বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি প্রক্রিয়া: প্রাসঙ্গিক ভাবনা

আপডেট : ২৬ নভেম্বর ২০২০, ১০:০১

দেশে পাবলিক তথা সরকারি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা দেড় শতাধিক। এর মধ্যে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা শতাধিক, পাবলিক তথা সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা প্রায় ৫০। এছাড়া জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে অসংখ্য কলেজে অনার্স করার সুযোগ রয়েছে। কাজেই আমাদের দেশের বিভিন্ন কলেজ থেকে যতসংখ্যক শিক্ষার্থী উচ্চমাধ্যমিকের দরজা অতিক্রম করবে, উপযুক্ত নম্বর থাকলে সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমোদিত অনার্স কলেজে তারা ভর্তির সুযোগ পাবে। সেই দিক বিবেচনায় উচ্চশিক্ষা থেকে বঞ্চিত হওয়ার দুশ্চিন্তা তাদের থাকার কথা নয়।

আমার আজকের মূল আলোচনার বিষয় বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির প্রক্রিয়া নিয়ে। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির প্রক্রিয়া নিয়ে প্রতি বছরই ইউজিসি কর্তৃপক্ষ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যদের মধ্যে ভর্তির নীতিমালা প্রণয়নের লক্ষ্যে কিছু কথাবার্তা, আলাপ-আলোচনা হয়। তবে সেই আলোচনা কখনো ফলপ্রসূ হতে দেখা যায় না। পাবলিক তথা সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে কেন্দ্রীয়ভাবে পরীক্ষা নেওয়ার কথা প্রতি বছরই আলোচনায় আসে, কিন্তু কার্যকর কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করা সম্ভব হয়ে ওঠে না। এর মূল কারণ সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অনীহা। সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়সমূহ তাদের নিজ নিজ অধ্যাদেশের আলোকে ভর্তি পরীক্ষা নিতে চাইলে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন বা শিক্ষা মন্ত্রণালয়েরও তেমন কিছু করার থাকে না। কোন প্রক্রিয়ায় সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো অনার্সে ভর্তির জন্য শিক্ষার্থী বাছাই করবে, সেটি তাদের নিজস্ব ব্যাপার। সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো তাদের নিজস্ব অধিকার অন্য কারো হাতে তুলে দিতে চায় না, যার ফলে দেখা গেছে ইউজিসি বা শিক্ষা মন্ত্রণালয় কেন্দ্রীয়ভাবে ভর্তি পরীক্ষা নেওয়ার কথা ভাবলেও সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়সমূহের নেতিবাচক মনোভাবের কারণে তা কার্যকর হয় না।

এরপর আমরা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি প্রক্রিয়ার দিকে খানিকটা আলোকপাত করতে পারি। সম্প্রতি ইউজিসি থেকে একটি চিঠি প্রচারিত হয়েছে। তারিখ ১১ নভেম্বর ২০২০। চিঠিতে জানানো হয়েছে, উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশিত হওয়ার আগেই কতিপয় বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের অনার্সে ভর্তির প্রক্রিয়া শুরু করে দিয়েছে। খবরটি নিঃসন্দেহে উদ্বেগজনক। এ থেকে বুঝতে হবে, কোন কোন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীর সংকট দেখা দিয়েছে। শিক্ষার্থীর সংকট আছে বলেই কোনো কোনো বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় পরীক্ষার ফলাফল ঘোষণার আগেই তাদের ভর্তির প্রক্রিয়া শুরু করে দিয়েছে। ইউজিসি কর্তৃপক্ষ এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট সবাইকে সতর্ক করে দিয়েছে, এটি নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয় উদ্যোগ। তবে ইউজিসির একটি চিঠিতেই ভর্তি প্রক্রিয়া বন্ধ হয়ে যাবে, তেমনটি না-ও হতে পারে। ছাত্র সংকটের কারণে কিছু কিছু বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় বিপদে আছে। ইউজিসি কর্তৃপক্ষ যদি ছাত্র সংকটের মূল সমস্যার সমাধানে এগিয়ে না আসে, শুধু একটা চিঠি দিয়ে এ সমস্যার সমাধান হবে না। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির ব্যাপারে ইউজিসির একটি নীতিমালা আছে। সেই নীতিমালায় বলে দেওয়া আছে, একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে সর্বোচ্চ কত জন শিক্ষার্থীকে প্রতি সেমিস্টারে ভর্তি করা যাবে। তবে যত দূর জানা গেছে, পুরোনো খ্যাতিমান বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ছাত্র ভর্তির ব্যাপারে ইউজিসির নীতিমালাকে গ্রাহ্যই করছে না। যত শিক্ষার্থী পাচ্ছে, ভর্তি করে নিচ্ছে। সীমারেখার কোনো বালাই নেই। যত বেশি শিক্ষার্থী ভর্তি করা যাবে, তত তাদের আয় বাড়বে। এর ফলে অনেক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীর ঘাটতি দেখা দিয়েছে। এই সমস্যার সমাধান ইউজিসিকেই করতে হবে। সমাধান না করতে পারলে শিক্ষার মানও নেমে যাবে।

বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীর সংকট সৃষ্টির ক্ষেত্রে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অবদানও কম নয়। স্থানীয় সংসদ সদস্যদের চাপের মুখে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় গ্রামে-গঞ্জের অসংখ্য নিম্নমানের প্রাইভেট কলেজে অনার্স কোর্স খুলে দিয়েছে, যেখানে না আছেন যোগ্য শিক্ষক, না আছে ভালো লাইব্রেরি, না আছে অনার্স শিক্ষার উপযুক্ত পরিবেশ। সেই সব কলেজে ভর্তি হলে শিক্ষার্থীদের বেতন দিতে হয় না, কোনো দিন ক্লাস করতে হয় না, শুধু পরীক্ষার সময় শিক্ষার্থীরা পরীক্ষার হলে বসলেই কলেজ কর্তৃপক্ষ মহাখুশি থাকে। কারণ কলেজে অনার্স কোর্স থাকলে শিক্ষকদের মান-মর্যাদা বেড়ে যায়। বিনা বেতনে, বিনা লেখাপড়ায় যদি কোনো প্রাইভেট কলেজ থেকে অনার্স ডিগ্রি অর্জন করা যায়, নিজ পকেটের অর্থ ব্যয় করে শিক্ষার্থীরা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে আসবে কেন? উচ্চশিক্ষার মান যদি রক্ষা করতেই হয়, এসব বিষয় উপেক্ষা করার সুযোগ নেই।

প্রতিটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় তাদের নিজস্ব নীতিমালা অনুযায়ী শিক্ষার্থী ভর্তি করে থাকে। অধিকাংশ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষা নিয়ে থাকে নামে মাত্র। শিক্ষার্থীর ঘাটতি থাকলে তা পূরণের জন্য ভর্তির সময়সীমা না বাড়িয়ে তাদের উপায় থাকে না। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষার ব্যাপারে একটা শৃঙ্খলা আনা অত্যন্ত জরুরি। সেই শৃঙ্খলা আনতে হলে ইউজিসিকেই মূল দায়িত্ব পালন করতে হবে।

কথাটি অপ্রিয় হলেও সত্য, মেধার ভিত্তিতে যেসব শিক্ষার্থী সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে পারে না, কেবল সেই সমস্ত শিক্ষার্থীই বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে আসে। কাজেই ধরেই নেওয়া যায়, তারা তুলনামূলকভাবে দুর্বল মেধার শিক্ষার্থী। সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা দিয়ে যারা কৃতকার্য হতে পারে না, তারা সবাই দেশের পুরোনো খ্যাতিমান বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ভর্তির জন্য ভিড় জমায়। সুযোগ বুঝে পুরোনো খ্যাতিমান বিশ্ববিদ্যালয়গুলো তাদের নির্দিষ্ট আসনসংখ্যার দুই-তিন গুণ বেশি শিক্ষার্থীকে ভর্তি করে ফেলে। ইউজিসির দেওয়া আসনসংখ্যার বিষয়টি তারা অগ্রাহ্য করে। যত বেশি শিক্ষার্থী তারা ভর্তি করতে পারবে, আর্থিক ব্যাপারে তারা তত সমৃদ্ধ হবে। এরপর যেসব শিক্ষার্থী অবশিষ্ট থাকে, তারা সবাই আর্থিকভাবে যেমন দুর্বল, মেধায়ও নিম্নমানের। এদের নিয়েই চলতে হয় দেশের অবশিষ্ট বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে। যেসব শিক্ষার্থী আর্থিকভাবে বেশি দুর্বল, তারা বেছে নেয় জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অনার্স কলেজগুলোকে, যার ফলে অধিকাংশ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়কে শিক্ষার্থীর সংকটে পড়তে হচ্ছে। এই সংকটের সমাধান করতে হলে ইউজিসিকে অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হবে। এছাড়া আর কোনো পথ নেই। শিক্ষার্থী ভর্তির ব্যাপারে সব বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে একটা ভারসাম্য সৃষ্টি করা অত্যন্ত জরুরি। এ ব্যাপারে আমার কিছু পরামর্শ এখানে তুলে ধরছি।

বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে যারা ভর্তি হতে আসে, সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের আদলে তাদের ভর্তি পরীক্ষা নেওয়া সময়ের অপচয় ছাড়া আর কিছু নয়। বিগত পরীক্ষাসমূহের প্রাপ্ত নম্বর তার মেধা বিচারের মানদণ্ড হতে পারে। ইউজিসির তত্ত্বাবধানে কেন্দ্রীয়ভাবে শিক্ষার্থীর বিগত পরীক্ষাসমূহের প্রাপ্ত নম্বরের ওপর ভিত্তি করে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী ভর্তির একটি তালিকা প্রস্তুত করে দিলেই চলবে। সেই তালিকা থেকে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের জ্যেষ্ঠত্বের ভিত্তিতে শিক্ষার্থীদের ভর্তির জন্য বণ্টন করে দিতে পারলে সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। মেধার ভিত্তিতে এখানে শিক্ষার্থীরও তার পছন্দের বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম দেওয়ার সুযোগ থাকবে। শিক্ষার্থী বণ্টনের সময় একটি অপেক্ষমাণ তালিকাও সংযোজিত করে দিতে হবে।

শিক্ষার্থী বণ্টনের সময় জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন কলেজসমূহে শিক্ষার্থী বণ্টনের নীতিমালাকে মডেল হিসেবে গ্রহণ করা যেতে পারে। যত দূর জানা গেছে, ভর্তির ব্যাপারে তাদের নীতিমালা ফলপ্রসূ হয়েছে।

এ কাজ করতে গেলে ইউজিসির জনবলের ঘাটতি দেখা দেবে। সে ক্ষেত্রে তাদের কাজে সহযোগিতার জন্য প্রয়োজনবোধে ১০টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক প্রতিনিধিদের নিয়ে ইউজিসি একটি ভর্তি কমিটি গঠন করে নিতে পারবে, যে কমিটির সভাপতি থাকবেন ইউজিসির সম্মানিত চেয়ারম্যান। তার সার্বিক তত্ত্বাবধানে কমিটি ভর্তির তালিকা প্রস্তুত করবে।

আমার জানামতে, ইউজিসি সব বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তাদের আসনসংখ্যার তালিকা জেনে নিয়েছে অথবা কোন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে কতটা আসন বরাদ্দ আছে ইউজিসির কাছে সেই তালিকা সংরক্ষিত আছে। সেই তালিকা সামনে রেখে যদি ভর্তির তালিকা প্রণয়ন করা যায়, সে ক্ষেত্রে বরাদ্দ আসনের অতিরিক্ত শিক্ষার্থী কোনো বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি করতে পারবে না। এর ফলে ভর্তির ব্যাপারে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে যে বৈষম্য বিরাজ করছে, তা দূর হবে এবং ভর্তির ব্যাপারে একটা শৃঙ্খলা ফিরে আসবে।

বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র ভর্তি এবং শিক্ষার মান কোনো বিচ্ছিন্ন বিষয় নয়। ভর্তির ব্যাপারে শিক্ষার্থীরা তাদের পছন্দের বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি তালিকা দিতে পারবে। তাদের পছন্দের ওপর ভিত্তি করেই ভর্তি কমিটি তালিকা প্রণয়ন করতে পারবে।

বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে সমাজে নানা রকম সমালোচনা রয়েছে। শিক্ষার্থী ভর্তির বিষয়ে শিক্ষার্থীদের নিয়ে যে টানাটানি চলছে, তা মোটেই শোভনীয় নয়। ইউজিসির কাছে যেমন খবর আছে, উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার ফল বের হওয়ার আগেই কোনো কোনো বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র ভর্তির প্রক্রিয়া শুরু করে দিয়েছে, খবরটি নিঃসন্দেহে উদ্বেগজনক। উচ্চশিক্ষার মান এবং শিক্ষার্থীদের বৃহত্তর স্বার্থে বিষয়টির প্রতি আমি শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও ইউজিসির দৃষ্টি আকর্ষণ করছি।

লেখক: সাবেক ভিসি, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়

ইত্তেফাক/জেডএইচডি

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন