শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

বিশ্বব্যাংক ও আমাদের পদ্মা সেতু

আপডেট : ০৭ জানুয়ারি ২০২১, ০৮:৫৩

পদ্মা সেতু আমাদের আত্মবিশ্বাস ও আত্মসম্মানের প্রতীক। বাংলাদেশের এ অর্জন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দৃঢ়তা, দূরদর্শী নেতৃত্বের সাক্ষ্য বহন করে। পদ্মা সেতুতে সর্বশেষ ৪১ নাম্বার স্প্যান বসেছে গত ১০ ডিসেম্বর ২০২০ তারিখে। এর ঠিক পাঁচ বছর আগে ২০১৫ সালের ১০ ডিসেম্বর, পদ্মা সেতুর কারিগরি উপদেষ্টা সর্বজন শ্রদ্ধেয় জামিলুর রেজা চৌধুরী বলেছিলেন ‘আমরা নিশ্চিত যে, বিশ্বমানের পদ্মা সেতু পাচ্ছি, যা ঘুচিয়ে দেবে মহাকালের দূরত্ব।’ সম্পূর্ণ নিজস্ব অর্থায়নে নির্মিতব্য পদ্মা সেতু ঘুচিয়ে দিয়েছে মহাকালের দূরত্ব, মিলিয়ে দিয়েছে অনেক প্রশ্নের উত্তর।

তথাপি আমাদের মনে প্রশ্ন আসে। কেন বিশ্বব্যাংক এমন আচরণ করল? ‘যে ঋণ ছাড়ই হয়নি, সে ঋণে দুর্নীতি হয়েছে’—এমন অপবাদ দিয়ে সরে গেল পাশ থেকে। অথচ স্বাধীনতার পর থেকেই বিশ্বব্যাংক আমাদের অন্যতম প্রধান উন্নয়নসহযোগী সংস্থা। আমাদের উন্নয়নে তাদের রয়েছে গুরুত্বপূর্ণ অবদান। সেই তারাই সরে গেছে আমাদের অতি প্রয়োজনের সময়ে ব্যক্তিকেন্দ্রিক প্রভাবে প্রভাবিত হয়ে।

বিশ্বব্যাংকের উত্পত্তি ব্রেটন উডস সম্মেলনে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে বিধ্বস্ত অর্থনীতি পুনরুদ্ধার করার লক্ষ্যে ১৯৪৪ সালের ১-২২ জুলাই যুক্তরাষ্ট্রের নিউ হ্যাম্পশায়ার শহরে অনুষ্ঠিত হয়েছিল ‘জাতিসংঘের মুদ্রা ও আর্থিক সম্মেলন’ অথবা ‘ব্রেটন উডস সম্মেলন’। জার্মানি ও জাপানের পতন আঁচ করতে পেয়ে যুক্তরাষ্ট্রের আহ্বানে একত্রিত হয়েছিল বিশ্বের তত্কালীন ৪৪টি দেশের ৭৩০ নীতিনির্ধারক।

যদিও ‘World Bank’ নামটি তখনো পর্যন্ত প্রাতিষ্ঠানিকভাবে গ্রহণ করা হয়নি। নামটি দিয়েছে ‘The Economist’ পত্রিকা। তাদের ২২ জুলাই ১৯৪৪ সালের এক নিবন্ধে। বস্তুত ওয়ার্ল্ড ব্যাংক নামে কোনো ব্যাংক কখনো ছিল না, এখনো নেই। আছে ওয়ার্ল্ড ব্যাংক গ্রুপ। বর্তমানে এই গ্রুপের সদস্যসংখ্যা পাঁচ। IBRD ছাড়াও আছে International Development Association, International Finance Corporation, Multilateral Investment Agency এবং International Centre for Settlement of Investment Disputes। এর মধ্যে IBRD এবং IDA মাতৃ সংগঠন। বাকি তিনটি পরে যুক্ত হয়েছে এই বহরে।

এসব প্রতিষ্ঠানের মালিক তাদের সদস্য রাষ্ট্রগুলো। যে দেশের যতটুকু শেয়ার সে দেশ ততটুকুর মালিক। তাদের ভোটিং ক্ষমতাও নির্ধারিত হয় মালিকানা হারে। ২০ ডিসেম্বর ২০২০ তারিখের প্রতিবেদন মোতাবেক IBRD এর ১৮৯ দেশের সদস্যের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের শেয়ার শতকরা ১৬ দশমিক ৪৪ শতাংশ এবং ভোটিং ক্ষমতা ১৫ দশমিক ৫৬। পক্ষান্তরে IBRD তে বাংলাদেশের শেয়ার শতকরা শূন্য দশমিক ২৮ শতাংশ এবং ভোটিং ক্ষমতা শূন্য দশমিক ২৯। সব দেশেরই প্রতিনিধি থাকে পরিচালনা বোর্ডে। ভোটিং ক্ষমতার কারণেই হোক বা আন্তর্জাতিক প্রভাবেই হোক যুক্তরাষ্ট্র থেকেই নির্বাচিত হয়ে থাকে বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্ট। সদস্য দেশের আর্থিক সক্ষমতা ও সামাজিক অবস্থানের ওপর নির্ভর করে ঋণের পরিমাণ ও শর্ত। IBRD তার সদস্য ১৮৯ দেশকে ভাগ করেছে এ,বি,সি এবং ডি—এই চারটি ভিন্ন ক্যাটাগরিতে। একইভাবে IDA তার ১৭৩ সদস্যকে ভাগ করেছে বিভিন্ন গ্রুপে। বাংলাদেশ পড়েছে সহজ শর্তের গ্রুপে। সাধারণত তাদের সুদহার হয় কম। থাকে প্রশাসনিক সংস্কারের কঠিন সব শর্ত।

বিশ্বব্যাংকের IDAকে বলা যেতে পারে গরিবের ব্যাংক। গরিবের মধ্যে যারা আরো গরিব তারাই এই প্রতিষ্ঠানের গ্রাহক। এসব দেশের শিক্ষা, স্বাস্থ্য, স্যানিটেশন, কৃষি, অবকাঠামো উন্নয়ন এবং প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার খাতে অত্যন্ত কম সুদে ঋণ দিয়ে থাকে IDA। বাংলাদেশ এই ব্যাংকের অন্যতম প্রধান গ্রাহক। IBRD এর মূল গ্রাহক মধ্য-আয়ের দেশ। এসব দেশের আর্থিক, শিক্ষা ও প্রযুক্তি খাতে সহায়তা প্রদান করে IBRD।

বিশ্বব্যাংক গ্রুপের আরেক গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান IFC। উন্নয়নশীল দেশের বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ করাই IFC-এর প্রধান নীতি। তাদের সর্বশেষ প্রতিবেদন মোতাবেক জুন ২০১৮ নাগাদ বাংলাদেশে বিদ্যুত্, গার্মেন্টস ও খাদ্যনিরাপত্তা খাতে ১ হাজার ৫২০ মিলিয়ন ডলারের সহায়তা প্রদান করার প্রতিজ্ঞাবদ্ধ ছিল IFC। উন্নয়নশীল দেশে বিদেশি বিনিয়োগ বাড়ানোর লক্ষ্যে বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠানকে বিমা-সহায়তা প্রদান করে থাকে MIGA। ‘ঘোড়াশাল তৃতীয় বিদ্যুত্ ইউনিট পুনর্নির্মাণ প্রকল্প’র জন্য HSBC থেকে নেওয়া বাংলাদেশ বিদ্যুত্ উন্নয়ন বোর্ডের ৯৭ দশমিক ৩ মিলিয়ন ডলারের ঋণের গ্যারান্টার হয়েছে MIGA। বিনিয়োগসংক্রান্ত বিরোধ নিষ্পত্তির আন্তর্জাতিক সালিশ কেন্দ্র হলো ICSID।

আমরা আগেই জেনেছি, ন্যূনতম সুদহারের জন্য IDA এর অন্যতম গ্রাহক বাংলাদেশ। স্বাধীনতার পর থেকে ২০১৮-১৯ অর্থ বছর পর্যন্ত বাংলাদেশ ৮৫ হাজার ৯৩৩ দশমিক ২২৯ মিলিয়ন ডলারের বৈদেশিক সহায়তা (ঋণ এবং অনুদান) গ্রহণ করেছে। তার মধ্যে IDA থেকে গ্রহণ করা হয়েছে ২১ হাজার ৮১৬ দশমিক ৩ মিলিয়ন ডলার, শতকরা হিসাবে ২৫ দশমিক ৩৯ শতাংশ! বাকি ৭৪ দশমিক ৬১ শতাংশ বৈদেশিক সহায়তা গ্রহণ করা হয়েছে অন্য সব বহুজাতিক ও দ্বিপাক্ষিক উন্নয়ন সহযোগীদের নিকট থেকে। নিঃসন্দেহে IDA তথা বিশ্বব্যাংক বাংলাদেশের উন্নয়নের গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার।

অন্যান্য আন্তর্জাতিক সহযোগীর ন্যায় IDA সাধারণত দুই আঙ্গিকে সহায়তা প্রদান করে থাকে, অনুদান এবং ঋণ। অনুদান ফেরত দিতে হয় না; কিন্তু অনুদানের সঙ্গে জুড়ে দেওয়া শর্ত এবং আন্তর্জাতিক পরামর্শক নিয়ে সমালোচনা আছে বিশ্বব্যাপী। অপর দিকে তাদের ঋণের সুদহার কম, মেয়াদ দীর্ঘ। IDA সাধারণত ঋণ দিয়ে থাকে ৪০ বছরের জন্য, যার আবার প্রথম ১০ বছর থাকে কিস্তিবিহীন সময় বলা হয়ে থাকে IDA বাংলাদেশে প্রদত্ত ঋণে সুদ আরোপ করে না। শুধু দিতে হয় পরিষেবা খরচ। তাও মাত্র শতকরা শূন্য দশমিক ৭৫ হারে। অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের প্রতিবেদন মোতাবেক ২০১৮-১৯ অর্থ বছর পর্যন্ত IDA থেকে বাংলাদেশের প্রাপ্ত ২১ হাজার ৮১৬ দশমিক ৩ মিলিয়ন ডলারের সহায়তার মধ্যে ৫ দশমিক ৯৬ শতাংশ (১ হাজার ২৯৯ দশমিক ৭ মিলিয়ন ডলার) অনুদান।

স্বাধীনতার ঠিক পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশের আর্থিক অবস্থা যখন খুবই নাজুক ছিল তখন সহযোগিতার মূল প্রবাহ ছিল অনুদান আকারে। ১৯৭২-৭৩ অর্থ বছরের প্রাপ্ত সহায়তার এক-তৃতীয়াংশই ছিল অনুদান। ২০৮০-৮১ অর্থ বছরের ১ হাজার ১ দশমিক ৫ মিলিয়ন বৈদেশিক সহায়তার মধ্যে ঋণ পরিমাণ ছিল ৮০৮ দশমিক ৬ মিলিয়ন ডলার, অনুদান ১৯২ দশমিক ৯ মিলিয়ন ডলারের। যেখানে ২০১৮-১৯ অর্থ বছরে গৃহীত ৬ হাজার ৫৪২ দশমিক ৬ মিলিয়ন ডলারের মধ্যে অনুদান ছিল মাত্র ৪ দশমিক ৩ শতাংশ (২৭৯ দশমিক ৭ মিলিয়ন ডলার), বাকি ৬ হাজার ২৬২ দশমিক ৯ মিলিয়ন ডলারই ঋণ। অনুদান নির্ভরশীলতা থেকে বের হয়ে আসছে বাংলাদেশ। আগামী দিনে অর্থনীতির সক্ষমতা বৃদ্ধির সঙ্গে IDA থেকে উত্তীর্ণ হলে ঋণ নিতে হবে তুলনামূলক কঠিন শর্তে, IBRD থেকে।

বৈদেশিক ঋণ বর্তমান বৈশ্বিক অর্থায়নের যুগে উন্নয়নের পরিপূরক। এসডিজির ১৭ নম্বরর অভীষ্ট মোতাবেক উন্নত দেশগুলো তাদের জিডিপির শূন্য দশমিক ৭ শতাংশ উন্নয়নশীল দেশের উন্নয়নের জন্য সহায়তা প্রদানে অঙ্গীকারবদ্ধ। তার ওপর ভিত্তি করেই বাংলাদেশের সঙ্গে উন্নয়নসহযোগী সংস্থাগুলোর রয়েছে সুসম্পর্ক। যথাসময়ে বৈদেশিক ঋণ পরিশোধেও রয়েছে আমাদের সুনাম। তথাপি, পদ্মা সেতুর ১২০ কোটি ডলার ঋণ প্রস্তাব বাতিল করে বিশ্বব্যাংক। একতরফা ভাবে, কোনো এক রহস্যময় কারণে। তাদের পথ অনুসরণ করে প্রকল্প থেকে সরে যায় এডিপি, জাইকা এবং আইডিবির মতো উন্নয়ন সহযোগীরা।

Global Partnership for Effective Development Co-operation এর ভাষ্য মতে, বৈদেশিক সহায়তার যথাযথ কার্যকারিতার জন্য দরকার উন্নয়ন পক্রিয়ায় দেশের কর্তৃত্ব, অন্তর্ভুক্তিমূলক অংশীদারিত্ব। দরকার নাগরিকের আন্তরিকতা, আন্তর্জাতিক দর-কষাকষির দক্ষতা ও দেশপ্রেম। দরকার দৃঢ় নেতৃত্ব। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দূরদর্শী নেতৃত্বে বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে উন্নয়নের মহাসড়ক ধরে, সব বাধা অতিক্রম করে। পদ্মা সেতু থেকে বিশ্বব্যাংকের এই চলে যাওয়া বরং আমাদের জন্য শাপে বর হয়েছে। কূটনৈতিক মর্যাদা ও অর্থনৈতিক সক্ষমতার প্রতীক হয়ে পদ্মা সেতু বাংলাদেশের সমৃদ্ধি ও সাহসের জয়গান গাইতে পারছে।

লেখক :জেলা প্রশাসক, মেহেরপুর

ইত্তেফাক/টিআর

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন