বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

ইয়েমেনে নতুন সরকার, শান্তি কত দূরে?

আপডেট : ০৭ জানুয়ারি ২০২১, ০৮:১৯

২০১৫ সালে সৌদি আরবের নেতৃত্বাধীন জোট যখন হুতিদের হটিয়ে সানার নিয়ন্ত্রণ প্রেসিডেন্ট আব্দু রাব্বু মানসুর হাদির হাতে তুলে দেওয়ার মানসে ইয়েমেনে বিমান হামলা শুরু করে, তখন এই জোট হয়তো ভাবতেই পারেনি কতটা অকার্যকর ও ব্যর্থ প্রচেষ্টা তারা শুরু করতে যাচ্ছে। ছয় বছর পার হয়ে গেছে, এখন অবধি সফলতার থলেতে তেমন কিছুই যোগ করতে পারেনি এই জোট। ইয়েমেন পরিণত হয়েছে এক নারকীয় ধ্বংসের লীলাভূমিতে। গত ১ ডিসেম্বর জাতিসংঘ তার এক প্রতিবেদনে বলেছে, ইয়েমেন যুদ্ধে মৃত্যু হয়েছে ২ লাখ ৩৩ হাজার মানুষের। ইয়েমেন যুদ্ধে ধ্বংস হয়ে গেছে দেশটির অসংখ্য অবকাঠামোগত স্থাপনা, মসজিদ, হাসপাতাল, কলেজ এমনকি বিবাহের অনুষ্ঠান, শেষকৃত্যের অনুষ্ঠানেও জোটের বিমান হামলার খবর গণমাধ্যমে এসেছে। জাতিসংঘ বলছে, দেশটির ৮০ শতাংশ জনগোষ্ঠীর জরুরি ত্রাণসহায়তা প্রয়োজন।

আরব বসন্তের ঢেউ যখন ইয়েমেনেও ছড়িয়ে পড়ে, তখন মসনদ হারিয়েছিলেন দীর্ঘদিনের শাসক আলী আব্দুল্লাহ সালেহ। এরপর দেশটির প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব নেন আব্দু রাব্বু মানসুর হাদি। চলমান রাজনৈতিক অচলবস্থার মধ্যেই ২০১৪ সালের শেষের দিকে রাজধানী সানা দখল করে নেয় ইরান-সমর্থিত শিয়া বিদ্রোহীরা। প্রেসিডেন্ট মানসুর হাদি তখন এডেনকে অস্থায়ী রাজধানী ঘোষণা করে সৌদি আরবে পালিয়ে যান। ২০১৫ সালের শুরুর দিকে হুতিদের কাছ থেকে রাজধানী সানার নিয়ন্ত্রণ পুনরুদ্ধার করতে প্রেসিডেন্ট মানসুর হাদিকে সহয়তা করার জন্য সৌদি আরবের নেতৃত্বাধীন জোট বিমান হামলা শুরু করে।

১৯৯০ সালে উত্তর ও দক্ষিণ ইয়েমেন এক হলেও দেশটি বিভিন্ন গোষ্ঠী ও উপদলে বিভক্ত। দেশটির বেশির ভাগ শিয়া জনগোষ্ঠীর বসবাস দেশটির উত্তরে। রাজনৈতিক অচলাবস্থার মধ্যে সব গোষ্ঠী সক্রিয় হয়ে ওঠে। দেশটির উত্তরের বেশির ভাগ এলাকা হুতিদের নিয়ন্ত্রণে চলে যায়, দক্ষিণের শহর এডেনের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে সংযুক্ত আরব আমিরাত-সমর্থিত সাউদার্ন ট্রানজিশনাল কাউন্সিল এবং সরকারি বাহিনীর ব্যাপক সংঘর্ষ হয়। একই সঙ্গে দেশটিতে মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে জঙ্গিগোষ্ঠী আইএস, আলকায়েদা। সরকারি বাহিনীকে একই সঙ্গে এতগুলো বাহিনীকে মোকাবিলা করতে হয়। সংযুক্ত আরব আমিরাত একদিকে সৌদি আরবের নেতৃত্বাধীন জোটের হয়ে হুতিদের লক্ষ্য করে বিমান হামলায় অংশ নিয়েছে, একই সঙ্গে সরকারি বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াইরত সাউদার্ন ট্রানজিশনাল কাউন্সিলকে সহায়তা করেছে। এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে দুই উপসাগরীয় ঘনিষ্ঠ মিত্রের মধ্যে দূরত্ব সৃষ্টি হয়।

২০১৪ সাল থেকে প্রেসিডেন্ট আব্দু রাব্বু মানসুর হাদি সৌদি আরবে অবস্থান করছেন। সৌদি আরব-সমর্থিত হাদি সরকার এবং সংযুক্ত আরব আমিরাত-সমর্থিত সাউদার্ন ট্রানজিশনাল কাউন্সিলের মধ্যে মতপার্থক্য দূর করতে দীর্ঘদিন ধরেই আলোচনা চলে আসছিল। এ দুই পক্ষ একই সঙ্গে অভিন্ন শত্রু হুতিদের মোকাবিলা করছে। দীর্ঘ আলোচনার পর গত মাসের ১৯ তারিখ মইন আব্দুল মালিককে প্রধানমন্ত্রী করে ২৪ সদস্যের নতুন মন্ত্রিসভা গঠন করা হয়। নতুন সরকারে দেশটির উত্তর ও দক্ষিণ অঞ্চল থেকে ১২ জন করে সমানসংখ্যক প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করা হয়। নতুন এই সরকারের মাধ্যমে সাউদার্ন ট্রানজিশনাল কাউন্সিলের সঙ্গে মতপার্থক্যের অবসান ঘটানো সম্ভব হলো। নতুন সরকার ঐক্যবদ্ধভাবে হুতিদের বিরুদ্ধে লড়াই করবে এমন ঘোষণা দেওয়া হয়।

এখন কথা হচ্ছে, এই নতুন সরকার কি ইয়েমেনে শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে পারবে? ডিসেম্বর ৩০, যখন নতুন সরকারকে বহনকারী বিমান দক্ষিণাঞ্চলীয় শহর এডেনে অবতরণ করে, বিকট বিস্ফোরণে কেঁপে ওঠে পুরো এলাকা। সর্বশেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত ২৬ জন নিহত হয়েছে। নতুন সরকারের বিমানবন্দরে আগমন এবং এমন একাধিক বিস্ফোরণ যথেষ্ট গুরুত্ব বহন করে। নতুন সরকারের পক্ষ থেকে ইতিমধ্যে এই হামলার জন্য হুতিদের দায়ী করা হয়েছে এবং এর জবাব হিসেবে ঐ দিন রাতেই সানায় একাধিক বিমান হামলা চালিয়েছে সৌদি জোট।

ইতিমধ্যে হোয়াইট হাউজে ক্ষমতার পালাবদল ঘটেছে, খুব শিগিগর জো বাইডেন ক্ষমতায় বসতে যাচ্ছেন। প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার আগে গবেষণা সংস্থা কাউন্সিল অব ফরেন রিলেসন্সকে দেওয়া এক সাক্ষাত্কারে জো বাইডেন বলেছিলেন, ‘তিনি ক্ষমতায় গেলে ইয়েমেনে, সৌদির নেতৃত্বে ‘সর্বনাশা যুদ্ধে’ আমেরিকার সাহায্য বন্ধ করে দেবেন। সুতরাং খুব শিগিগর হয়তো ইয়েমেন যুদ্ধের জন্য সৌদি আরবকে চাপে পড়তে হবে। আরেকটা বিষয়, জো বাইডেন ইরানের সঙ্গে সম্পাদিত পারমাণবিক চুক্তিতে ফিরে আসার ঘোষণা দিয়েছেন। ইরানের ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা উঠে গেলে ইরান হয়তো আরো শক্তিশালী হবে।

ইয়েমেনে নতুন সরকার অবশ্যই দেশটিতে শান্তি ফেরাতে পারবে। যদি তারা খুব শিগিগর হুতিদের সঙ্গে আলোচনায় বসতে পারে। লড়াইয়ের মাধ্যমে হুতিদের হটানোর যে শপথ নতুন সরকার নিয়েছে, তা করার আগে গত ছয় বছরের সৌদি জোটের ব্যর্থ প্রচেষ্টার কথাটা যদি একবার ভাবে, তাতেও হয়তো নতুন সরকারকে আলোচনার টেবিলে বসাতে সাহস জোগাবে।

লেখক: শিক্ষার্থী, আধুনিক মুসলিম রাষ্ট্রসমূহের ওপর স্নাতকোত্তর অধ্যয়নরত, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

ইত্তেফাক/এসআর 

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন