করোনাকালে দেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় বিরাট বৈষম্য তৈরি হচ্ছে। বিশেষ করে গ্রাম-শহর ও ধনী-দরিদ্র শিক্ষার্থীদের মধ্যে এই বৈষম্যটা দিনদিন প্রকট হয়ে উঠছে। শহরের মাধ্যমিক ও প্রাথমিকের শিক্ষার্থীরা টেলিভিশনের ক্লাস না দেখলেও অনলাইনে নিয়মিত ক্লাস করছে। এমনকি পরীক্ষাতেও অংশগ্রহণ করছে। অন্যদিকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকলেও স্কুল-কলেজের অনলাইন ক্লাসের পাশাপাশি ধনী পরিবারের সন্তানরা অনলাইনে বা সরাসরি প্রাইভেট পড়ছে। এতে তারা পুরো সিলেবাস শেষ করতে পারছে। অন্যদিকে গ্রামের ও দরিদ্র পরিবারের শিক্ষার্থীরা এসব সুবিধার বাইরে রয়েছে। ফলে শিক্ষায় বৈষম্য সৃষ্টি হচ্ছে।
মূলত শহরাঞ্চলের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গুলোতে নিয়মিত অনলাইনে ক্লাস হলেও মফস্বলের স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসার চিত্র অনেকটাই ভিন্ন। বহু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান টিউশন ফি আদায় করতে বা শিক্ষা প্রশাসনের নির্দেশনা মানতে অনেকটা নামকাওয়াস্তে অনলাইনে ক্লাস নিচ্ছে। তথ্যানুসারে অনলাইন ক্লাস এর ক্ষেত্রে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের চেয়ে সরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো ক্ষেত্র-বিশেষে অনেকটাই পিছিয়ে আছে। এমনতর অবস্থায় একাদশ শ্রেণিতে নতুন ভর্তি করা শিক্ষার্থীদের ক্লাস অনলাইনে নেয়ার জন্য নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। কিন্তু মফস্বলের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বা শিক্ষার্থীদের এ ব্যাপারে তেমন কোনো প্রস্তুতি নেই।
আবার মফস্বলের যেসব শিক্ষার্থী রাজধানী বা দেশের বড় বড় বিভাগীয় শহরের কলেজগুলোতে ভর্তি হয়েছে তাদের গ্রামে বসে অনলাইনে ক্লাস করার সুযোগ অনেটাই সীমিত। মফস্বলের বেশিরভাগ শিক্ষার্থী-অভিভাবকদের কাছে স্মার্টফোন বা অনলাইন ক্লাস এর জন্য কোন ডিজিটাল ডিভাইস নেই। ফলে প্রায় সংখ্যাগরিষ্ঠ শিক্ষার্থীর অনলাইন ক্লাসে যুক্ত হওয়ার সুযোগ সীমিত হয়ে পড়েছে। অন্যদিকে ইন্টারনেটের উচ্চমূল্য ও গ্রামাঞ্চলে তার গতি দুর্বল থাকায় অনলাইন ক্লাসে অংশ নেওয়া তাদের পক্ষে সম্ভব হচ্ছে না। এছাড়া মফস্বলের শিক্ষকদের অনেকেই তথ্যপ্রযুক্তিতে খুব একটা বেশি দক্ষ নয়। এমনকি অনেক শিক্ষকের স্মার্টফোনও নেই। ফলে মফস্বলের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে অনলাইন ক্লাস অনেকটা নির্দেশনার মধ্যেই বন্দি হয়ে পড়েছে। করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের পর গত ১৭ই মার্চ থেকে বন্ধ দেশের সকল ধরনের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। এ ছুটি কয়েকবার বৃদ্ধি করে তা ৩১শে অক্টোবর পর্যন্ত বৃদ্ধি করা হয়েছে।
এদিকে করোনাকালীন শিক্ষার অচলাবস্থা কাটিয়ে শিক্ষায় গতি ফেরাতে গত মার্চ মাস থেকেই সংসদ টেলিভিশনে মাধ্যমিকের ক্লাস এবং এপ্রিল মাস থেকে প্রাথমিকের ক্লাস প্রচার করা হলেও মূলত গ্রাম অঞ্চলে অপ্রতুল বিদ্যুৎ ব্যবস্থা এবং টেলিভিশনে ক্লাস করতে ছাত্র-শিক্ষকদের অনীহার কারণে তা ফলপ্রসূ হয়ে উঠেনি বা তা পাঠদানের বিকল্প পদ্ধতি হিসেবে জনপ্রিয় হয়নি।
অপরদিকে দেশে বিদ্যমান বহুধাবিভক্ত শিক্ষা ব্যবস্থার কারণেও শিক্ষাক্ষেত্রে এক বিরাট বৈষম্য তৈরি হয়েছে। ইংলিশ মাধ্যম ও বাংলা মাধ্যম শিক্ষা পদ্ধতি দেশে ধনী শ্রেণি এবং গরিব ও মধ্যবর্তী শ্রেণির ছেলে মেয়েদের মধ্যে সুস্পষ্ট সীমারেখা তৈরি করে দিয়েছে। বহুবছর ধরেই মাদ্রাসা শিক্ষায় আলিয়া ও খারিজি ধারা দেশের আলেম সমাজের মধ্যে এক অদৃশ্য বৈষম্য সৃষ্টি করে রেখেছে। চাকরিপ্রাপ্তি ও সামাজিক বৈষম্য দূরীকরণে এই বিভাজন মোটেই কাম্য নয়। ক্যাডেট কলেজগুলো শিক্ষাক্ষেত্রের এই বৈষম্যকে আরো প্রকট করে তুলেছে। সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় সমূহে শুধুমাত্র অনলাইনে ক্লাস শুরু করা হলেও তার কার্যকারিতা নিয়ে পক্ষে বিপক্ষে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনা রয়েছে। সরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ে পরীক্ষা গ্রহণে নিষেধাজ্ঞা থাকলেও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় সমূহ তাদের ক্লাস ও পরীক্ষা দুটোই নিচ্ছে। যদিও তার গুণগতমান নিয়ে বিস্তর আলোচনা-সমালোচনার সুযোগ রয়েছে। ফলে একই শিক্ষাবর্ষে ভর্তি হলেও সরকারী ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মধ্যে দৃশ্যমান বৈষম্য সৃষ্টি হচ্ছে। সরকারী ও বেসরকারি মেডিক্যাল শিক্ষার ক্ষেত্রেও একই চিত্র দৃশ্যমান।
দুঃখজনক হলেও সত্য যে স্বাধীনতার এতটা বছর পার হয়ে গেলেও দেশে আজও একক কোন শিক্ষানীতি নেই, যার উপর ভিত্তি করে দেশে বৈষম্যহীন একটি শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে উঠতে পারে। এদিকে দিনদিন গ্রামের শিক্ষার্থীরা শহরের শিক্ষার্থীদের থেকে পিছিয়ে পড়ছে। গ্রামের ও শহরের সরকারী-বেসরকারি উভয় শ্রেণির শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মধ্যে বিদ্যমান সুযোগ সুবিধার ব্যাপক ফারাক রয়েছে। গ্রাম বা মফস্বলের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভাল মানের শিক্ষকের সংখ্যা নেহায়েতই কম। এই মূহুর্তে দেশে এক শতাধিক কলেজে অধ্যক্ষ নেই। যার অধিকাংশই আবার মফস্বলের কলেজ। সে-তুলনায় শহরের অবস্থা অনেকটাই ভাল। রাজধানীর বা শহরের সরকারী কলেজগুলোতে শিক্ষক সংকট না থাকলেও গ্রাম বা মফস্বলের কলেজগুলোতে সেই সংকট অনেকটাই প্রকট।
অথচ দেশের উল্লেখযোগ্য সংখ্যক শিক্ষক আবার শিক্ষকতা কে গুরুত্ব না দিয়ে শুধুমাত্র রাজধানীতে থাকার জন্য শিক্ষা প্রশাসনের বিভিন্ন পদ বছরের পর বছর দখল করে বসে আছে। এমনকি কোন কোন ক্ষেত্রে পদের চেয়ে বেশি সংখ্যক শিক্ষক শিক্ষা প্রশাসন সহ সরকারের বিভিন্ন বিভাগ বা সংস্থায় বিভিন্ন পদ আঁকড়ে আছে। যা কোন ভাবেই প্রত্যাশিত নয়। শিক্ষার ক্ষেত্রে এমন বৈষম্য মোটেই কাম্য নয়। দীর্ঘ মেয়াদে এমন বৈষম্য সামাজিক বিশৃঙ্খলা তৈরি করতে পারে। সরকার ও শিক্ষা সংশ্লিষ্ট সবাইকে বিষয়টি নিয়ে এখনই ভাবতে হবে।
লেখক: প্রফেসর ড. মোহা. হাছানাত আলী, আইবিএ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।