শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

ধর্ষণ এবং ধর্মান্ধতা

আপডেট : ০৯ অক্টোবর ২০২০, ০৯:০০

বাংলাদেশে ক্রমবর্ধমান ধর্ষণের পেছনে যে বিচারহীনতার সংস্কৃতিই দায়ী, সে ব্যাপারে হয়তো কারোরই দ্বিমত নেই। কিন্তু এই বিচারহীনতার সংস্কৃতির প্রভাবক হিসেবে যে আমরা আমজনতাই দায়ী, সে ব্যাপারে হয়তো অনেকেই ভিন্নমত পোষণ করে থাকবেন। আমরা সর্বদাই সমাজ শিখরে আসীন রাঘব বোয়ালদের দোষারোপ করেই এক প্রকার ক্ষান্ত হয়ে যাই। 

সমাজের ওপরের কাঠামোর জনগণ যে সুবিধাবাদী হয়ে থাকেন, এ ব্যাপারে সবাই একমত। তাই প্রতিবার তাদেরকে বা এই ঘুণে ধরা সিস্টেমকে দোষারোপ করার আগে নিজেদের ভুল-ভ্রান্তিগুলোও খুঁজে বের করা দরকার।

এবার মূল কথায় আসা যাক। এই যে আমরা প্রায়শই ধর্ষণের সুষ্ঠু বিচার পাওয়া হতে বঞ্চিত হচ্ছি অর্থাৎ বিচারহীনতার সংস্কৃতির বলি হচ্ছি, এর পেছনে অন্যতম একটি কারণ হলো-আমরা আমাদের ন্যায্য নাগরিক অধিকার আদায়ের দাবিতে একমত পোষণ করতে পারছি না। অর্থাৎ যখনি আমরা একটি ধর্ষকের বিচারের দাবিতে স্ব স্ব কণ্ঠস্বর জাগ্রত করছি, তখনি এক শ্রেণির জনগণ ধর্ষকের পক্ষেই একপ্রকার সাফাই গাইছে ‘ধর্ষিতার পোশাক অশালীন ছিলো’। সুতরাং ধর্ষক এখানে নিরুপায়।

‘ধর্ষণের পেছনে যে নারীর পোশাক কোনোভাবেই দায়ী নয়, সেটা নতুন করে প্রমাণ করার কোনো প্রয়োজন আপাতত বোধ করছি না। আমার মূল বক্তব্যটি হলো-এই ভ্রান্ত ধারণার পেছনের অন্যতম একটি কারণ ধর্মান্ধতা। আমাদের দেশের তথাকথিত ধর্মগুরুরা প্রায়শই বিভিন্ন ওয়াজ মাহফিলে ধর্ষণের বিরুদ্ধে ওয়াজ নসিহত পেশ করে থাকেন। ধর্মের দৃষ্টিতে ধর্ষণ যে একটি নিকৃষ্টতম কাজ এবং মৃত্যু পরবর্তী জীবনে যে ধর্ষকের জন্য কঠোরতর শাস্তি অবধারিত রয়েছে এ ব্যাপারে তারা সবাইকে যথাযথ অবগত করেন ঠিকই, কিন্তু পাশাপাশি তারা এটি বলতেও কুণ্ঠাবোধ করেন না যে-ধর্ষণের পেছনে শুধু ধর্ষকই দায়ী নয়, ধর্ষিতাও দায়ী। কারণস্বরূপ তারা বলে থাকেন-ধর্ষিতার পোশাক অশালীন ছিল, একা একা বের হয়েছিলো বা বন্ধুদের সাথে ঘুরতে বের হয়েছিলো ইত্যাদি ইত্যাদি। ফলস্বরূপ, ধর্মান্ধ অনুসারীগণ ধর্মগুরুর কথা বিচার-বিবেচনা না করেই ধর্ষিতাকে দোষারোপ এবং ধর্ষকের সুষ্ঠু বিচারের দাবিতে দ্বিমত পোষণ করে থাকে।

দেখুন, গতবছর ফেনীতে যেই নুসরাত রাফি হত্যার ঘটনাটি ঘটলো, এর সুষ্ঠু বিচার হতে কিন্তু খুব বেশি সময় লাগেনি। কারণ এই বিচারের দাবিতে আমরা সবাই একমত ছিলাম এবং একই দাবি আদায়ে সকলে একযোগে মাঠে নেমেছিলাম। অন্যদের বেলায় কিন্তু আমরা তেমনটা করিনি। সবচেয়ে বড় আদালত আমাদের বিবেকে আমরা ধর্মান্ধতার মাপকাঠিতে রায় দিয়েছি ধর্ষকের পক্ষে। আমরা যদি এই ব্যাপার গুলোতেও সবাই একমত পোষণ করে ধর্ষকের সুষ্ঠু বিচার দাবি করতাম, মাঠে নেমে সম্ভাবনাসূচক ধর্ষকের মনে ভয়ের বীজ বপন করতাম, তাহলে হয়তো এই বিচারহীনতার সংস্কৃতি, ক্রমবর্ধমান ধর্ষণ এতোদূর এগোতো না।

তাই বলি কি, শুধু একতরফা সিস্টেমকেই দোষারোপ না করে আশেপাশের ধর্মান্ধ ব্যক্তিদের নিয়েও ভাবুন। সুশিক্ষা প্রদানের মাধ্যমে তাদের এই বদ্ধমূল গোঁড়া ধারণা থেকে বের করে নিয়ে এসে সুচিন্তিত করার প্রতি গুরুত্বারোপ করুন। প্রথমাবস্থায় সনাতন মানসিকতার পরিবর্তনই সমাজের একান্ত কাম্য। আর ধর্মান্ধতা প্রচার ও প্রসারকারীদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ান, দোষারোপ করুন। সম্ভব হলে যথাযথ সুশিক্ষার মাধ্যমে এদেরও সঠিক পথে নিয়ে আসার ব্যবস্থা করুন। এরপর আসুন একত্রে মাঠে নামি, দেখি এই বিচারহীনতার সংস্কৃতি কোথায় গিয়ে দাঁড়ায়।

লেখক: এস এম আফীফ ইবনে ইয়ার
শিক্ষার্থী, জাপানিজ স্টাডিজ বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

ইত্তেফাক/এএএম

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন