বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

করোনার দ্বিতীয় ঢেউ ও আমাদের করণীয়

আপডেট : ১৯ জানুয়ারি ২০২১, ০৬:৪৭

প্রাণঘাতী করোনা ভাইরাসের কারণে বিশ্বব্যাপী যে সংকটের সৃষ্টি হয়েছে তা সাধারণত অর্থনীতিকে কেন্দ্র করে। উত্পাদক, ভোক্তাশ্রেণি থেকে শুরু করে সমাজের সর্বস্তরের মানুষ এই করোনা ভাইরাসের কারণে এক মহাসংকটে পতিত হয়েছে। উত্পাদকদের সমস্যা বহুবিধ। তারা যা উত্পাদন করেন, তা কেনার মতো ভোক্তা নেই। আবার ভোক্তদের কাছে অর্থ না থাকার কারণে তারা বাজার থেকে উত্পাদিত পণ্য কিনতে পারছেন না। স্থানীয় বাজারে যেসব নিত্যপণ্য বিক্রি হয় তার উত্পাদন এবং বাজারজাত আশঙ্কাজনক হারে কমে গেছে। কিন্তু সবকিছুকে ছাপিয়ে যে বিষয়টি মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে তা হলো রপ্তানি বাণিজ্য। এক্ষেত্রে কয়েকটি বিষয় খুব সংকটের মধ্য দিয়ে এগিয়েছে। বিশেষ করে রপ্তানি বাণিজ্যের জন্য কাঁচামাল সংগ্রহ করে তা প্রক্রিয়াজাতকরণের মাধ্যমে বিক্রি করা একটি বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে এই রপ্তানিকারকদের জন্য।

বাংলাদেশে প্রথম লকডাউনের মধ্যে উত্পাদন বন্ধ থাকে। শ্রমিকরা অনেকেই বাড়ি চলে যায়। বেশি বিশৃৃঙ্খলা তৈরি হয় বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় রপ্তানি খাত পোশাকশিল্পে। উত্পাদন এবং রপ্তানি বন্ধ থাকায় উদ্যোক্তারা দিশেহারা হয়ে পড়ে। বড় এ খাতটি কীভাবে টিকে থাকবে তা নিয়ে শঙ্কার সৃষ্টি হয়। একদিকে কাঁচামালের দুষ্প্রাপ্যতা, অন্যদিকে কারখানা বন্ধ থাকার কারণে বিশাল এ খাতের শ্রমিকদের বেতন-ভাতা পরিশোধ নিয়ে জটিলতা দেখা দেয়। ঠিক এ সময়ে সরকার তার প্রথম প্রণোদনা প্যাকেজ নিয়ে এগিয়ে আসে। শ্রমিকদের বেতন-ভাতা পরিশোধের জন্য সরকার অর্থ ব্যয় করে। সরকারের এ সাহসী সিদ্ধান্তের কারণে পোশাকশিল্প খাত এ যাত্রা বেঁচে যায়। ঐ সময়ে ক্রেতা দেশগুলোতে করোনা ভাইরাসের মহামারির কারণে রপ্তানি একপ্রকার বন্ধ থাকে। কিন্তু সেখানকার পরিস্থিতির উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশের পরিস্থিতিও উন্নতির দিকে যেতে থাকে। কারখানাগুলো একে একে উত্পাদনে দিকে ফেরে। তবে করোনা ভাইরাস যখন তার দ্বিতীয় ঢেউ (সেকেন্ড ওয়েব) নিয়ে ইউরোপ এবং আমেরিকার দেশগুলোতে উপচে পড়ে তখন বাংলাদেশের উত্পাদকরা চোখে সরষে ফুল দেখতে থাকে।

বাংলাদেশের সঙ্গে যেহেতু আন্তর্জাতিক ব্যবসায়-বাণিজ্য রয়েছে, সেহেতু বাংলাদেশের চিন্তাটা একটু বেশি। বিশেষ করে, রপ্তানি বাজারে করোনার দ্বিতীয় ঢেউ এর প্রভাব কতটুকু পড়বে তা নিয়ে একপ্রকার গলদঘর্ম হন সরকারের শীর্ষব্যক্তিরা। এছাড়া রপ্তানির সঙ্গে সঙ্গে অভ্যন্তরীণ উত্পাদন এবং ভোক্তাসূচকও নেমে গেছে অনেক। রপ্তানিমুখী শিল্পসহ স্থানীয় শিল্প খাতকে প্রণোদনা দেওয়ার মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যে সাহসী সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন তার ফল আসতে শুরু করে। লক্ষ করলে দেখা যায়, শুরুতেই সরকারের প্রচেষ্টা ছিল, যাতে কর্মসংস্থান ঠিক থাকে। মানুষের ক্রয়ক্ষমতা যাতে কিছুটা হলেও বজায় থাকে। কয়েক মাস পরেই পরিস্থিতিতে ইতিবাচক প্রভাব পড়তে থাকে।

করোনা শুরুর কয়েক মাস পর ইউরোপ জুড়ে পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হয়। ফলে বাংলাদেশের বাতিল বা স্থগিত হওয়া রপ্তানি আদেশগুলো ক্রমান্বয়ে ছাড় হতে থাকে। রপ্তানি আদেশও বাড়তে শুরু করে। কিন্তু নতুন করে ইউরোপ জুড়ে করোনার প্রকোপ বাড়তে শুরু করায় যুক্তরাজ্য, স্পেন, বেলজিয়াম, নেদারল্যান্ডসে ফের লকডাউন শুরু হয়েছে। এছাড়াও ইউরোপের প্রতিটি দেশে আংশিক এবং এলাকাভিত্তিক লকডাউন শুরু হয়েছে। এই সময়ে যেসব রপ্তানি আদেশ নিয়ে আলোচনা হওয়ার কথা তাও স্থাগিত আছে। ফলে আগামী মাসগুলোতে ফের রপ্তানি কমে যাওয়ার শঙ্কা তৈরি হয়েছে।

পুরো ইউরোপ লকডাউনের কারণে অনেকে রপ্তানি আদেশ পিছিয়ে দিচ্ছেন। সাধারণত, ডিসেম্বরের শুরুতে ক্রেতারা রপ্তানি আদেশ দিয়ে থাকে। এরপর উত্পাদকদের কাঁচামাল সংগ্রহ করতে হয়। বাংলাদেশ সাধারণত চীন থেকে কাঁচামাল সংগ্রহ করে থাকে। ক্রেতারা জানুয়ারিতে অর্ডার দিলে তার জন্য কাঁচামাল সংগ্রহ করা দুরূহ হবে। কারণ এসব কাঁচামাল শিপমেন্ট করতে হলে চীনা নববর্ষ পার হয়ে যাবে। চীনা নববর্ষের পরে কাঁচামাল আসলে কারখানাগুলো তিন মাস বন্ধ থাকবে। এতে জটিলতা বাড়বে। বাংলাদেশের অর্থনীতি এ করোনাকালের মধ্যেও যে একটি শক্ত ভিতের মধ্যে দাঁড়িয়েছে তার মূলে রয়েছে বর্তমান সরকার, বিশেষ করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার গতিশীল ও দূরদর্শী নেতৃত্ব। অর্থনীতিকে বাঁচানোর জন্য তিনি যে কমিটি গঠন করেছেন, তাদের সঠিক দিকনির্দেশনা দিয়েছেন। একটি নীতির ধারাবাহিকতার ওপর দাঁড়িয়ে আছে বাংলাদেশের অর্থনীতি। করোনা পরিস্থিতি শেষ পর্যন্ত কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে, তা আমরা কেউ জানি না। পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে, শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত করোনা পরিস্থিতি একই ধাঁচের রয়েছে।

অর্থনীতির গতি ঠিক রাখতে সরকারের প্রণোদনা প্যাকেজ বাস্তবায়ন ভালো পদক্ষেপ; তবে, অর্থনীতির চাকাকে সচল রাখতে সরকারকে বড় ধরনের স্টিমুলাস প্যাকেজ বা উদ্ধার পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে হবে। ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইসহ যেসব সংগঠন প্রধানমন্ত্রীর অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করছে সেসব সংগঠন যদি এখনই নির্বাচনের মাধ্যমে নেতৃত্ব পরিবর্তন করে, তাহলে অর্থনৈতিক নীতি বাস্তবায়ন বাধাগ্রস্ত হবে। কারণ নতুন নেতৃত্বের পক্ষে সরকারের নীতি হঠাত্ করে আত্মস্থ করা কঠিন হবে। এছাড়া বিভিন্ন খাতে যারা স্বল্প সুদে প্রণোদনার অর্থ নিয়েছেন করোনা-পরবর্তী সময়ে তাদের অর্থ ফেরত পেতে বর্তমান কমিটিকেই দায়িত্ব নিতে হবে। মনে রাখতে হবে, প্রণোদনার এই অর্থ যথাসময়ে ফেরত না আনতে পারলে আর্থিক খাতে আরো বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হতে পারে।

*লেখক : সাবেক সহসভাপতি

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন