বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

দেশের উন্নয়নে সর্বাগ্রে প্রয়োজন রাজস্ব আয় বৃদ্ধি

আপডেট : ২৪ নভেম্বর ২০২০, ১১:১৪

আগামী ৩০ নভেম্বর রাজস্ব আয় আদায়ের শেষ দিন। ২০২০-২১ অর্থবছরের আয়কর আদায়ের চিত্রটা খুব বেশি সন্তোষজনক হবে বলে মনে হয় না। কারণ বিশ্বব্যাপী জীবনঘাতী কোভিড-১৯-এর কারণে কর মেলা অনুষ্ঠিত না হওয়ায় অনেকে আয়কর প্রদানে আগ্রহী হবেন বলে মনে হয় না। কর মেলা কর আদায়ের জন্য একটি যথাযোগ্য ও অনুপ্রেরণাকর মেলা ছিল, যেখানে নির্বিঘ্নে কোনো ঝামেলা ছাড়াই স্বাচ্ছন্দ্যে উত্সাহ-উদ্দীপনা নিয়ে করদাতারা তাদের করবিবরণী জমা দিতে পারতেন। এ ছাড়াও নতুন করদাতারা অত্যন্ত আগ্রহ নিয়ে আসতেন এ মেলায়। দেশের অধিকাংশ সচেতন নাগরিক কর প্রদানের জন্য কর মেলাতে ভিড় জমাতেন। 

২০১৮ সালের ৪ নভেম্বর পত্রিকায় প্রকাশিত এক তথ্য থেকে জানা যায়, প্রতিবছর দেড় লাখ তরুণ করদাতা নতুন করে কর প্রদান করছেন। অর্থাৎ তারা টিআইএনধারী হচ্ছেন। তার মানে কর প্রদানের ক্ষেত্রে তরুণদের আগ্রহ বাড়ছিল। পত্রিকায় প্রকাশিত তথ্য থেকে জানা যায়, ২০১৮ সালে কর্মক্ষম মানুষের সংখ্যা ছিল ৬ কোটি ৩৪ লাখ। কাজ করেন ৬ কোটি ৮ লাখ। ১৫ থেকে ২৯ বছর বয়সি কর্মক্ষম মানুষ ১ কোটি ৮০ লাখ। গত বছরের ১০ নভেম্বর পত্রিকায় প্রকাশিত তথ্য থেকে জানা যায়, করযোগ্য মানুষের সংখ্যা ৪ কোটি কিন্তু কর দিচ্ছেন মাত্র ২১ লাখ মানুষ। উল্লেখ্য, প্রকৃত করদাতার সংখ্যা নিয়ে বিভিন্ন পত্রিকায় বিভিন্ন রকম তথ্য পাওয়া যায়। গত বছরেই বলা হয়েছে আগামী ৩ বছরে ১ কোটি মানুষকে করের আওতায় আনার পরিকল্পনা রয়েছে। কাজেই এ বছরের হিসাব দেখলে বোঝা যাবে আগামী দুই বছরে কতজনকে করের আওতায় আনা যাবে। জানা যায়, টিআইএনধারীর সংখ্যা বাড়লেও সে অনুপাতে রিটার্ন জমার সংখ্যা বাড়ছে না। আইনগত কিছু বাধ্যবাধকতার কারণে টিআইএনধারীর সংখ্যা বাড়ছে। বাণিজ্যিক কার্যাদিসহ জমি, ফ্ল্যাট বেচাকেনা, ট্রেড লাইসেন্স, গ্যাস, বিদ্যুতের সংযোগ, বিল প্রদান ইত্যাদি ৩৩ ধরনের বিভিন্ন কাজে টিআইএন বাধ্যতামূলক করায় টিআইএন বাড়ছে। কিন্তু প্রকৃত অর্থে যে কারণে টিআইএন নম্বর দেওয়া হয়, সেটা না করায় রাজস্ব আয় যে পরিমাণ আদায় হওয়ার কথা সে পরিমাণ হচ্ছে না। এসব নজরদারি বা দেখভাল করার কথা জাতীয় রাজস্ব বোর্ড বা এনবিআরের। এনবিআরের তথ্যমতে ২০১৮ সালে টিআইএনধারীর সংখ্যা ছিল ৩৭ লাখ এবং ২০১৯ এ ৪৫ লাখের বেশি। কিন্তু রিটার্ন জমা দিয়েছেন মাত্র ২১ লাখ। তাদের হিসাব মতে, টিআইএনধারীদের মধ্যে ১৬ লাখ ব্যক্তিই রিটার্ন জমা দেননি। বিগত বছরে বেসরকারি প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের তথ্যমতে করযোগ্য হওয়ার পরও দেশের ৬৮ শতাংশ মানুষ কর দেন না। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের এক জরিপে বলা হয়েছে, দেশে করযোগ্য মানুষ রয়েছে ৪ কোটি কিন্তু কর দেন মাত্র ১৬ লাখের কিছু বেশি। ৩২ শতাংশ মানুষ নামমাত্র কর দেন। করযোগ্য হওয়ার পরও কর ফাঁকি দিচ্ছেন। এটা একটা ভীতিকর তথ্য। উল্লিখিত ৬৮ শতাংশ মানুষকে করজালের আওতায় আনতে পারলে দেশের অর্থনীতিতে একটা বিরাট পরিবর্তন আসবে। আমাদের অর্থনীতি এগিয়ে যাচ্ছে। জীবনযাত্রার মান আগের তুলনায় অনেক বেড়েছে। মাথাপিছু আয় ২ হাজার ডলারেরও বেশি বাড়াতে করযোগ্য মানুষের সংখ্যাও বেড়েছে কিন্তু রাজস্ব আয় যে হারে বাড়ার কথা সে হারে বাড়ছে না। কারণ করযোগ্য আয়ের ব্যক্তিদের অনেকেই কর দিচ্ছেন না। দেশের জিডিপি অনুপাতে কর আদায় মাত্র ১০ শতাংশ। করযোগ্য আয়ের ব্যক্তিদের খুঁজে বের করে তাদের করজালের আওতায় আনতে জরুরি ভিত্তিতে পদক্ষেপ গ্রহণ করা প্রয়োজন। যারা করযোগ্য হওয়ার পরও কর ফাঁকি দিচ্ছেন, তাদেরকে আইনের আওতায় আনতে হবে। 

পত্রিকান্তরে জানা যায়, রাজস্ব আয় সংগ্রহের জন্য নিযুক্ত একমাত্র প্রতিষ্ঠান এনবিআর থেকে রাজস্ব আয় আসে ৬৪ শতাংশ বাকি ৩৬ শতাংশ আসে এনবিআরবহির্ভূত খাত থেকে। তার পরও রাজস্ব আয় সংগ্রহের কাজে যারা নিয়োজিত আছেন তাদের মধ্যে অনেকেই অনৈতিকভাবে কাজ করেন। তারা সরকারি প্রতিষ্ঠানে নিযুক্ত হয়ে সরকারের বা জনগণের সেবায় কাজ না করে নিজেদের আখের গোছাতেই ব্যস্ত থাকেন। যারা কর দিতে যান তাদের কাছে উেকাচ দাবিসহ বিভিন্নভাবে হয়রানি করা হয়, এটা এ দেশের অধিকাংশ মানুষই জানেন। ১৯ নভেম্বর ২০২০ তারিখে বড় বড় হেডলাইনে পত্রিকায় প্রকাশিত ‘অর্থ পাচারেও শীর্ষে সরকারি কর্মকর্তারা’। সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ নতুন কোনো বিষয় নয়। সরকারি কর্মকর্তা এমনকি কর্মচারীরাও দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জিত কোটি কোটি টাকা বিদেশে পাচার করে দেশের অর্থনীতিকে ঝুঁকির মুখে ফেলেছেন। এসব বিভিন্ন কারণে আমাদের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী দুর্নীতির বিরুদ্ধে রীতিমতো যুদ্ধ ঘোষণা করেছেন। সবচেয়ে বড় কথা, এনবিআরের এত স্বল্পসংখ্যক জনবল দিয়ে জনসংখ্যাবহুল এদেশের করযোগ্য আয়ের ৪ কোটি মানুষকে করজালের আওতায় আনা কোনোক্রমেই সম্ভব হবে বলে মনে হয় না। সরকারের এ বিষয়টির দিকে লক্ষ রাখা বিশেষ প্রয়োজন। আমরা খুব ভালো করেই জানি, রাজস্ব আয়ের ওপরই নির্ভর করে দেশের উন্নয়ন। রাজস্ব আয় প্রয়োজন অনুযায়ী বৃদ্ধি না পাওয়ার ফলে সরকারকে ব্যাংক, বিমা বা অর্থলগ্নিকারী প্রতিষ্ঠান কিংবা দাতা সংস্থার ওপর নির্ভর করতে হয়, ঋণ গ্রহণ করতে হয়। করযোগ্য ব্যক্তিরা যদি দেশের উন্নয়নে এগিয়ে আসতেন, তাহলে রাজস্ব আয় বৃদ্ধি পেত। সরকারকে আর অন্য কারো ওপর নির্ভর করতে হতো না। দেশের সার্বিক উন্নয়ন দ্রুত ত্বরান্বিত হতো, এটা বলার অপেক্ষা রাখে না। তাই সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোকে কাজে লাগাতে হবে। সরকারি প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান যাতে কর প্রশিক্ষণ, করসচেতনতা বৃদ্ধি, কর গবেষণাসহ, অনলাইন কর প্রদান প্রশিক্ষণ ইত্যাদি তথ্যপ্রযুক্তির সর্বোচ্চ ব্যবহার করে বিভিন্ন ধরনের উন্নয়নমূলক কাজ করতে পারে, সে ব্যাপারে সরকারকে সার্বিক সহযোগিতা প্রদানে এগিয়ে আসতে হবে। 

জানামতে, দেশে কর সংগ্রহ কার্যক্রম বৃদ্ধির জন্য ‘ফাউন্ডেশন অব চাটার্ড ট্যাক্সেশন অব বাংলাদেশ (এফসিটিবি)’ নামে একটি অলাভজনক প্রতিষ্ঠান জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের অনুমোদন নিয়ে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে। শুধু সরকারের রাজস্ব আয় বৃদ্ধিই নয়, এর পাশাপাশি দেশে কর্মসংস্থান সৃৃষ্টির জন্য কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের সদ্য পাশ করা শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে মেমোরেন্ডাম অব আন্ডারস্ট্যান্ডিংয়ের মাধ্যমে ছয় মাসের পোস্ট গ্র্যাজুয়েট ডিপ্লোমা ডিগ্রি প্রদান করছে, যাতে করে তারা চাকরির জন্য মরিয়া না হয়ে ঘরে বসেই অনলাইন কার্যক্রমের মাধ্যমে সরকারকে সহযোগিতা প্রদানের পাশাপাশি নিজেরাই স্বাবলম্বী হতে পারে, যা অত্যন্ত আশাব্যঞ্জক। এফসিটিবির কার্যক্রম সম্পর্কে এনবিআর এবং অর্থ মন্ত্রণালয়ের অনেক কর্মকর্তা অবগত আছেন। কাজেই দেশের সার্বিক উন্নয়ন ত্বরান্বিত করতে রাজস্ব আয় বৃদ্ধির জন্য করযোগ্য ব্যক্তিদের করজালের আওতায় আনার পাশাপাশি নতুন করদাতা চিহ্নিতকরণ, কর সচেতনতা, কর গবেষণা, কর প্রশিক্ষণ ইত্যাদি কাজ সুষ্ঠুভাবে সম্পাদনের জন্য আর দেরি না করে ফাউন্ডেশন অব চাটার্ড অ্যান্ড ট্যাক্সেশন অব বাংলাদেশ (এফসিটিবি)-এর মতো বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোকে সার্বিক সহযোগিতা প্রদানের মাধ্যমে এগিয়ে আনতে হবে। কাজেই আর দেরি না করে দেশের বৃহত্তর স্বার্থে দেশের উন্নয়নে সরকার সার্বিক সহযোগিতার মনোভাব নিয়ে রাজস্ব আয় বৃদ্ধিতে এগিয়ে আসবে, এটাই আমাদের প্রত্যাশা।

লেখক :গবেষক ও অর্থনীতিবিষয়ক বিশ্লেষক, সাবেক মহাব্যবস্থাপক, বিসিক

ইত্তেফাক/কেকে

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন