বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

এটা বাইরের নয়, ঘরের ইঁদুরের কাজ

আপডেট : ২২ নভেম্বর ২০২০, ০৭:২৯

শেষ পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে, ঘরের মানুষই বিভীষণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে। তারা কারা তা অনুমান করা যাচ্ছে। কিন্তু তাদের গোপন চেহারাটি এখনো বাইরে বেরিয়ে আসেনি। আওয়ামী লীগ দল এবং সরকার যদি আন্তরিকতার সঙ্গে তত্পর হয়, তাহলে এই বিভীষণদের ধরা পড়তে দেরি হবে না। অভিযোগ উঠেছে, বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষ্যে আয়োজিত জাতীয় সংসদের বিশেষ অধিবেশনে বঙ্গবন্ধুর যে ভাষণ প্রচার করা হয়েছে, তাতে ধর্মনিরপেক্ষতা প্রসঙ্গে বঙ্গবন্ধুর যে মূল বক্তব্য ছিল তা বাদ দিয়ে ভাষণটি প্রচার করা হয়েছে।

এই খবর পাঠ করে অনেকেরই মাথা ঘুরে যাবে। বিএনপি-জামায়াত সরকারের আমলে নয়, এমনকি নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলেও নয়, একেবারে আওয়ামী লীগের ডাইরেক্ট শাসনের সময় জাতির পিতার ভাষণ কর্তন? এমন ‘রাষ্ট্রদ্রোহমূলক’ কাজটি কে বা কারা করতে পারে? বিএনপি-জামায়াত নিশ্চয়ই নয়। তারা তাদের শাসনামলে বঙ্গবন্ধুর ভাবমূর্তি নষ্ট করার অনেক চেষ্টা করেছে, কিন্তু তার ভাষণে হাত দেওয়ার মতো সাহস ও সুযোগ সম্ভবত পায়নি। যদি পেত, তাহলে বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭ই মার্চের ভাষণই তারা গায়েব করে দিত। তা না পেরে তারা কিছু বুদ্ধিজীবীকে দিয়ে বলানোর চেষ্টা করেছিল, ৭ই মার্চের ভাষণে বঙ্গবন্ধু জয় পাকিস্তান বলেছেন। এটা যে মিথ্যা প্রচার তা প্রমাণিত হতে দেরি হয়নি।

এখন আওয়ামী লীগের শাসনামলে জাতীয় সংসদে বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষ্যে তার ভাষণ প্রচার করতে গিয়ে ধর্মনিরপেক্ষতা সম্পর্কিত অংশটি যারা বাদ দিয়েছে, তারা ঘরের ইঁদুর বলেই আমার বিশ্বাস। বাইরের কারোর যে এই ভাষণ কর্তন করার মতো সাহস হতো না, তা আগেই বলেছি। বেছে বেছে ধর্মনিরপেক্ষতা সম্পর্কিত অংশটি বাদ দেওয়ায় আমার মনে সন্দেহ আরো দৃঢ় হয়েছে—এটা নব্য আওয়ামী লীগারদের মধ্যে যারা সাম্প্রদায়িকতামনা এবং বিএনপি ও জামায়াতের মতো ধর্মনিরপেক্ষতাকে ধর্মহীনতা মনে করে, এটা তাদের কাজ। এটা এখন করা হয়নি। আওয়ামী লীগ সরকার নিজেরাই যখন ’৭২-এর সংবিধানে উল্লেখিত রাষ্ট্রের চার মূল স্তম্ভের একটি ধর্মনিরপেক্ষতাকে পুনর্যোজনা না করে ‘সকল ধর্মের প্রতি সমান আচরণ’ কথাটি গ্রহণ করে, তখন দলের ইঁদুরেরা সুযোগ পেয়ে সম্ভবত বঙ্গবন্ধুর ভাষণের এই অংশ কর্তন করেছে।

সেজন্যই সংসদের স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরীর দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে একটি গণমাধ্যমকে তিনি বলেন, ‘বঙ্গবন্ধুর ভাষণের অডিও ভার্সনটি বাংলাদেশ বেতার থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। সংসদে এটার কোনো কিছুতেই হাত দেওয়া হয়নি।’ এ ব্যাপারে বাংলাদেশ বেতারের মহাপরিচালক হোসনে আরা তালুকদার বলেছেন, ‘তিনি নিশ্চিত হয়েছেন, বেতারের আর্কাইভে যে রেকর্ডটি রয়েছে, সেটিই সংসদে বাজিয়ে শোনানো হয়েছে। যে অংশটুকু বাদ পড়েছে বলে অভিযোগ এসেছে, সেই অংশটুকু রেকর্ডে নেই।’ অর্থাত্ এই কর্তনের কাজটুকু সাম্প্রতিক কালের নয়।

জিয়াউর রহমান সংবিধান থেকে অবৈধভাবে রাষ্ট্রীয় চার মূলনীতির দুটি ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্রকে বাদ দিয়েছিলেন। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসে এ দুটিকে আর সংবিধানে পুনঃস্থাপন করেনি। সেই সময়েই আওয়ামী লীগের সাম্প্রদায়িকতামনা ও ডানপন্থি অংশটি এ কাজ করেছে। আমার ধারণা, তারা রাষ্ট্রাদর্শ হিসেবে ধর্মনিরপেক্ষতা আবার ফিরে আসতে পারে এই ভয়ে জাতির পিতার ভাষণ থেকে ধর্মনিরপেক্ষতা সম্পর্কিত অংশটি কর্তন করে এই আদর্শ যে বঙ্গবন্ধুরই আদর্শ ছিল তার প্রমাণ মুছে ফেলার চেষ্টা করেছে। বেছে বেছে ভাষণের ধর্মনিরপেক্ষতা সম্পর্কিত অংশটি কর্তিত হওয়ায় এটা যে ভাষণটি রিরেকর্ডিং করার যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে অথবা ভুলবশত হয়নি তা বোঝা যায়।

বঙ্গবন্ধুর ভাষণে ধর্মনিরপেক্ষতা সম্পর্কে যে মূল বক্তব্য ছিল তা হলো, ‘জনাব স্পিকার, ধর্মনিরপেক্ষতা মানে ধর্মহীনতা নয়। বাংলার সাড়ে সাত কোটি মানুষের ধর্মকর্ম করার অধিকার থাকবে। আমরা আইন করে ধর্মকে বন্ধ করতে চাই না এবং করবও না। মুসলমানেরা তাদের ধর্ম পালন করবে, তাদের বাধা দেওয়ার ক্ষমতা এই রাষ্ট্রের কারো নেই। হিন্দুরা তাদের ধর্ম পালন করবে, কারো বাধা দেওয়ার ক্ষমতা নেই। বৌদ্ধরা তাদের ধর্ম পালন করবে, কেউ তাদের বাধাদান করতে পারবে না। খ্রিষ্টানরা তাদের ধর্ম পালন করবে, কেউ তাদের বাধা দিতে পারবে না।’

জাতির পিতার ভাষণ নিয়ে যে এত বড় একটি অপরাধ করা হলো, এটা আওয়ামী লীগের কোনো নেতা ও মন্ত্রীর চোখে পড়েনি। কিন্তু ধরা পড়েছে যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক গবেষক মাহবুবুর রহমান জালালের এবং সুইজারল্যান্ড প্রবাসী ব্লগার অমি রহমান পিয়ালের চোখে। তারা ফেইসবুকে তাদের প্রতিক্রিয়া জানান এবং এ ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনারও দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। বঙ্গবন্ধুর ভাষণ থেকে ধর্মনিরপেক্ষতা সম্পর্কিত অংশটি যে ভুলক্রমে বাদ পড়েনি বরং ইচ্ছাকৃতভাবে এডিট করার দুঃসাহস দেখানো হয়েছে, সে কথাও পিয়াল বলেছেন। তার মতে, ‘অডিওর সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর যেসব ছবি ব্যবহার করা হয়েছে, তা দেখে তার মনে হয়েছে ভাষণ থেকে ধর্মনিরপেক্ষতার প্রসঙ্গ ভুলক্রমে বাদ পড়েছে, এটা ইচ্ছাকৃত এডিট।’ অর্থাত্, বঙ্গবন্ধুর ভাষণ সম্পাদনা করা হয়েছে।

১৯৭২ সালের ৪ নভেম্বর জাতীয় সংসদে বঙ্গবন্ধু এই ভাষণ দিয়েছিলেন। তাতে তিনি রাষ্ট্রের মূল চারটি ভিত্তি—গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ ও সমাজতন্ত্রের বিশদ ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন। বিস্ময়ের কথা এই যে, সমাতজন্ত্র সম্পর্কেও বঙ্গবন্ধুর ভাষণ থেকে কিছু কথা বাদ দেওয়া হয়েছে। এখন প্রশ্ন, জাতির পিতার বক্তব্য এডিট করার এই দুঃসাহস কারা, কবে, কখন করেছে তা তদন্ত করে দ্রুত জানা দরকার। তারপর তার বিহিতব্যবস্থা করার দায়িত্ব আওয়ামী লীগ সরকারের এবং প্রধানমন্ত্রীর।

যারা এই অপরাধ করেছে, তারা আওয়ামী লীগার হলে হয়তো যুক্তি দেখাতে পারে, আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় এসে যেহেতু রাষ্ট্রের দুটি মূল আদর্শ ধর্মনিরপক্ষেতা ও সমাজতন্ত্র কথা দুটি সংবিধানে পুনঃসংযোজন করেনি, সেহেতু তারা জাতির পিতার ভাষণ থেকে এসংক্রান্ত কথা বাদ দিয়েছে, তাহলেও তাদের অপরাধ লঘু হয় না। দেশের সংবিধান জনগণের ইচ্ছা ও চাহিদা অনুযায়ী সংশোধিত হতে পারে। কিন্তু রাষ্ট্রের স্থপিত ও জাতির পিতার বক্তব্য তার অবর্তমানে সংশোধন বা এডিট করার অধিকার কারো নেই। প্রধানমন্ত্রীর উচিত হবে এ ব্যাপারে অবিলম্বে সুষ্ঠু তদন্তের ব্যবস্থা করা এবং যদি প্রমাণিত হয় দোষী ব্যক্তিরা তারই দলের লোক এবং সঙ্গে রয়েছে তাদের সমমনোভাবের কিছু আমলা, তাহলে তাদের বিরুদ্ধেও যথোচিত ব্যবস্থা গ্রহণে দ্বিধা করা ঠিক হবে না।

সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রীর পুত্র সজীব ওয়াজেদ জয় বলেছেন, ‘ধর্মনিরপেক্ষতা আমাদের রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাকালীন আদর্শ। এই আদর্শ থেকে সরে যাওয়ার প্রশ্নই ওঠে না।’ আমার ধারণা, জয়ের এই কথা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনারই মনোভাবের প্রতিফলন। ধর্মনিরপেক্ষতার রাষ্ট্রীয় আদর্শ যদি আওয়ামী লীগ দৃঢ়ভাবে ধারণ না করে, তাহলে স্বাধীন ও অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার মূল উদ্দেশ্যই ব্যর্থ হয়ে যাবে। গণতন্ত্রও টিকিয়ে রাখা যাবে না।

অসাম্প্রদায়িক ও ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শ প্রতিষ্ঠার জন্য বঙ্গবন্ধুকে দীর্ঘকাল সংগ্রাম করতে হয়েছে। প্রথমে তিনি ছাত্রলীগকে অসাম্প্রদায়িক প্রতিষ্ঠানে রূপান্তরিত করেন। ১৯৫৫ সালে আওয়ামী লীগ সাম্প্রদায়িক খোলস ত্যাগ করে অসাম্প্রদায়িক প্রতিষ্ঠানে রূপান্তরিত হয়। এর পেছনে ছিল মওলানা ভাসানী ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের উদ্যোগ এবং দৈনিক ইত্তেফাকের রাজনৈতিক মঞ্চে তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়ার লেখনী।

ব্রিটিশ আমল থেকে পাকিস্তান আমল পর্যন্ত দেশে প্রচলিত ছিল নির্বাচন পদ্ধতিতে ধর্মীয় বিভাজন, অর্থাত্ স্বতন্ত্র নির্বাচন। নির্বাচনে বিভিন্ন ধর্মের লোকের স্বতন্ত্রভাবে ভোটদানের ব্যবস্থা। তাতে ঐক্যবদ্ধ গণতান্ত্রিক জাতি গঠন হয় না। পাকিস্তানে যুক্ত নির্বাচন প্রবর্তনের আন্দোলন শুরু করেন শেখ মুজিব ও মওলানা ভাসানী। তাতে জোরালো সমর্থন দেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী। পাকিস্তান সরকার যুক্ত নির্বাচন পদ্ধতি মেনে নিতে বাধ্য হয়। গড়ে ওঠে পাকিস্তানে, বিশেষ করে পূর্ব পাকিস্তানে (বর্তমান বাংলাদেশ) ধর্মনিরপেক্ষ রাজনীতির ভিত্তি।

বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ পুনর্গঠিত হলে ধর্মনিরপেক্ষতাকে চারদলীয় আদর্শের অন্যতম আদর্শ হিসেবে ঘোষণা করা হয়। ’৭১ সালে মুক্তিযোদ্ধারা এই চার আদর্শ প্রতিষ্ঠার জন্য যুদ্ধ করেছেন এবং প্রাণ দিয়েছেন। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ধর্মনিরপেক্ষতাসহ চার আদর্শ রাষ্ট্রের মূলনীতি বলে গৃহীত হয়। ধর্মনিরপেক্ষতা এই চার মূল আদর্শের একটি। এর বিরোধিতা জাতির পিতার সিদ্ধান্ত এবং মুক্তিযুদ্ধের আদর্শের বিরোধিতা। এই বিরোধিতা যারা করেন, তারা বঙ্গবন্ধুর অনুসারী হতে পারেন না।

[ লন্ডন, ২১ নভেম্বর, শনিবার, ২০২০ ]

ইত্তেফাক/এএএম

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন