়াও বাংলাদেশের ক্ষেত্রে আরও ২/৩টি মন্ত্রণালয়ের কিছু বিভাগকে যুক্ত করা প্রয়োজন, যেমন এক্সপোর্ট প্রমোশন ব্যুরো, বিডা ইত্যাদি। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে পর্যটনে নের্তৃত্বদানকারি মন্ত্রণালয় হিসাবে বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের এই বিষয়ে দায়িত্ব ও করণীয় ঠিক করা এবং সেগুলো সমন্বয় করা।

প্যাকেজেস, অফারস, প্রণোদনা

প্যাকেজেস, অফারস, প্রণোদনা, জিএসটিসি কনসেপ্ট+উই লাভ থাইল্যান্ড+ল্যাঙ্কউিয়ি ডোমেস্টিক টুরিজম+ইন্দোনেশিয়া ডোমেস্টিক টুরিজম প্রাকটিসকে বিবেচনায় নেয়া। এভিয়েশন, হোটেল এন্ড সার্ভিসকে একুমুলেট করা, একইসাথে কিছু নতুন ইনোভেটিভ পর্যটন সুবিধা তৈরি করা। যেমন হেলিকপ্টার টুরিজম, আমরা যে ৪০লক্ষাধিক আর্থিকভাবে সক্ষম পর্যটকদের দেশভ্রমণের কথা বলছি, তাদের জন্য এটি বেশ কার্যকর হবে। যেমন পরিবার নিয়ে কেউ সাজেক যাওয়ার ক্ষেত্রে দ্বিধা করবেন সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থার কারণে। সেখানে হেলিকপ্টারে অনায়াসে যাওয়া যেতে পারে। বিমানবাহিনীর ১০/১২ বা ততোধিক আসনের অলস হেলিকপ্টারগুলো এক্ষেত্রে বাণিজ্যিকভাবে ব্যবহার করা যেতে পারে। বুড়িগঙ্গা নদী নানাভাবে দূষণের কারণে ঢাকা কেন্দ্রিক নৌপর্যটনে তাৎপর্যপূর্ণ অবদান রাখতে পারে তুরাগ নদ। অনুরূপভাবে প্লেনে  VUSA (Visit United States of Amerca with one single price for anywhere ), ট্রেন বা জাহাজে  EURO Pass/SAVER PASS  (সেনজেনভুক্ত ইউরোপের ২৯টি দেশে ভ্রমণের জন্য), আদলে  VBD (Visit Bangladesh),  VBD MULTI PASS  কনসেপ্ট দারুনভাবে ব্যবহার করা যেতে পারে। এই ধরণের সহজ সুযোগ উল্লেখিত পর্যটকরা নিশ্চিতভাবে লুফে নেবেন। একইসাথে  VUSA, EURO Pass  আদলে  VBD, VBD MULTI PASS  এর কল্যাণে সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো একযোগে কাজ করার সুযোগ পাবে, ফলে এক নতুন বাংলাদেশকে আবিস্কার করতে পারবেন তারা। এই প্রকল্পের সাফল্যে তিনটি তাৎপর্যপূর্ণ ইতিবাচক ফলাফল আসবে:

১. অল্প সময়ে, স্বল্প খরচে এবং সহজতম উপায়ে নিরাপদে এবং নির্বিঘ্নে ৫-৯ দিনের ভ্রমণে পর্যটকগণ গোটা বাংলাদেশ ভ্রমণ করে ফেলতে পারবেন।
২. দেশ সম্পর্কে তাদের ধারণা বদলে যাবে, নতুন ইতিবাচক বাংলাদেশকে তারা উপভোগ করবেন। কৃষি, শিল্প ও সেবাখাতসহ গোটা অর্থনীতিতে এর সুফল প্রবাহিত হবে।
৩. এই পারিবারিক ভ্রমণে শিশুরাও থাকবে, ফলে দেশ সম্পর্কে তাদের পরিস্কার ধারণা ও দেশপ্রেম জাগ্রত হবে। দির্ঘমেয়াদে এর সুফল বাংলাদেশ পাবে। বেশকিছু অবকাঠামোগত সুবিধা থাকায় এই কাজে নেতৃত্ব দিতে পারে বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশন। বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশন শুরুটা করলে বেসরকারি পর্যায়ে ব্যাপক আলোড়ন তৈরি হবে।

সৃজনশীল বহুমাত্রিক প্রচারণা, অল ইন ওয়ান..

৭টিএ বিবেচনায় ডেস্টিনেশন, নদী, হাওর, সমুদ্র, পাহাড়, বন, ইতিহাস-ঐতিহ্য-সংস্কৃতি, ঋতু বৈচিত্র, কুলিনারি, শপিং, লেইজার, স্পিরিচুয়াল, জাদুঘর, জমিদারবাড়ি, প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন, উৎসব ইত্যাদি বিষয়াদির সৃজনশীল বহুমাত্রিক প্রচার চালাতে হবে, তবে অবশ্যই সেটি ব্রুশয়ার জাতীয় ‘রূহআফজা’র মতো নিছক মিষ্টি প্রচারণা নয়, এটি হবে কোকাকোলার মতো ত্রিমাত্রিক প্রচার, যেখানে মিষ্টির সাথে ঝাঁজ থাকবে এবং তৃপ্তির ঢেকুর উঠবে। কোভিড-১৯ পরবর্তি পর্যটনে পাওয়া অর্থনীতির পেনাল্টি শুটে তবেই বাংলাদেশ গোল করবে।

 


লেখক: লেখক এবং সম্পাদক, ভ্রমণ ম্যাগাজিন,
অ্যাডজাংকট ফ্যাকাল্টি, ডেফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি

ইত্তেফাক/জেডএইচডি

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন