শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু

আপডেট : ২৩ জানুয়ারি ২০২১, ০৮:৫৩

আজ শনিবার ২৩ জানুয়ারি ভারতের স্বাধীনতাসংগ্রামের অন্যতম বাঙালি নায়ক নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর ১২৫তম জন্মদিন। তার জন্মদিনকে কেন্দ্র করেই পশ্চিমবঙ্গের সব অবিজেপি দল এককাট্টা হয়ে বলেছে, নরেন্দ্র মোদির দেওয়া ‘পরাক্রম দিবস’ আমরা মানছি না, মানব না। পশ্চিমবঙ্গের সব রাজনৈতিক দল চাইছে দিনটি দেশপ্রেম দিবস হিসেবে পালন করতে।

২৩ জানুয়ারি দেশপ্রেম দিবস হিসেবে ঘোষণা করার জন্য পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভায় বামফ্রন্টের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য বিধানসভায় একটি প্রস্তাব পাশ করিয়েছিলেন। যদিও সে প্রস্তাব গ্রহণ করার সময় তৃণমূল কংগ্রেস বিরোধী পক্ষে ছিল। সেদিন তারাও সেটা সমর্থন করেছিল, আজও করছে। সবকিছুতেই একটা নির্বাচনকেন্দ্রিক হাওয়া তুলে দিয়ে গুজরাটিরা পশ্চিমবঙ্গে নির্বাচনি বৈতরণি পার হতে চায়। কয়েক মাস আগে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি পশ্চিমবঙ্গ সফরে এসে রাত কাটান বেলুড় মঠের বিবেকানন্দ আশ্রমে।

সেখান থেকে তিনি ঘোষণা করেছেন, কলকাতা বন্দরের নাম আর নেতাজির নামে থাকবে না। নতুন নামকরণ করে দেন জনসংঘের প্রতিষ্ঠাতা শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জির নামে। এর সবই যে পশ্চিমবঙ্গে আসন্ন নির্বাচনের চমক ছাড়া আর কিছুই নয়, তা বুঝতে বাঙালির কোনো অসুবিধাই হচ্ছে না। আগামী মাস থেকেই নির্বাচনের প্রক্রিয়া শুরু হয়ে যাচ্ছে। নির্ঘণ্টও প্রকাশিত হবে। বুধবারই দিল্লি থেকে নির্বাচন কমিশনের পুরো টিম কলকাতায় এসে গিয়েছে। বিজেপির এই নির্বাচনি কৌশল দেখে রাজনৈতিক মহল মনে করছে, ওরা না কবে বলে বসে, রবীন্দ্রনাথ ও নেতাজি দুজনেই গুজরাটি ছিলেন। অহরহ নানা মহল থেকে বলা হচ্ছে, করোনা অতিমারির সময় থেকেই প্রধানমন্ত্রী নরেদ্র মোদি দাড়ি রাখতে শুরু করেছেন। ধুতি-পাঞ্জাবি পরে রবীন্দ্রনাথের পোশাকে তিনি নির্বাচনে যাবেন। পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক মহলে এ ব্যাপারটি নিয়ে খুব কৌতূহলের সৃষ্টি হয়েছে।

নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু জন্মেছিলেন কটকে। কটক থেকে তিনি ম্যাট্রিক পাশ করে কলকাতায় আসেন। মেধাবী ছাত্র সুভাষচন্দ্র আইএ পড়ার জন্য প্রেসিডেন্সি কলেজে ভর্তি হন। আইএ পড়ার সময় ব্রিটিশ প্রিন্সিপ্যাল ভারতীয়দের সম্পর্কে কটু মন্তব্য করলে ক্লাসের ছাত্রছাত্রীরা ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন। সুভাষের নেতৃত্বে ঐ ব্রিটিশ অধ্যক্ষ সিঁড়ি দিয়ে নামার সময় তাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেন। উত্তেজিত সাহেব পরের দিনই সুভাষকে কলেজ থেকে বহিষ্কার করেন। তখন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ছিলেন স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায়। সুভাষ এক দিন তার বাড়িতে গিয়ে তার সঙ্গে দেখা করেন। আশুতোষ মুখোপাধ্যায় তাকে বলেন, ‘সুভাষ, আমি মনে করেছিলাম তুমি আগেই আসবে। যা-ই হোক, আমি ইতিমধ্যে স্কটিশ চার্চ কলেজের প্রিন্সিপ্যালকে বলে রেখেছি। তুমি এখনই গিয়ে ভর্তি হয়ে নাও।’ স্কটিশ থেকে বিএ পাশ করার পরই বাবার ইচ্ছানুযায়ী বিলেতে আইসিএস পড়তে গেলেন।

সেখানে পাঁচ-ছয় মাস ক্লাস করার পর তিনি বাবাকে একটি চিঠিতে লেখেন, তিনি ব্রিটিশের অধীনে চাকরি করবেন না। বাবার আপত্তি থাকলেও অগ্রজ শরত্চন্দ্র বসু তাকে ব্যারিস্টারি পড়ার অনুমতি দেন। দেশে তখন ব্রিটিশবিরোধী দুর্বার আন্দোলন। তখন কংগ্রেস দল সারা দেশে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন করছে মহাত্মা গান্ধীর নেতৃত্বে। তিনি সেই দলে যোগ দেন। প্রথমেই তিনি কলকাতা করপোরেশনের কাউন্সিলর হিসেবে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে জিতে যান। ধীরে ধীরে তিনি কংগ্রেসের সর্বভারতীয় ওয়ার্কিং কমিটির সদস্য নির্বাচিত হন। এভাবেই রাজনীতিতে তার যাত্রা শুরু হয়। গান্ধীজি তাকে আশীর্বাদ করেন। তিনি অবিভক্ত বাংলার সব জেলা সফর করেন। তিনি সফর করেন ভারতের পাঞ্জাব থেকে শুরু করে দক্ষিণের সব রাজ্য। দেশত্যাগ করার আগে তিনি অবিভক্ত বাংলার সব জেলা সফর করে বিপুল সংবর্ধনা পান। কংগ্রেসের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারক কমিটির তিনি সদস্য নির্বাচিত হন।

এসব তথ্য পাওয়া যায় এডিনবরার একটি সিনেমা থেকে। সিনেমাটির নাম ছিল ‘The Forgotten Hero’। তিনের দশকের মাঝামাঝি সময় তিনি কংগ্রেস সভাপতি পদে প্রার্থী হলে তার প্রার্থী পদের বিরোধিতা করেন স্বয়ং গান্ধীজি। তার কারণ হিসেবে দেখানো হয়েছে, সুভাষ ওয়ার্কিং কমিটির মিটিংয়ে বলেছিলেন, দেশ স্বাধীন হওয়ার পর প্রথম ১০ বছর একনায়কতন্ত্র চালু করা হবে। তীব্র প্রতিবাদ করেছিলেন জওহরলাল নেহরু, মৌলনা আবুল কালাম আজাদ, সর্দার বল্লভ ভাই প্যাটেল, পট্টভি সীতারামাইয়া প্রমুখ। তাদের ব্যাখ্যা ছিল, দেশের ৩৩ কোটি মানুষ স্বাধীনতা আন্দোলনে যোগ দিয়েছেন। তাই তাদের ভোটই দেশে সংসদীয় গণতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা করবে। সুভাষ তাদের সঙ্গে একমত হতে না পেরে কংগ্রেস ছেড়ে দিয়ে ফরওয়ার্ড ব্লক নামে একটি নতুন দল গঠন করেন।

তারপর ১৯৪১ সালের ২১ জানুয়ারি তিনি কলকাতার এলগিন রোডের বাড়ি ছেড়ে দেশান্তরী হন। সুভাষের বিশ্বাস ছিল, শত্রুর শত্রু আমার মিত্র। অর্থাত্ ব্রিটিশকে তাড়াতে গেলে হিটলারের সাহায্য নিতে হবে। ২১ জানুয়ারি দিনটিতে কী ঘটেছিল, তার অনেকটাই আমি শুনেছি আইসিএস পড়ার সময় সুভাষের বাঙালি সহপাঠী সুবিমল দত্তের মুখে। সুবিমল বাবু ১৯৪৬ সাল থেকে অভ্যন্তরীণ সরকারের আমলে ভারতের বিদেশ এবং কমনওয়েলথ সেক্রেটারি ছিলেন। অবসর গ্রহণের ২২ বছর পর ৭৮ বছর বয়সে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অনুরোধে ইন্দিরা গান্ধী তাকে ঢাকায় প্রথম ভারতীয় হাইকমিশনার হিসেবে পাঠান। তার মুখে শোনা, ১৯৪১ সালে অবিভক্ত বাংলার প্রধানমন্ত্রী ছিলেন বরিশালের এ কে ফজলুল হক। তিনি সুভাষকে খুব স্নেহ করতেন। সুভাষ তাকে ইঙ্গিতও দিয়েছিলেন, তিনি দেশ ছেড়ে চলে যাবেন। ফজলুল হক সাহেব ব্যাপারটা গোপন রেখেছিলেন। সুবিমল বাবু আরো বলেছিলেন, ‘আমরা অর্থাত্ সুভাষের সহপাঠীরা দুপুরে একেক দিন একেক জনের ঘরে বসে টিফিন খেতাম। তখন অবিভক্ত বাংলার অতিরিক্ত মুখ্যসচিব জে এন তালুকদার।

তালুকদারকে বারবার ফোন করছি টিফিন খাওয়ার জন্য। তালুকদার একসময় বিরক্ত হয়ে বললেন তুমি টিফিন খেয়ে নাও। আমি এখন টিফিন খাব না। সাড়ে চারটের আগে তোমার ঘরে যাব না। পৌনে ৫টা নাগাদ তালুকদার আমার ঘরে এলেন। হাত তুলে প্রায় নাচতে নাচতে বললেন, আমি কেন তখন টিফিন খেতে আসিনি এবার বলছি। সুভাষ আজ দেশ ছেড়ে চলে গেছেন। ভোরবেলা তিনি একটি ট্যাক্সিতে করে ধর্মতলায় পৌঁছান। ট্যাক্সি চালিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন সুভাষের ভাইপো, শরত্ বসুর ছেলে শিশির বসু। তিনি পাঞ্জাবি ড্রাইভারের ছদ্মবেশ নিয়েছিলেন। ধর্মতলা থেকে অন্য একটি গাড়িতে শিশির বসু সুভাষকে নিয়ে যান ধানবাদের কাছে গুমা স্টেশনে। সেখান থেকে পাঞ্জাব মেলে সুভাষ পৌঁছে যান অমৃতসর।

আরও পড়ুন: স্বাধীনতা মানে কি দুমুঠো খেতে পাওয়া?

অমৃতসর থেকে ট্রেন বদলে যান লাহোরে। লাহোর থেকে ফ্রন্টিয়ার এক্সপ্রেসে চেপে পেশোয়ার হয়ে আফগানিস্তানের কাবুলে চলে গেছেন সুভাষ। ফজলুল হক আগেই ইঙ্গিত পেয়েছিলেন। তাই তিনি হাওড়া, হুগলি, বর্ধমানের ব্রিটিশ জেলাশাসক ও ব্রিটিশ পুলিশ সুপারদের বদলি করে বাঙালি জেলাশাসক ও পুলিশ সুপার নিয়োগ করেছিলেন। যাতে সুভাষের পথে কোনো বাধা না আসে।’ সুবিমল বাবু তখন ছিলেন সেচ ও জলসম্পদ সচিব। আর সেই দপ্তরের মন্ত্রী ছিলেন সোহরাওয়ার্দী সাহেব। কাবুলে পৌঁছেই সুভাষচন্দ্র কাবুলের জার্মান দূতাবাসে গেলেন জার্মান ভিসা নেওয়ার জন্য।

সেখান থেকে তিনি বার্লিনে গিয়ে পৌঁছান। তখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলছে। তাকে বেশ কিছুদিন জার্মানিতে থাকতে হয়েছিল। সেখান থেকে কীভাবে জাপানে পৌঁছাবেন তা নিয়ে ভাবনা-চিন্তা করছিলেন। একদিন সুভাষ হিটলারকে গিয়ে বললেন, ‘আমি জাপানে যাব। আমার একটা প্লেনের ব্যবস্থা করে দিন।’ হিটলারের টেবিলে ছিল একটি অ্যারোপ্লেন এবং একটি ডুবোজাহাজের রেপ্লিকা। হিটলার প্লেনটি দেখিয়ে বললেন, নো। আর জাহাজটি দেখিয়ে বললেন, ‘দিস আই ক্যান গিভ ইউ।’ শেষে ডুবোজাহাজে করেই জাপানে পৌঁছালেন সুভাষ। সেখান থেকে সিঙ্গাপুরে পৌঁছে আজাদ হিন্দ ফৌজ গঠন করলেন। তার পরের ইতিহাস তো সবারই জানা। কিন্তু যারা সে ইতিহাস জানেন না তারা কেন শুধু রাজনীতি করার জন্য তাকে অসম্মান করে চলেছেন, সে প্রশ্ন এখন তামাম বঙ্গবাসীর। আরো একটি কথা, অদ্ভুতভাবে কেউ কেউ এখনো মনে করেন, নেতাজি আজও জীবিত। তিনি হয়তো আবার ফিরে আসবেন। তবে পশ্চিমবঙ্গের আসন্ন নির্বাচনে নেতাজিকে নিয়ে দাদা-দিদির আর রাজনীতি না করাই বোধহয় শ্রেয়, এমনই অভিমত রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞদের।

লেখক: ভারতের সিনিয়র সাংবাদিক

ইত্তেফাক/এমআর

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন