বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষার ভবিষ্যৎ

আপডেট : ২৮ নভেম্বর ২০২০, ০৮:০৫

মনে রাখতে হবে, মানবজাতির কল্যাণকর, শান্তিপূর্ণ ও সুন্দর ভবিষ্যত্ সৃষ্টি শিক্ষার মূল লক্ষ্য। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন, ‘মানুষের অভ্যন্তরের মানুষটিকে পরিচর্যা করে খাঁটি মানুষ বানানোর প্রচেষ্টাই শিক্ষা।’ তিনি আরো বলেছেন, ‘শিক্ষা হলো, বাইরের প্রকৃতি ও অন্তঃপ্রকৃতির মধ্যে সমন্বয় সাধন।’ মানবশিশুর জন্মের পর থেকে ক্রমাগত এবং অব্যাহত পরিচর্যার মাধ্যমে তার দৈহিক বৃদ্ধি ঘটে। অন্যদিকে নানা সামাজিক কার্যক্রমের মাধ্যমে তার মানসিক বিকাশ হয়। উন্নত মানসিক বিকাশের ক্রমচর্চার মধ্যে দিয়ে নৈতিকতার পরিগঠনের মাধ্যমে আত্মার শুদ্ধি ঘটে। এজন্য বলা হয়ে থাকে দেহ, মন ও আত্মার সুসামঞ্জস্য বিকাশই শিক্ষা। এক কথায়, পরিপূর্ণ মানবসত্তাকে লালন করে দেহ, মন ও আত্মার সমন্বয় সাধনের মাধ্যমে, নিজেকে জাতির উপযোগী, যোগ্য, দক্ষ, সার্থক ও কল্যাণকামী সদস্য হিসেবে গড়ে তোলার নামই শিক্ষা। শিক্ষা মানবজীবনের এক মূল্যবান সম্পদ। এ সম্পদ কখনই খোয়া যায় না বা বিলুপ্ত হয় না। বেঁচে থাকার জন্য, নিজেকে অভিযোজিত করার লক্ষ্যে শিক্ষা অপরিহার্য। শিক্ষা ব্যক্তির উন্নয়ন, সমাজের উন্নয়ন এবং দেশের উন্নয়নে বিশেষ ভূমিকা পালন করে।

১৯৭১ সালে বাংলাদেশের অভ্যুদয় হয়। ১৯৭২ সালে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে দেশের প্রথম সরকার কর্মকাণ্ড শুরু করে। এখন ২০২০ সাল ‘মুজিববর্ষ’। এই দীর্ঘ প্রায় পাঁচ দশকে বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক পরিস্থিতির পরিবর্তন হয়েছে, পালটে গেছে শিক্ষা-সংস্কৃতি, নতুন রূপে আবির্ভূত হয়েছে মানুষের চিন্তাচেতনা। পাকিস্তান আমলে শিক্ষাপদ্ধতি দেশের শিক্ষাব্যবস্থায় বৈষম্য তৈরি করেছিল। একাধিক শিক্ষাপ্রণালি ছিল এর মূল কারণ। স্বাধীনতার পর বাংলাদেশে ‘কুদরাত-এ-খুদা শিক্ষা কমিশন’-এর রিপোর্টে এ দেশের শিক্ষাক্ষেত্রে বিদ্যমান নানারূপ বৈষম্য অবসানের কথা উল্লেখ করা হয়। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করা হলে দেশের শিক্ষাক্ষেত্রে পাকিস্তানের পুরোনো ভূত ভর করে। ১৯৭৩ সালে চারটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় গণতান্ত্রিক অধ্যাদেশ জারি করে বঙ্গবন্ধু যে ইতিহাস সৃষ্টি করেছিলেন, তারও মৃত্যু ঘটে পঁচাত্তর-পরবর্তী স্বৈরশাসকদের উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সরাসরি হস্তক্ষেপের ফলে। বর্তমান সরকারের আমলে উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে ঘিরে ব্যাপক উন্নয়নের জোয়ার চলছে। ঢাকায় ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালস, রংপুর বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়, গোপালগঞ্জে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় গবেষণায় ভালো সাফল্য দেখাচ্ছে। রাঙ্গামাটি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, গাজীপুরে ডিজিটাল বিশ্ববিদ্যালয় ও শাহজাদপুর-শিলাইদহে রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়, নেত্রকোণার শেখ হাসিনা বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের পর নতুন উত্সাহে একাডেমিক কর্মকাণ্ড পরিচালিত হচ্ছে। যুগান্তকারী এসব উদ্যোগ চার দশকের শিক্ষাচিত্রে অনন্য সংযোজন।

‘ইউজিসি’র বদৌলতে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে গবেষণা কর্মকাণ্ড নিয়ে ব্যাপক উত্সাহ ও উদ্দীপনা লক্ষ করা যাচ্ছে। বর্তমানে প্রতি মাসে পোস্ট ডক্টোরালে ৫০ হাজার এবং পিএইচডি প্রোগ্রামে গবেষণার জন্য ৩০ হাজার টাকা বৃত্তি প্রদান করা হচ্ছে। এছাড়া গবেষণা প্রকল্পেও অর্থ বরাদ্দ বেড়েছে। বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। হেকেপ (HEQAEP)সহ বেশ কিছু প্রকল্পের আওতায় বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে গবেষণার জন্য দেশের অনেকগুলো বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা উপপ্রকল্পে কয়েকশ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হচ্ছে। দেশের উচ্চশিক্ষা খাতে গবেষণায় এর আগে এত বেশি বরাদ্দ আর কখনো দেওয়া হয়নি। গবেষণার ক্ষেত্রে তথ্যপ্রযুক্তির সংযুক্তি একটি অনিবার্য দিক। আন্তঃবিশ্ববিদ্যালয় ও গবেষণার জন্য আন্তর্জাতিক যোগাযোগে উচ্চগতিসম্পন্ন ডাটা যোগাযোগ নেটওয়ার্ক স্থাপন করা হয়েছে। করোনাকালে উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের দরিদ্র শিক্ষার্থীদের সহায়তা প্রদানের উদ্যোগ এবং অনলাইন ক্লাসের জন্য টেকনিক্যাল সাপোর্ট দিয়ে ইউজিসি তাদের কাজের দক্ষতা দেখিয়েছে। ১৯ ডিসেম্বর পর্যন্ত ক্যাম্পাসভিত্তিক ক্লাস বন্ধ থাকলেও অনলাইন লেখাপড়ার কার্যক্রম পুরোটাই মনিটরিং করছে ইউজিসি। এমনকি কোভিড-১৯ এ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষা কার্যক্রমও দেখভালের দায়িত্ব এই সংস্থাটির ওপর বর্তেছে। আসলে চার দশকে শিক্ষার উদ্দেশ্যের সঙ্গে উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কর্মযজ্ঞ প্রসারিত হয়েছে। এরই পরিণতিতে স্থাপিত হয়েছে নতুন নতুন বিশ্ববিদ্যালয়; নিযুক্ত হয়েছেন ইউজিসিতে বিজ্ঞ চেয়ারম্যান ও সদস্যগণ। ব্যক্তির জীবনে প্রয়োজনীয় দক্ষতা অর্জন বা কলাকৌশল আয়ত্ত করতে সহায়তা করার এসব প্রতিষ্ঠান ভবিষ্যত্-প্রসারি ভূমিকা রাখতে পারবে বলে আমরা মনে করি। কারণ, মানের দিক থেকে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে তারা ক্রমান্বয়ে উচ্চস্তরে পৌঁছানোর চেষ্টা করছেন। নতুন নতুন বিভাগ ও মেধাবী শিক্ষকদের মিলনমেলায় পরিণত হয়েছে প্রতিষ্ঠানগুলো। জ্ঞানের প্রসারিত দিগন্তে বিশ্বের যে কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বরেণ্য গবেষকদের সঙ্গে সমান্তরাল মেধা ও যোগ্যতা প্রদর্শনে সক্ষম এ দেশের বর্তমান প্রজন্ম।

লেখক : অধ্যাপক, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়

ইত্তেফাক/কেকে

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন