শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

রাহু মুক্তির সমাজব্যবস্থা:প্রত্যাশার ভুল কোথায়?

আপডেট : ২৮ সেপ্টেম্বর ২০২০, ২০:৩৯

কোভিডকালের চতুর ব্যবসায়ী ও ছদ্মবেশী বুদ্ধিজীবী সাহেদ এবং জিকেজির মেধাবী ও স্মার্ট সাবরিনা কারাগারে, ভাবলেই ভারাক্রান্ত মনটা ক্ষণিকের আনন্দে নেচে উঠে। কিন্তু বেশিক্ষণ স্থায়ী হয় না, আবার পরক্ষণেই বিষাদ আমায় গ্রাস করে। হ্রদয়ের এমন উত্থান-পতন যখন ঘটেই চলেছে, তার মাঝেই ড্রাইভার মালেকের আগমন। ড্রাইভার মালেক নাকি কয়েকটি বহুতল ভবন, ২৪ টি  ফ্ল্যাট, ডেইরি খামার আর নগদ শত কোটি টাকার মালিক, তার হাতে লোহার হাতকড়া, দেখেই মনটা আবারও প্রফুল্ল হয়ে উঠলো। 

ক্যাসিনোকাণ্ডের শুরু থেকে মাঝে মাঝেই মনটা আনন্দে নেচে উঠে, কিন্তু কিছুদিন না যেতেই কোথা থেকে কালো মেঘ এসে আমায় গ্রাস করে, করবেই না কেন টাকার জোরে লক্ষ্মীপুরের পিপলু আদুরে বৌ সমেত লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে অর্জিত দেশের সংসদে যায়। আর জেলজুলম খাটা নেতা গ্রামে-গঞ্জে ঘুরে ঘুরে আহাজারিতে দিন কাটায়।

বাংলাদেশের জন্মলগ্ন থেকেই দুর্নীতি আমাদের সঙ্গী ছিল। উত্তরাধিকারে পাওয়া এই ব্যাধি মাঝে মাঝে রূপ পাল্টালেও কলেবর তার বেড়েই চলেছে। ৭৫ এর মর্মান্তিক বিয়োগান্তক ঘটনার পর সামরিক শাসকদের রাজনৈতিক উচ্চাভিলাষ সুবিধাবাদী গোষ্ঠীকে নেতৃত্বে নিয়ে আসে, আর তখন থেকেই শুরু হয় রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতায় দুর্নীতির প্রাতিষ্ঠানিকীকরন। এরশাদ আমলে নানা সিন্ডিকেটের কথা শোনা যেত, খালেদা জিয়ার আমলে হাওয়া ভবন তো সর্বজন বিদিত ছিল, এখন এমন সিন্ডিকেটের নাম শোনা না গেলেও এর ব্যাপ্তি কমেনি। দুর্নীতি আর মাদক এখনও বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় দু'টি সামাজিক সমস্যা ও উন্নয়নের পথে সবচেয়ে বড় অন্তরায়।

উন্নয়নের প্রচারণায় আমরা যতই বজ্রকন্ঠ হই না কেন, এটি অবজ্ঞা করার কোন উপায় নেই, এখনো প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্সই আমাদের অর্থনীতিকে সচল রাখে। তার মধ্যে শীর্ষ রেমিট্যান্স প্রদানকারী দেশ মধ্যপ্রাচ্যের সৌদি আরব। সেই দেশে অবস্থান করা ২২ লক্ষ বাংলাদেশি আজ সৌদি সরকারের হুমকির মুখে।  পররাষ্ট্রমন্ত্রী এমএ মোমেন এক টিভি সাক্ষাতকারে বলেছেন-সৌদির দাবি, তাদের দেশে ৫৪ হাজার বাংলাদেশি পাসপোর্টধারী রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী বসবাস করে, তাদের ফিরিয়ে না নিলে ২২ লক্ষ প্রবাসী বাংলাদেশিকে দেশে ফেরত পাঠাবে। অভিযোগটি নিঃসন্দেহে অত্যন্ত গুরুতর, যার সঙ্গে জড়িয়ে আছে দেশের ভাবমূর্তি। এমন বিষয়ে কথা বলতে গিয়ে মাননীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রীর মধ্যে কোন ক্ষুব্ধ মনোভাবের বহিঃপ্রকাশ না ঘটলেও এক প্রবাসী বাংলাদেশি হিসেবে আমি ভীষণ শঙ্কিত।

অনৈতিকতা, লোভ আর দুর্নীতির মাত্রা কতটা বিস্তৃত হলে ৫৪ হাজার রোহিঙ্গা ভিনদেশের মানুষ হয়েও লাল সবুজের পতাকা খচিত পাসপোর্ট নিয়ে বিদেশের মাটিতে ঘুরে বেড়াতে পারে? দুর্নীতির এমন ভয়াবহ আগ্রাসনে আমি ক্ষুব্ধ হলে খুবই অন্যায় হবে কি?

নিজ দলেরই অনেকে নিজ সরকারের আমলে আইনের মুখোমুখি হচ্ছেন। এ সরকারের আমলে এমন কিছু কিছু শুভ লক্ষণ যেমন আছে, আবার মুজিব কোটের অপব্যবহারও কম নয়। গায়ে মুজিব কোট, দপ্তরে মাথার ওপর জাতির জনক বঙ্গবন্ধু ও মুজিব কন্যা শেখ হাসিনা আর মুখে মুজিব আদর্শের বুলি আওড়িয়ে নতুন নতুন মন্ত্রীদের বিভ্রান্ত করে অন্তরে ভিন্ন মতাদর্শ ধারণ করেন এমন ঘটনাও কম নয়। একাধারে একযুগেরও বেশি সময় আওয়ামী লীগ ক্ষমতায়। আগের মেয়াদের পাঁচ বছর যোগ করলে তা দেড় দশকেরও বেশি। ২১ বছরের জঞ্জাল মোকাবিলায় এই সময় নিতান্ত কম নয়! আওয়ামী লীগ জাতির আশা আকাঙ্ক্ষার প্রতীক, বঙ্গবন্ধু কন্যার সমকক্ষ কোন রাজনৈতিক নেতৃত্ব বাংলাদেশে নেই, তাই জননেত্রীকে নিয়ে জাতির প্রত্যাশাও অনেক বেশি।

তিন মেয়াদে এই সরকারের অর্জন অনেক। ধর্মীয় উগ্র সাম্প্রদায়িকতা, জঙ্গিবাদ, বিডিআর বিদ্রোহের মতো ঘটনা মোকাবিলা করে একদিকে যেমন উন্নয়নকে অব্যাহত রেখেছে, অন্যদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো ক্ষমতাধর দেশের প্রভাবশালী মন্ত্রীসহ অনেক আন্তর্জাতিক চাপকে থোড়াই কেয়ার করে, যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসি নিশ্চিত করেছে। সাবেক সফল অর্থমন্ত্রী, জাতির গর্ব, আন্তর্জাতিক খ্যাতনামা ব্যক্তিত্ব শাহ এএমএস কিবরিয়া হত্যার এখনো কূলকিনারা না হলেও ১৫ আগস্টের বিয়োগান্তক ঘটনা, জেল হত্যা, ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলার বিচারে জাতির শাপমুক্তি হয়েছে। তাই তো দেশের জনগণ গণতন্ত্রের ক্ষয় মেনে নিয়ে ও শেখ হাসিনার সরকারকে চতুর্থ মেয়াদে ও স্বাগত জানিয়েছে। তবে এবারের আগমনে জাতির প্রত্যাশা ভিন্নধর্মী। তাই তো নির্বাচনের প্রাক্কালে অনেক দেশপ্রেমিক বুদ্ধিজীবীর মুখে শুনেছি, বঙ্গবন্ধু কন্যার এবারের মিশন-দুর্নীতির মূলোৎপাটন, মাদকমুক্ত সমাজ ব্যবস্থার অঙ্গীকার।

ড্রাইভার মালেক, কেরানী আফজাল, এনু, রুপনের সংখ্যা কত জানি না। তবে জাতি দৃঢ়ভাবেই বিশ্বাস করে, এরা কেউই রাগব-বোয়াল নয়। অসম সাহসী, জাতির আশা আকাঙ্ক্ষার শেষ ঠিকানা বঙ্গবন্ধু কন্যা অচিরেই রাগব বোয়ালদের প্রতিরোধে ক্রাস প্রোগ্রাম শুরু করে জন আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটিয়ে দুর্নীতি নির্মূলে সফল না হওয়ার অন্য কোন বিকল্প এই মুহূর্তে জাতির প্রত্যাশিত নয়। সিআইডি, এসবি, এনএসআইসহ আমাদের জাতীয় গোয়েন্দারা কোনভাবেই পৃথিবীর অনেক উন্নত দেশের গোয়েন্দাদের থেকে কম দক্ষ নয়, সেই সাথে প্রশাসনে অনেক সৎ, দক্ষ, দেশপ্রেমিক, মেধাবী কর্মকর্তা আছেন যারা নির্ভীকতার গ্যারান্টি পেলে দুর্নীতি আর ভয়াবহ মাদকের বিরুদ্ধে অসম সাহসী একটি ক্রাস প্রোগ্রামের মাধ্যমে জাতির হ্রদয়ে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনাকে আরও অনন্য উচ্চতায় প্রতিষ্ঠিত করতে পারেন।

আজ মুজিব কন্যা শেখ হাসিনার জন্মদিন। জাতির অফুরন্ত ভালোবাসা ও ফুলেল শুভেচ্ছায় তিনি সিক্ত হবেন অবশ্যই। সেই সাথে উন্নয়নের গতি কে আরও দুর্ভেদ্য করতে, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সুফল বাংলার ঘরে ঘরে পৌঁছে দিতে অশুভ লোভাতুর দুর্নীতিবাজ রাগব বোয়ালদের বিরুদ্ধে ইস্পাত-দৃঢ় সংগ্রামের শুভ সূচনা হোক। জননেত্রী প্রধানমন্ত্রী জাতির জনকের সুযোগ্য কন্যা শেখ হাসিনার ৭৪ তম জন্মদিনে এটিই হোক জাতির প্রত্যাশা।

লেখক: উন্নয়ন গবেষক ও সমাজতাত্ত্বিক বিশ্লেষক 

ইত্তেফাক/এএএম

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন