মঙ্গলবার, ১৯ মার্চ ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

শীতকালীন করোনা: লকডাউন হবে বাংলাদেশ?

আপডেট : ২৪ নভেম্বর ২০২০, ১৫:১৪

ইউরোপের অনেক দেশেই করোনা ভাইরাস সংক্রমণের হার একবার কমে আসার পরে আবার বাড়তে শুরু করেছে—যাকে বলা হচ্ছে ‘সেকেন্ড ওয়েভ’। আবার আমেরিকার ক্ষেত্রে সংক্রমণ পুরোপুরি না কমেও নতুন করে সংক্রমণের হার বেড়ে গেছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্দেশনা অনুযায়ী সংক্রমণের হার যখন পাঁচ শতাংশে নেমে আসে এবং সেটি অন্তত তিন সপ্তাহ ধরে একই অবস্থায় থাকে, সে অবস্থাকে করোনা ভাইরাসের প্রথম ওয়েভ শেষ হওয়া বলা যাবে। 

বাংলাদেশে নভেম্বরের তৃতীয় সপ্তাহে এসে হঠাৎ করে আবার একদিনে শনাক্ত রোগী ও মৃত্যুর সংখ্যা বেড়েছে। এর আগে গত দুই মাসের বেশি সময় ধরে করোনা ভাইরাসের নমুনা পরীক্ষা, আক্রান্ত রোগী শনাক্ত ও মৃত্যুর হার একটু একটু করে কমে আসছিল। যদিও নমুনা পরীক্ষার তুলনায় সংক্রমণ শনাক্তের হার কখনোই দশ শতাংশের নিচে নামেনি।

বাংলাদেশে লকডাউন প্রত্যাহারের পর থেকে সামাজিক দূরত্ব, মাস্ক পরিধান, জীবাণুনাশক দ্বারা হাত পরিষ্কারের ব্যাপারে আমরা উদাসীন হয়েছি। অনুমিত ধারণা যে, শতকরা ৮০ থেকে ৯০ ভাগ মানুষ সঠিকভাবে অথবা কোনো মাস্ক পরেন না। গ্রামে এ সংখ্যাটি আরও বেশি। এ কথা সত্য যে, করোনা নিয়ে ভয় কমলেও করোনার ভয়াবহতা কিন্তু কমেনি। শীতে করোনার সঙ্গে শীতকালীন অন্যান্য ভাইরাসের সংযোগে অসুস্থতার হার উদ্বেগজনক হারে বাড়তে পারে। পাশাপাশি শীতের শুরুতে বাংলাদেশের সাধারণ মানুষগুলোর পর্যটন কেন্দ্রগুলোতে ভিড় অস্বাভাবিকভাবে বাড়ছে, যেখানে নেই কোনো স্বাস্থ্যবিধির বালাই। যেখানে সরকার শিক্ষার্থীদের জীবনের ঝুঁকির কথা প্রাধান্য দিয়ে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো খুলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না, সেখানে সাধারণ মানুষের মহামারির প্রতি এমন অবহেলা শীতকালীন করোনার দ্বিতীয় ওয়েভকে বেশ ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থানে নিয়ে যেতে পারে।

বাংলাদেশে শীতকালকে মাথায় রেখেই করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকাতে মাস্ক পরিধান, সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার প্রতি কড়াকড়ি আরোপ করে এখন থেকেই ‘নো মাস্ক, নো সার্ভিস’ নীতি গ্রহণ করেছে। এখন এ সিদ্ধান্তের যথাযথ বাস্তবায়ন বড় চ্যালেঞ্জ। বাংলাদেশে ঢাকা এবং চট্টগ্রাম মিলে মোট ২৯টি কোভিড ডেডিকেটেড হাসপাতাল রয়েছে। এছাড়া ১৯ নভেম্বর পর্যন্ত সর্বশেষ হিসাবে দেখা যাচ্ছে, এই মুহূর্তে সারা দেশে অক্সিজেন সিলিন্ডারের সংখ্যা ১৩ হাজার ৬০২ টি। হাইফ্লো ন্যাজাল ক্যানুলা সংখ্যা ৬০৪ টি এবং অক্সিজেন কনসেনট্রেটর সংখ্যা ৩৯৫ টি। সতেরো কোটি মানুষের দেশে জরুরি স্বাস্থ্য সেবার এ চিত্রই বলে দেয় কতটা সংকটে রয়েছে এই খাত। 

অন্যদিকে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সংক্রমণের দ্বিতীয় ধাপ সামাল দিতে হলে নমুনা পরীক্ষার হার বাড়ানোর কোন বিকল্প নেই। অর্থাৎ, পরীক্ষার সংখ্যা বাড়িয়ে যত দ্রুত সংক্রমিত মানুষ চিহ্নিত করা যাবে, তত দ্রুত তার চিকিৎসা এবং পরিবারের অন্যদের আইসোলেশনে রাখা এবং অন্যান্য প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নেওয়া সহজ হবে।

মহামারি করোনার এখন পর্যন্ত সঠিক কোনো ওষুধ আবিষ্কৃত হয়নি। তাই আপাত দৃষ্টিতে একমাত্র লকডাউন ও সামাজিক দূরত্ব এবং জনসচেতনতা বজায় রাখা ছাড়া গত্যন্তর নেই। জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সংক্রমণের পরিস্থিতি যদি দ্রুত অবনতি হয় তাহলে কী ব্যবস্থা নেওয়া হবে, সে পরিকল্পনাও আগে থেকে করে রাখা জরুরি। সংক্রমণ যদি দ্রুত বাড়ে, সেক্ষেত্রে আরেকদফা লকডাউনে যাবে কি না, সে চিন্তাও আগেভাগে করার পরামর্শ দিয়েছেন তারা। কিন্তু বাংলাদেশে গত প্রায় সাড়ে সাত মাসে অনেক মানুষ চাকরি হারিয়েছে, অর্থনৈতিকভাবে ভীষণ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। পাশাপাশি আমাদের অর্থনীতির জন্য লকডাউন কোনো সমাধান নয়। এটি একদম চূড়ান্ত অপশন। বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশের এই মুহূর্তে লকডাউনে যাওয়াটা যুক্তিসংগত হবে না। প্রয়োজনে স্বাস্থ্যবিধি মানার ওপর আরো বেশি কড়াকড়ি আরোপ করতে হবে। এতে করে দেশের মধ্যবিত্ত পরিবারগুলো বাঁচার পাশাপাশি দেশের করোনা পরিস্থিতিরও উন্নয়ন হবে। পুরোপুরি লকডাউনের যেমন প্রয়োজনীয়তা এই মুহূর্তে নেই, তেমনি জাতিগতভাবে এটা মেনে নেওয়ার মানসিকতায়ও কেউ নেই।

পরিশেষে বলবো, সাধারণ মানুষের উদাসীনতা ও মহামারির প্রতি অবহেলা দ্বিতীয় ঢেউয়ের পথকে ক্রমশ মসৃণ করছে। তাই অতিদ্রুত স্থানীয় পর্যায়ের চায়ের দোকান থেকে শুরু করে গণপরিবহন পর্যন্ত সব ক্ষেত্রে সরকার ঘোষিত স্বাস্থ্যবিধি মেনে নিয়ন্ত্রিত চলাফেরা, পর্যটন কেন্দ্রগুলোতে অযথা ভ্রমণ নিরুৎসাহিত করা, নমুনা পরীক্ষার সংখ্যা বাড়ানো, ‘নো মাস্ক নো সার্ভিস’ এবং স্বাস্থ্যসেবার সক্ষমতা বাড়ানো কঠোরভাবে নিশ্চিত করতে না পারলে দ্বিতীয় দফায় লকডাউনের বিকল্প থাকবে নাহ। পরিণামে অর্থনৈতিকভাবে ভীষণ ক্ষতিগ্রস্ত হবে দেশ, চাকরি হারাবে অনেক মানুষ এবং করোনা মোকাবিলা নাকি মানুষকে দু-মুঠো খেয়ে বাঁচার ব্যবস্থা করা এমন উভয় সংকটে পড়তে হবে।

লেখক:
সহকারী অধ্যাপক, নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগ, চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়।

ইত্তেফাক/এএএম


 

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন