শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

সমকালীন সংকটে কার্যকর দূরশিক্ষণ প্রয়োজন

আপডেট : ১৫ অক্টোবর ২০২০, ১১:০২

সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়া কোভিড-১৯ মোকাবিলায় মানুষের নাভিশ্বাস উঠেছে। দ্রুত ছড়িয়ে পড়া রোধে পৃথিবীর প্রায় প্রতিটি দেশ লকডাউনের আশ্রয় নিয়েছে। এই লকডাউন আমাদের দৈনন্দিন জীবনের প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রে নেতিবাচক প্রভাব বিস্তার করেছে। বাংলাদেশে চলতি বছরের মার্চ মাসের প্রথম দশকে সর্বপ্রথম তিন জন কোভিড-১৯ রোগী শনাক্ত হয়। মার্চের শেষ দশক থেকে বাংলাদেশেও স্বাভাবিক জীবনও রুদ্ধ হয়ে যায়। অর্থনীতির গতি স্থবির হতে থাকে, একে একে বন্ধ হয়ে যায় অফিস-আদালত, পোশাককল ও উৎপাদনমুখী কারখানার চাকা। বন্দরে বন্দরে বন্ধ হয়ে যায় আমদানি-রপ্তানি সংক্রান্ত দৈনন্দিন কার্যক্রম। প্রবাসী শ্রমিকেরা দেশে ফিরে আটকা পড়েছেন, বাড়ছে নানামুখী বেকারত্ব, মানুষের আয় কমছে। অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী ও তুলনামূলকভাবে দুর্বল বিশ্বের প্রায় সব রাষ্ট্রই এই অদৃশ্য জীবাণুর সঙ্গে এঁটে উঠতে হিমশিম খাচ্ছে প্রতিনিয়ত। প্রায় বছর গড়াতে চললেও করোনা ভাইরাসমুক্ত পৃথিবীর প্রত্যাশা এখনো অনেক দূরের বিষয়—এমনটিই বার্তা দিচ্ছেন চিকিৎসাবিজ্ঞান ও ভাইরোলজির সঙ্গে সম্পৃক্ত ব্যক্তিরা।

চলমান এই পরিস্থিতিতে মানুষের জীবন কিছুদিন থামকে দাঁড়ালেও একেবারে থেমে নেই, নিও নরমাল বা নয়া স্বাভাবিকতা মেনে নিয়ে ধীরে ধীরে সবকিছু স্বাভাবিক হতে শুরু করেছে। কলকারখানা খুলেছে, বন্দরে পণ্য আমদানি-রপ্তানি ও খালাস ফের স্বাভাবিক হচ্ছে, পর্যটনকেন্দ্রগুলো খুলে যাচ্ছে, বিদেশি শ্রমিকেরা তাদের কর্মস্থলে যাচ্ছেন, বিভিন্ন দেশের মধ্যে আকাশযোগাযোগও প্রায় স্বাভাবিক হয়ে এসেছে। জীবনের সব অনুষঙ্গ যখন বর্তমান চ্যালেঞ্জকে মেনে নিতে শুরু করেছে, তখন শুধু শিক্ষাক্ষেত্র স্থবির থাকতে পারে না। যদিও কোভিড-১৯-এর কবলে পড়ে নাজুকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এই খাত। শিক্ষা খাত ক্ষতিগ্রস্ত হলে গবেষণা, নিত্যনতুন অবিষ্কার ও উদ্ভাবন মুখ থুবড়ে পড়তে বাধ্য।

বাংলাদেশে চলতি বছরের ১৭ মার্চ থেকে সমস্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যায়। শিক্ষার্থীদের আবাসিক হলগুলো থেকে সরে যেতে বলা হয়। সশরীরে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়। স্বল্প পরিসরে শুরু হতে থাকে অনলাইনভিত্তিক শিক্ষা বা দূরশিক্ষণ কার্যক্রম। বাংলাদেশে সরকারি, বেসরকারি ও আন্তর্জাতিক মিলিয়ে ১৫০টিরও অধিক উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান রয়েছে। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে রয়েছে অনেকগুলো বড় কলেজ। এর বাইরেও রয়েছে মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিক ও মেডিক্যাল কলেজের মতো অসংখ্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, যা কোভিড-১৯-এর প্রভাবে মারাত্মভাবে ক্ষতির মুখে পড়েছে। বিশ্বের নামী প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে তাল মিলিয়ে এবং সময়ের চাহিদা মাথায় রেখে বাংলাদেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতেও শুরু হয় অনলাইনে শিক্ষা কার্যক্রম। দূরশিক্ষণের ধারণা বহু আগে থেকে প্রতিষ্ঠিত থাকলেও সম্প্রতি তা দেশে ও বিদেশে দৃঢ় ভিত্তি পেয়েছে। জার্নাল অব কেমিক্যাল এডুকেশনে কোভিড-১৯-এর কালে দূরশিক্ষণের পদক্ষেপ, সফলতা ও ব্যর্থতা শীর্ষক সম্প্রতি প্রকাশিত এক গবেষণা প্রবন্ধে বলা হয়, করোনা ভাইরাসের কবলে পড়ে বিশ্বব্যাপী ১ দশমিক ৭ বিলিয়ন শিক্ষার্থীর শিক্ষাজীবন ক্ষতির মুখে পড়েছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে এ ধরনের পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয়নি আর।

বাংলাদেশে বেশ কয়েকটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় এপ্রিল মাস থেকে অনলাইনে ক্লাস শুরু করলেও সরকারি বড় বড় বিশ্ববিদ্যালয় এদিক থেকে পিছিয়ে রয়েছে। শুরুতে বেশির ভাগ বিশ্ববিদ্যালয়ের বেসিক লার্নিং ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম ও ডিজিটাল অবকাঠামোর অভাব ছিল। সুতরাং শুরুতে কমবেশি সব প্রতিষ্ঠানকেই হোঁচট খেতে হয়েছে। এখন মোটাদাগে সব বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ও বেশির ভাগ সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় দূরশিক্ষণ কার্যকমে ভালো করছে। বঙ্গবন্ধু ডিজিটাল বিশ্ববিদ্যালয়, নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, বুয়েট, রুয়েট, ব্র্যাক, নর্থ-সাউথ, ইনডিপেনডেন্ট বা ড্যাফোডিলের মতো কিছু বিশ্ববিদ্যালয় দূরশিক্ষণ কার্যক্রমে ভালো করছে। বেশির ভাগ সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় অনলাইনভিত্তিক শিক্ষা কার্যক্রমে কিছুটা পিছিয়ে রয়েছে। সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত একটি বড় অংশের শিক্ষার্থী প্রান্তিক পর্যায় থেকে উঠে আসা, অনেকের আর্থিক সংগতি নেই ল্যাপটপ, দামি মোবাইল বা ইন্টারনেট সংযোগ কেনার। একটি বৃহত্ অংশকে পেছনে ফেলে রেখে আরেকটি অংশকে নিয়ে এগিয়ে যাওয়ার বিষয়ে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে সংশয় শুরু থেকেই ছিল। তবু বর্তমান বাস্তবতাকে আমলে নিয়ে সরকারি-বেসরকারি সব বিশ্ববিদ্যালয় তাদের অনলাইন কার্যক্রম শুরু করেছে। করোনা ভাইরাস সংক্রমণের মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে ডিজিটালাইজ করার লক্ষ্যে তাগিদ দিয়ে আসছে, যাতে শিক্ষাদান ও শেখার কার্যক্রম অনলাইনে সুসম্পন্ন করা যায়। উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর সমন্বয়কারী সংস্থাটি কয়েকটি ধাপে ডিজিটালাইজেশনের লক্ষ্যে সময়সীমাও বেঁধে দেয়।

৪২টি বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০৩৮ শিক্ষার্থীর মধ্যে ইংরেজি দৈনিক বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড পরিচালিত একটি সমীক্ষা বলছে, বর্তমান পরিস্থিতিতে ২৩ শতাংশ শিক্ষার্থী অনলাইনভিত্তিক শিক্ষা কার্যক্রমে অংশ নিতে ইচ্ছুক। কেবল ৫৫ দশমিক ৩ শতাংশ শিক্ষার্থীর ল্যাপটপ, কম্পিউটার বা একটি ট্যাবলেটের একসেস রয়েছে, যা দিয়ে তারা অনলাইন ক্লাসে অংশ নিতে পারে। ৪৪ দশমিক ৭ শতাংশ শিক্ষার্থী ডিজিটাল ডিভাইসের অভাবে দূরশিক্ষণ কার্যক্রমে অংশ নিতে পারছে না।

সমীক্ষা যে বার্তা দিচ্ছে তা হলো, আমরা যদি অনলাইনভিত্তিক শিক্ষা কার্যক্রম শক্তিশালী করতে চাই, তবে সব শিক্ষার্থীর হাতে ডিজিটাল ডিভাইস ও শক্তিশালী ইন্টারনেট পৌঁছানোর ব্যবস্থা করতে হবে। বিশেষত প্রান্তিক পর্যায়ে থাকা শিক্ষার্থী এবং যারা আর্থিকভাবে অসচ্ছল, তাদের বিষয়ে বিশেষ নজর দেওয়ার প্রয়োজন রয়েছে। আমরা দেখছি, শিক্ষার্থীদের মধ্যে অনলাইনভিত্তিক মূল্যায়ন নিয়ে একটি সংশয়ের চিত্র উঠে এসেছে। অনলাইনভিত্তিক শিক্ষা কার্যক্রমে একটি ইউনিক মূল্যায়ন সব ক্ষেত্রে কার্যকর না-ও হতে পারে। এক্ষেত্রে ওপেন বুক এক্সাম পদ্ধতি অন্তর্বর্তী সময়ের জন্য বিবেচনায় রাখা যেতে পারে। শিক্ষাবিদেরা একটি উপযুক্ত মূল্যায়ন পদ্ধতি নিরীক্ষা করে দেখতে পারেন।

শুরুতে বাংলাদেশে অনলাইনভিত্তিক শিক্ষা কার্যক্রম চালু নিয়ে বিভিন্নমুখী আলাপ থাকলেও বর্তমানে দূরশিক্ষণ কার্যক্রমের কার্যকারিতা নিয়ে শিক্ষার্থী-অভিভাবক ও শিক্ষকদের মধ্যে উদ্বেগ তৈরি হয়েছে। দূরশিক্ষণ কার্যক্রমে আমাদের পূর্বপ্রস্তুতি নেই বলে অনেক শিক্ষক-শিক্ষার্থী সশরীরে ক্লাস কার্যক্রমের বিকল্প হিসেবে অনলাইনভিত্তিক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে চাইছে না। তবে সবাই এ বিষয়ে একমত যে শিক্ষা কার্যক্রমের ধারাবাহিকতা রক্ষায় এর চেয়ে ভালো বিকল্প আমাদের সামনে নেই। বর্তমান পরিস্থিতিতে শিক্ষকদের কর্তব্য হলো অনলাইনভিত্তিক ক্লাস গতিশীল ও আকর্ষণীয় করতে নানা ধরনের নিরীক্ষামূলক কার্যক্রমের আশ্রয় নেওয়া। জার্নাল অব কেমিক্যাল এডুকেশনে প্রকাশিত গবেষণা প্রবন্ধটির একটি সমীক্ষা বলছে, ৪১ শতাংশেরও বেশি শিক্ষার্থী মনে করে, দূরশিক্ষণে টেলিকনফারেন্সিং উপকারী। ৩৮ শতাংশ বলছে, এটি দারুণভাবে কার্যকর।

সরকারি-বেসরকারিনির্বিশেষে বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজ ও স্কুল পর্যায়ে দূরশিক্ষণ কার্যক্রমকে শক্তিশালী করে কোভিড-১৯-এর কারণে ইতিমধ্যে শিক্ষায় যে ক্ষতি হয়েছে তা পুষিয়ে নেওয়ার ব্যবস্থা গ্রহণ না করে উপায় নেই। নিয়মিত ক্লাস ও মূল্যায়নকে এই কার্যক্রমের অংশ করতে হবে। অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে দেখা গেছে, কোনো কোনো বিভাগে, কোনো কোনো ব্যাচে শিক্ষার্থীরা শুধু মাস্টার্স পরীক্ষার জন্য আটকে আছেন। কেউ কেউ রয়েছেন, যার শুধু থিসিসের ডিফেন্স বাকি। এভাবে শিক্ষার্থীদের আটকে রাখায় একদিকে বিশ্ববিদ্যালয়ে সেশনজট বাড়ছে, অন্যদিকে শিক্ষার্থীদের জীবনের মূল্যবান সময়ের অপচয় হচ্ছে। বর্তমান পরিস্থিতি মোকাবিলায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও শিক্ষকদের সর্বশক্তি বিনিয়োগের কোনো বিকল্প নেই। যেসব প্রতিষ্ঠান প্রযুক্তিবিদ্যায় ভালো, তাদের দূরশিক্ষণ কার্যক্রমের মাধ্যমে সামগ্রিক একাডেমিক কার্যক্রম কার্যকর করতে হবে। যেসব প্রতিষ্ঠানের সামর্থ্য রয়েছে সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে ক্লাস-পরীক্ষা আয়েজনের, তাদের সেই ব্যবস্থা নিতে হবে। বাংলাদেশের বেশির ভাগ সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে উন্মুক্ত প্রাঙ্গণ রয়েছে, যা এই দুর্যোগে ভূমিকা রাখতে পারে শিক্ষা কার্যক্রম এগিয়ে নিতে। সব ক্লাস যে শ্রেণিকক্ষের অভ্যন্তরে অনুষ্ঠিত হতে হবে এমন কথা নেই; কিছু কিছু ক্লাস গাছতলায়, উন্মুক্ত মঞ্চে বা শহিদ মিনারের পাদদেশে অনুষ্ঠিত হলে বরং বাড়তি আনন্দের যোগ হতে পারে। অনলাইনে বা অফলাইনে হোক, শিক্ষাকে আনন্দময় করে তোলার কোনো বিকল্প নেই। যতটুকু প্রয়োজন তার চেয়েও বেশি কিছু আয়োজন করতে না পারলে ক্লাসে শিক্ষার্থী ধরে রাখা কঠিন। যে মাধ্যমেই হোক, শিক্ষার্থীর জন্য অবাধ অভিবক্তি প্রকাশের ব্যবস্থা করা বাঞ্ছনীয়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার ‘শিক্ষার হেরফের’ প্রবন্ধে এ প্রসঙ্গে বলছেন, ‘যতটুকু অত্যাবশ্যক কেবল তাহারই মধ্যে কারারুদ্ধ হইয়া থাকা মানবজীবনের ধর্ম নহে। আমরা কিয়ৎপরিমাণে আবশ্যকশৃঙ্খলে বন্ধ হইয়া থাকি এবং কিয়ৎপরিমাণে স্বাধীন। আমাদের দেহ সাড়ে তিন হাতের মধ্যে বন্ধ, কিন্তু তাই বলিয়া ঠিক সেই সাড়ে তিন হাত পরিমাণ গৃহ নির্মাণ করিলে চলে না। স্বাধীন চলাফেরার জন্য অনেকখানি স্থান রাখা আবশ্যক, নতুবা আমাদের স্বাস্থ্য ও আনন্দের ব্যাঘাত হয়। শিক্ষা সম্বন্ধেও এই কথা খাটে।’

লেখক: সাবেক ভিসি, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন