শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

দ্রব্যমূল্য ও অর্থনীতির গতিপ্রকৃতি

আপডেট : ২১ নভেম্বর ২০২০, ০৬:১৯

পরিস্থিতি যা দেখতে পাচ্ছি, তাতে চীনের উহান থেকে আগত ‘করোনা-১৯’-এর ‘মতিগতি’ ভালো নয়। আবার সংক্রমণ বাড়তে শুরু করেছে, মৃত্যুর সংখ্যাও বাড়ছে। হাসপাতালের খালি ‘বেড’ ভরে উঠছে। তবে এরই মধ্যে বাজার ও অর্থনীতির ক্ষেত্রে বেশ কয়েকটা স্বস্তির খবর আছে। বাজারে শীতের সবজি উঠতে শুরু করেছে। দফায় দফায় বন্যায় সবজি নষ্ট হয়েছিল। তাই কিছুটা বিলম্বে হলেও নতুন সবজি উঠতে শুরু করেছে। সবেমাত্র অগ্রহায়ণ মাস শুরু হয়েছে। অচিরেই নতুন সবজিতে বাজার ভরে উঠবে। প্রত্যাশা, দোকানদাররা এখন সবজির দাম কিছুটা হলেও অন্তত কমাবেন। এখনো সবজির বাজার কিছুটা চড়া। চাল, পামওয়েল ও মসুর ডালের দামও কিছুটা বাড়তির দিকে। সবজির বাজার ছেড়ে আমরা যদি দৈনিক ইত্তেফাকসহ অন্যান্য খবরের কাগজের খবরে আসি, তাহলে বলাই যায় অর্থনীতিতে ধীরগতি হলেও একটা চাঞ্চল্য লক্ষ করা যাচ্ছে, যদিও তা সাদা চোখে অনেকের কাছে দৃশ্যমান নয়। যেমন ধরা যাক, ‘রেমিট্যান্সের’ কথা, রাজস্বের কথা, উন্নয়ন বাজেটের কথা, এমনকি ব্যাংক তারল্য বা ‘লিকুইডিটির’ কথা—সব ক্ষেত্রেই একটা ধীর অথচ ঊর্ধ্বগতি লক্ষ করা যাচ্ছে। ‘রেমিট্যান্সের’ ক্ষেত্রে তো অবিশ্বাস্য ঘটনা ঘটছে। ‘করোনা-১৯’ শুরু হওয়ার সময় আমরা সবাই আতঙ্কে লিখেছি ‘রেমিট্যান্স’-এর ক্ষেত্রে ধস নামবে। যদি তা ঘটে, তাহলে পরিস্থিতি হবে বেসামাল। কিন্তু প্রকৃতির কী খেলা ‘রেমিট্যান্স’ একের পর এক রেকর্ড ভেঙে চলেছে। তথ্যে দেখা যাচ্ছে নভেম্বর মাসের মাত্র ১২ দিনেই দেশে ‘রেমিট্যান্স’ এসেছে ১০৬ কোটি ৬০ লাখ ডলার। এক হিসাবে দেখা যায়, চলতি অর্থবছরের (২০২০-২১) ১২ নভেম্বর পর্যন্ত সময়ে দেশে মোট রেমিট্যান্স এসেছে ৯৮৯ কোটি ১০ লাখ ডলার। গত বছরের একই সময়ের তুলনায় বৃদ্ধির পরিমাণ ৪৩-৪৪ শতাংশ। ভাবা যায় গরিব কৃষকের সন্তানদের অবদানের কথা! রেমিট্যান্সের গুণে আমাদের বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভের পরিমাণ সর্বোচ্চ পর্যায়ে উঠেছে। ৪০ বিলিয়ন (১ বিলিয়ন সমান ১০০ কোটি) ডলারেরও ওপরে। আমাদের আমদানির জন্য দরকার তিন-চার মাসের টাকা। অথচ বর্তমান বৈদেশিক মুদ্রা দিয়ে আট-নয় মাসের আমদানি সম্ভব। এই মাত্রাতিরিক্ত বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভের ভালো-মন্দ দিক রয়েছে। কেউ যদি ‘ব্রিফকেস’ ভর্তি কোটি টাকা নিয়ে ঘোরাফেরা করে, তাহলে বলাই যাবে লোকটি ধনী লোক। কিন্তু এটাও বলা যাবে যে, এই নির্বোধ টাকা বিনিয়োগ করতে জানে না বলেই ‘ক্যাশ’ টাকা নিয়ে ঘুরছে। আমাদের পরিস্থিতি এমন জায়গায় চলে যেতে পারে। বৈদেশিক মুদ্রায় টানাটানি যেমন ভালো নয়, তেমনি অতিরিক্ত ‘রিজার্ভ’ও ভালো লক্ষণ নয়। হতে পারে আমদানি হচ্ছে কম, আমদানি পণ্যের মূল্য আন্তর্জাতিক বাজারে কম—অতএব ডলার খরচ হচ্ছে কম। হতে পারে শিল্পপণ্য ও মূলধনি যন্ত্রপাতি, কাঁচামাল আমদানি কিছুটা কম হচ্ছে, এই ব্যবসায় পুরোপুরি গতি আসেনি। বিষয়টি এভাবে ভেঙে ভেঙে বিবেচনা করে একটা সিদ্ধান্তে আসতে হবে। ইত্যবসরে অবশ্য আমরা দেখতে পাচ্ছি রেমিট্যান্সের উচ্চ প্রবৃদ্ধির কারণে বাজারে মাত্রাতিরিক্ত ‘তারল্যের’ সৃষ্টি হয়েছে। ‘তারল্য’ মানে ‘লিকুইডিটি’—নগদ অর্থের সরবরাহ। একটি খবরে দেখলাম বাজারে ১ লাখ ৬১ হাজার কোটি টাকার অতিরিক্ত ‘তারল্য’ আছে। এর অর্থ কী বোধগম্য নয়। মোট আমানতের একটা নির্ধারিত (বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃক) অংশের টাকা ব্যাংকগুলোকে নগদে/ট্রেজারি বন্ডে এবং বাংলাদেশ ব্যাংক নগদে রাখতে হয়। এর বেশি পরিমাণ টাকাই ‘ফর্মুলা’ মতে ‘অতিরিক্ত তারল্য’। আমি জানি না, পরিস্থিতি এমন কি না। তাহলে অবশ্যই চিন্তার বিষয়। আবার সুবিধার বিষয়ও। যেসব ব্যাংকের টাকার অভাব ছিল তারা থাকবে আনন্দে, কারণ আমানত আসবে। আবার যাদের আমানত (ডিপোজিট) আছে তাদের হবে বিপদ। তাদের বিনিয়োগযোগ্য টাকার পরিমাণ বাড়বে। বিনিয়োগটা হবে কোথায়? বেসরকারি খাত নতুন বিনিয়োগ বন্ধ রেখেছে। ‘করোনা-১৯’-এর শেষ না দেখে কেউ নতুন বিনিয়োগে যাবে বলে মনে হয় না। পরিসংখ্যানে দেখা যাচ্ছে সরকারি প্রণোদনার টাকা ছাড় দেওয়ার পরেও বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধির পরিমাণ মাত্র ৯ শতাংশ। এটা বহুদিন ধরেই একই জায়গায় রয়েছে। অথচ সরকার ‘৯-৬’ সুদনীতি প্রবর্তন করেছে বেসরকারি বিনিয়োগ বাড়ানোর জন্য। এতে আমানতকারীরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে ঠিকই, কিন্তু প্রণোদনা সত্ত্বেও বেসরকারি বিনিয়োগ কোনোমতেই বাড়ছে না। বাজারে টাকার কোনো চাহিদাই নেই। টাকার চাহিদা মধ্যবিত্তের, গরিবের, নিম্নবিত্তের, চাকরিচ্যুত, বেকার ও ব্যবসাচ্যুত লোকদের। তাদের ‘মানি’ দরকার সংসার চালানোর জন্য—বাড়িভাড়া, ভোগ্যপণ্য ক্রয় ইত্যাদির জন্য। কিন্তু শিল্প ও ব্যবসায়ক্ষেত্রে টাকার চাহিদা কেন বাড়ছে না তা দেখার বিষয়। কাগজে দেখলাম ‘কলমানি’র হার সর্বনিম্ন। ‘কলমানি’ হচ্ছে আন্তঃব্যাংক লেনদেন। যে ব্যাংকের টাকা বেশি আছে সেই ব্যাংক ‘টানাটানির’ ব্যাংককে খুবই স্বল্প সময়ের জন্য ধার দেয়। এই বাজার সাধারণত ‘সরগরম’ থাকে। লেনদেন হয় প্রচুর। এই ‘লেনদেন’ বিভাগে যারা কাজ করে তারা থাকে ব্যস্ত। শুধু ‘কলমানি’ মার্কেটেই নয়, ‘ট্রেজারি বিলে’ও আয় (ইল্ড) কম। ট্রেজারি বিলের মাধ্যমে সরকার ঋণ নেয়। আজকাল শুনছি ‘বন্ডের’ মাধ্যমে সরকার এবং বেসরকারি লোকজনদের কাছ থেকেও সরকার ঋণ নেয়। কিন্তু এখানেও ভাটা পড়েছে। সরকার বাজার থেকে ঋণ নিচ্ছে কম। কারণ রাজস্বে অর্থাত্ রাজস্ব আদায়ে পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হয়েছে। লক্ষ্যমাত্রামাফিক রাজস্ব আদায় হচ্ছে না। এর কারণ অনেক। অতিরিক্ত লক্ষ্যমাত্রা একটা খুবই বড় কারণ। বর্তমান ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে, ২০২০-২০২১ অর্থবছরের জুলাই থেকে অক্টোবরের মধ্যে রাজস্ব আদায় হয়েছে ৬৬ হাজার ৫৫৫ কোটি টাকা। লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ২০ হাজার কোটি টাকা কম। দৃশ্যত খুবই খারাপ পরিস্থিতি। কিন্তু অর্থনীতির ‘ঘুরে দাঁড়ানোর’ দৃষ্টিতে এই ‘পারফরম্যান্স’ ভালোই। কারণ গেল বছরের তুলনায় রাজস্ব বেড়েছে ১ দশমিক ১৪ শতাংশ। এর অর্থ কী? এর অর্থ অর্থনৈতিক ‘পারফরম্যান্সের’ পর্যায় গেল বছরের জায়গায় অন্তত পৌঁছেছে, তবে লক্ষ্যমাত্রামাফিক হয়নি। এই তথ্যের সঙ্গে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) তথ্যের বেশ কিছুটা মিল আছে। দৈনিক ইত্তেফাকের খবরে শিরোনাম ‘চার মাসে এডিপি বাস্তবায়ন হয়েছে ১২ দশমিক ৭৯ শতাংশ। শুধু অক্টোবরে খরচ হয়েছে এডিপির ১০ হাজার ১৫১ কোটি টাকা।’ ইত্তেফাকের রিপোর্ট বলছে, বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) বাস্তবায়নে গতি ফিরতে শুরু করেছে। আগের বছরের তুলনায় টাকা খরচের পরিমাণ কিছুটা কম। কিন্তু বোঝা যাচ্ছে ‘করোনা-১৯’-এর কারণে উন্নয়ন কর্মসূচি বাস্তবায়নে যে স্থবিরতা দেখা দিয়েছিল তা কাটতে শুরু করেছে। এই প্রবণতা যদি অব্যাহত থাকে, তাহলে এটা শুভ লক্ষণ হবে। কারণ আমরা উন্নয়নের জন্য সরকারি বিনিয়োগের ওপর বেশি ভরসা করি। গেল কয়েক বছর যাবত্ বেসরকারি বিনিয়োগ স্থবিরাবস্থায় আছে কিন্তু সরকারি বিনিয়োগ বাড়ছে। তাই বলা যায় ‘এডিপি’ বাস্তবায়নে গতি ফিরলে আখেরে আমাদের ভালোই।

এবারে একটি ভালো খবর দিচ্ছি। দৈনিক ইত্তেফাকের (১৭-১১-২০) খবরের শিরোনাম ‘ফলের উত্পাদন ও আমদানি দুটোই বেড়েছে, স্বাস্থ্য সুরক্ষায় বেড়েছে ফল খাওয়ার প্রবণতা’। আমাদের স্বাস্থ্য রক্ষার জন্য, শরীরের বিভিন্ন ভিটামিন চাহিদা মেটানোর জন্য প্রতিদিন নির্দিষ্ট পরিমাণ ফল খাওয়া দরকার। শুধু ফল নয় শাকসবজি, মাছ-মাংস, দুধ ইত্যাদিও খেতে হয়। চাল/গম তো লাগবেই। এসবই স্বাস্থ্যের জন্য দরকার। দরকার সমন্বিত খাদ্য/খাবার। একটা খেলাম অন্যটা খেলাম না—তাতে চলে না। সব জিনিসই খেতে হয়। এই প্রেক্ষাপটে ফল গ্রহণ বৃদ্ধির খবর খুবই আশাপ্রদ। আমাদের ছোটবেলায় দেখেছি অনেকেই ফল সম্পর্কে ভুল ধারণায় ভুগত। অনেকেই মনে করত, ফলমূল হচ্ছে রোগীদের জন্য। হাসপাতালে অথবা বাড়িতে রোগী দেখতে গেলে ফল নিয়ে যাওয়া ছিল একটা রেওয়াজ। ফল খাওয়ার গুণ সম্পর্কে আমরা তখন সচেতন ছিলাম না। কিন্তু এখন এই দৃষ্টিভঙ্গিতে আমূল পরিবর্তন হয়েছে। আজকের দিনে গ্রামের হাটবাজারেও ফলমূলের দোকানে ভর্তি। দেশি ফলমূল যেমন আছে তেমনি আছে বিদেশি ফলমূল। এই খবরই দিচ্ছে ইত্তেফাকের রিপোর্টার। গত পাঁচ বছরে ফলের উত্পাদন দেশে বেড়েছে ২২ লাখ টন। অন্যদিকে একই সময়ে ফলের আমদানি বেড়েছে ২ লাখ ১৬ হাজার ৮৬৪ টন। এতে মাথাপিছু দৈনিক ফলপ্রাপ্তি/ভোগ বেড়েছে প্রায় দেড় গুণ। মাথাপিছু দৈনিক ভোগ ছিল ৫৫ গ্রাম, এখন তা ৭৬ গ্রাম। কিন্তু মুশকিল হচ্ছে আমাদের দরকার ১ হাজার ১১৫ গ্রাম। তার অর্থ ফলমূলের উত্পাদন আমাদের আরো বাড়াতে হবে। একইভাবে বাড়াতে হবে শাক, সবজি, মাছ-মাংস ও দুধ-ডিমের উত্পাদন। চালের উত্পাদন সাড়ে তিন গুণ বেড়েছে। তবু বলা হচ্ছে এবার ৪ লাখ টন চাল আমদানি করা হবে। সরকারি গুদামে এবার চালের স্টক কম। এখানেই প্রশ্ন, মানুষ এখন নিয়মিত গমের রুটি খায়। ফলমূল, শাক-সবজি, মাছ-মাংস ও দুধের উত্পাদন যেমন বেড়েছে তেমনি বেড়েছে এসবের ভোগ। যদি তাই হয়, তাহলে স্বাভাবিকভাবেই চালের ওপর চাপ পড়ার কথা কম। যে চাল আমরা উত্পাদন করি তাতে আমাদের হয়ে যাওয়ার কথা। আমাদের ৫০ লাখ টন চাল উদ্বৃত্ত থাকার কথা। পরিকল্পনা কমিশনের সিনিয়র সচিব শামসুল ইসলাম সাহেব (২৩.১০.২০) বলেছেন, জনপ্রতি চালের যে ভোগ দেখানো হচ্ছে তা উপাদনের সঙ্গে মেলালে আমাদের ৫০ লাখ টন চাল উদ্বৃত্ত থাকার কথা। এ প্রেক্ষাপটে চাল, ভোগ্যপণ্য, ফলমূল, শাকসবজি, মাছ-মাংস, ডিম-দুধের একটা নির্ভরযোগ্য হিসাব দরকার।

লেখক : অর্থনীতিবিদ ও সাবেক শিক্ষক,
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন