শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

সেপ্টেম্বর অন যশোর রোড

আপডেট : ৩০ সেপ্টেম্বর ২০২০, ০৯:২১

রেইনট্রি গাছের মায়ায় মোড়া জমিদার কালীবাবুর ‘যশোর রোড’ তখনো বেশ প্রসিদ্ধ। একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধে পাক আর্মির বর্বরতা শুরু হলে নিরস্ত্র বাঙালির সীমান্ত পেরিয়ে ভারতে যাবার প্রধান পথ হয়ে ওঠে যশোর রোড। একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের ৯ মাসে বাংলাদেশের প্রায় ১ কোটি মানুষের ভারতে আশ্রয়ে যাবার প্রধান পথ হয়ে ওঠে এ রোড।

মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের অকৃত্রিম বন্ধু মার্কিন কবি ও সাংবাদিক অ্যালেন গিন্সবার্গ ভারতের শরণার্থী শিবিরে বাঙালিদের দুর্বিষহ জীবনকে দেখেন খুব কাছ থেকে। কবি কলকাতায় উঠেছিলেন সাহিত্যিক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের বাড়িতে। সেখানেই তিনি জানতে পারেন বাংলাদেশ থেকে অনেক শরণার্থী পশ্চিমবঙ্গ ও সীমান্তবর্তী অন্যান্য শহরে আশ্রয় নিয়েছে। তাদের প্রকৃত অবস্থা দেখতে তিনি সড়কপথে সম্ভব না হওয়ায় নৌকায় বনগাঁ পেরিয়ে বাংলাদেশের যশোরের সীমান্তবর্তী ও আশপাশের শরণার্থী শিবিরের মানুষের দুর্দশা প্রত্যক্ষ করেন। লাখো লাখো দুর্দশাপীড়িত মানুষের অবর্ণনীয় দুঃখ-কষ্ট দেখে আবেগাপ্লুত হয়ে প্রতিবাদী কবি লিখেছিলেন ‘সেপ্টেম্বর অন যশোর রোড’ নামে এক অনন্য কবিতা। আবেগময়ী ভাষায় কবিতায় তুলে ধরেন মুক্তি সংগ্রামের রূপকে : ‘শত শত মুখ হায় একাত্তর / যশোর রোড যে কত কথা বলে,/ এত মরা মুখ আধমরা পায়ে / পূর্ব বাংলা কোলকাতা চলে’

গিন্সবাগের কবিতায় জীবন্ত হয়ে উঠেছে একাত্তর আর যশোর রোড। কবিতাকে গানের ফ্রেমে বন্দি করে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের শিল্পী মৌসুমী ভৌমিক ‘সেপ্টেম্বর অন যশোর রোড’কে আরো জনপ্রিয় করে তুলেছেন। বলা যায় কবিতা ও এই গান একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের প্রতিচ্ছবি হয়ে উঠেছে বাঙালির কাছে। কবিতায় প্রতিবিম্বিত হয়েছে একাত্তরের দুর্বিষহ দিনের কথা :

‘লক্ষ মানুষ ভাত চেয়ে মরে/ লক্ষ মানুষ শোকে ভেসে যায়/ ঘরহীন ভাসে শত শত লোক/ লক্ষ জননী পাগলের প্রায়।/ রিফিউজি ঘরে খিদে পাওয়া শিশু / পেটগুলো সব ফুলে-ফেঁপে ওঠে / এইটুকু শিশু এতবড় চোখ / দিশেহারা মা কার কাছে ছোটে। / সেপ্টেম্বর হায় একাত্তর/ এত শুধু মানুষের মুখ / যুদ্ধ-মৃত্যু তবুও স্বপ্ন / ফসলের মাঠ ফেলে আসা সুখ।’

মুক্তিযুদ্ধের সমর্থনে নিউ ইয়র্কে ফিরে ১৯৭১ সালের ২০ নভেম্বর সেইন্ট জর্জ চার্চে ‘বাংলাদেশের জন্য মার্কিনিরা’ শীর্ষক কবিতা পাঠের আসরের আয়োজন করেন। সেখানে কবির নিজের কণ্ঠে কবিতা পাঠ সবার অন্তরকে ছুঁয়ে গিয়েছিল। তার বন্ধু বব ডিলান ও অন্য বিখ্যাত গায়কদের সহায়তায় কবিতাটি গানে সুরারোপিত করে বাংলাদেশি শরণার্থীদের জন্য অর্থ সংগ্রহ করেছিলেন গিন্সবার্গ। পরবর্তীকালে মৌসুমী ভৌমিকের কণ্ঠে গাওয়া গানটি যেকোনো বাঙালির হূদয়কে স্পর্শ করে।

কিন্তু এই যে কবিতা, এই যে সুর তার পিছনে কী এমন ঐতিহাসিক যোগসূত্র রয়েছে যশোর রোডের? মুক্তিযুদ্ধকালীন বৃহত্তর যশোরের বাংলাদেশ লিবারেশন ফ্রন্ট বা বিএলএফ উপপ্রধান বীর মুক্তিযোদ্ধা রবিউল আলমের ভাষ্যটা এমন : ‘২৫ মার্চের পর থেকে যশোর ক্যান্টনমেন্ট ছেড়ে বেরিয়ে এসে পাকিস্তানি আর্মিরা যশোর শহরের বিভিন্ন স্থানে অবস্থান নিতে থাকে। রাস্তার ধারের পথচারী ও ঘুমন্ত অতি সাধারণ মানুষকে গুলি করে হত্যা করতে থাকে। পাকহানাদার বাহিনীর এরকম আক্রমণে মানুষ ছোট ছোট দলে প্রথমে চৌগাছার বয়রা, মাসিলা ও বর্ণি সীমান্ত দিয়ে আশ্রয়ের সন্ধানে ভারতে যেতে শুরু করে। কিছুদিনের মধ্যে দেশের নানা প্রান্তের মানুষ চৌগাছার পাশাপাশি বেনাপোল সীমান্ত দিয়েও ভারতে যেতে থাকে। একটা সময় বেনাপোলের ওপারে যশোর রোড ধরে বনগাঁ থেকে চাপাবাড়িয়া, টালিখোলা ছাত্র-যুব শরণার্থী শিবিরে ভরে ওঠে। মহাকুমা শহর বনগাঁ ও কলকাতা অভিমুখী ছোট-বড় শহরগুলো শরণার্থীতে পূর্ণ হয়ে ওঠে। ভারতীয়রাও নিজেদের ভালোবাসার সবটুকু উজাড় করে দিয়ে বাংলাদেশের মানুষের পাশে দাঁড়ায়। যশোর রোডের চারপাশে ভারতের নানা প্রান্তের মানুষ ছুটে আসেন সহযোগিতার হাত নিয়ে। তাদের কেউ ট্রেনে পেট্রাপোলমুখী, কেউবা যশোর রোড ধরে শরণার্থী ক্যাম্পে ছুটে আসেন।’

৬ ডিসেম্বর যশোর মুক্ত হলে ঐতিহাসিক আরেক ঘটনার সাক্ষী হয়ে ওঠে যশোর। ১১ ডিসেম্বর যশোর শহরের টাউন হল ময়দানে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। প্রবাসী সরকারের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম, প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমেদসহ নেতৃবৃন্দ এ জনসভায় ভাষণ দেন। তারা ঐদিনই আবার কলকাতা ফিরে যান। তাদের আসা-যাওয়ার পথেরও সাক্ষী সেই ঐতিহাসিক যশোর রোড।

শুধু তাদের আসা-যাওয়ার সাক্ষী নয়, এই রোড লক্ষ লক্ষ শরণার্থীর আসা-যাওয়ার সাক্ষী হয়ে ইতিহাসের পাতায় নাম লিখিয়েছে। এই রোড বিজয়ী বাঙালির ঘরে ফিরে আসার সাক্ষী। এই রোড সম্ভ্রমহারা নারী, সন্তানহারা পিতার বেদনার ইতিহাসের পথে অশ্রুভরা চোখের পানিতে স্নাত হয়ে রয়েছে। এই রোড আমাদের মহান ঐতিহাসিক মুক্তিযুদ্ধের বিজয় দ্বারের অভিধায় গৌরবদীপ্ত।

লেখক: সাংবাদিক ও সংস্কৃতিকর্মী

ইত্তেফাক/জেডএইচডি

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন