মাইকের বিরক্তিকর শব্দ মানুষের জন্য ব্যাপক ক্ষতিকর। পৃথিবীর অধিকাংশ দেশে এই মাইকের ব্যবহার বন্ধ হয়ে গেছে, অথচ আমাদের দেশে যেখানে-সেখানে এটির ব্যবহার হচ্ছে। অনেক সময় একই সড়কে অটোরিকশা বা ভ্যানে একাধিক মাইক লাগিয়ে বিভিন্ন প্রার্থীর প্রচারণার মাইক আসে। এই সময় অনেকে মাইকিংয়ের অতিরিক্ত শব্দ সহ্য করতে না পেরে দুই হাত দিয়ে কান চেপে বা কানে আঙুল দিয়ে থাকেন।
শুধু তা-ই নয়, পথকুকুরগুলোও যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেতে ঐ সময়টুকু পালিয়ে বেড়ায়। মাইকের শব্দে যেন কান ঝালাপালা হয়ে যাওয়া অবস্থা। যন্ত্রণাদায়ক শব্দের কারণে মুঠোফোনে কথা বলাসহ দৈনন্দিন কাজকর্মেও বিঘ্ন ঘটছে। উচ্চ স্বরের প্রচারণায় আশপাশে থাকা আমজনতা, ব্যবসায়ীদের দৈনন্দিন কাজ, মসজিদ, মন্দির, হাসপাতাল, ক্লিনিক, অফিস, ব্যাংকের নিয়মিত কর্মকাণ্ডেও ব্যাঘাত সৃষ্টি হচ্ছে। স্কুল-কলেজ, হাসপাতাল, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের পাশ দিয়ে যানবাহন চলার সময় মাইক বাজানো নিষিদ্ধ হলেও তা মানা হচ্ছে না। আর এসব কারণে অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে পৌর এলাকার সাধারণ মানুষ।
অতিমাত্রায় শব্দদূষণে সবচেয়ে বেশি স্বাস্থ্যঝুঁকিতে রয়েছে অসুস্থ, বয়স্ক ও শিশুসহ হার্ট, কান ও বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত রোগীরা। সহনীয় মাত্রার চেয়ে অতিরিক্ত শব্দ মানুষের স্বাস্থ্যের ক্ষতির কারণ। মায়ের গর্ভে থাকা সন্তানও শব্দদূষণে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে, এমনকি তাদের শ্রবণশক্তি নষ্ট হয়ে যেতে পারে। এ ছাড়া শিশুর বেড়ে ওঠা ও মেধার বিকাশ বাধাগ্রস্ত হয় শব্দদূষণে। মাত্রাতিরিক্ত শব্দদূষণে শ্রবণশক্তি লোপ, উচ্চ রক্তচাপ, আলসার, মাথাধরা, খিটখিটে মেজাজ, বিরক্তি বোধ, অনিদ্রা, চোখে কম দেখা, হূদেরাগ, বধিরতা প্রভৃতি রোগে মানুষ ভোগে। শব্দদূষণ সর্বোপরি শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর বিভিন্ন ধরনের নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।
আইন অনুযায়ী হাসপাতাল, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও সরকারি নির্ধারিত কিছু প্রতিষ্ঠান থেকে ১০০ মিটার পর্যন্ত এলাকাকে নীরব এলাকা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। এসব এলাকায় মোটরগাড়ির হর্ন বাজানো বা মাইকিং করা সম্পূর্ণ নিষেধ। আইন অমান্য করলে প্রথমবার অপরাধের জন্য এক মাস কারাদণ্ড বা অনধিক ৫ হাজার টাকা অর্থদণ্ড অথবা উভয় দণ্ড এবং পরবর্তী অপরাধের জন্য ছয় মাস কারাদণ্ড অনধিক ১০ হাজার টাকা অর্থদণ্ড অথবা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হওয়ার বিধান রয়েছে। কিন্তু বাস্তবে এসব আইনের প্রয়োগ তেমন দেখা যায় না। ফলে শব্দদূষণও নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না।
এছাড়া নির্বাচনি প্রচারণা ছাড়াও প্রতিদিন প্রতিনিয়ত শব্দদূষণ হয়েই চলেছে। যেগুলোর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে উচ্চ শব্দে গাড়ির হর্ন (বিশেষ করে ট্রাকের হাইড্রোলিক হর্ন), উত্সব, বিয়ে, মেলা উপলক্ষ্যে বেশি সাউন্ড দিয়ে গান-বাজানো, বাজি ফাটানো, মিছিলে বা খেলার মাঠে একসঙ্গে অনেক মানুষের কোলাহল, বোমা বিস্ফোরণ, কলকারখানায় বিভিন্ন যন্ত্রের বিকট শব্দ।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) মতে, ৬০ ডেসিবল মাত্রার শব্দ মানুষকে অস্থায়ী বধির এবং ১০০ ডেসিবল মাত্রার শব্দ মানুষকে স্থায়ীভাবে বধির করে পারে। অনবরত ৬০ ডেসিবলের বেশি শব্দ শুনতে থাকলে তা মাথার পক্ষেও যথেষ্ট ক্ষতিকর, দীর্ঘক্ষণ বেশি সাউন্ড শুনলে মাথা ব্যথার সৃষ্টি হয়। অপরিণত শিশুর চেতনার ওপর আঘাত হানে ও তার সুস্থ মনকে বিপর্যস্ত করে। শব্দের দূষণ শুধু মানব সমাজের ওপরই খারাপ প্রভাব ফেলে তা নয়, অন্যান্য প্রাণীদের জন্যও শব্দ দূষণ মারাত্মক ক্ষতিকর। বন্য পরিবেশে শব্দদূষণ প্রাণীদের অবাধ বিচরণ, শিকারের অসুবিধা, পাখিদের প্রজননে অসুবিধার সৃষ্টি করে।
তাই সবকিছু বিবেচনায় রেখে মাইকিংয়ের সাউন্ড সীমিত করে দেওয়া হোক। যে কোনো শব্দ সহনীয় মাত্রায় রাখতে শব্দের দূষণ বন্ধে প্রশাসনের প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ জরুরি, প্রয়োজনে মোবাইল কোর্টসহ কঠোর নজরদারির ব্যবস্থা নিতে হবে। দোকানে, ফুটপাতে বিরক্তি উত্পাদনকারী শব্দের উত্সও বন্ধ করতে হবে। শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণে জনতা ও রাষ্ট্রের সর্বস্তরের দায়িত্বশীলদের উদাসীনতা দূর করতে হবে। তবে সবচেয়ে জরুরি হলো সামাজিক সচেতনতা। শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণ করার জন্য আইন রয়েছে, দেশের একজন আদর্শ নাগরিক হিসেবে আমাদের আইন মেনে চলতে হবে। তাহলে শব্দ দূষণের সমস্যা অনেকাংশেই সমাধান সম্ভব। সব ধরনের দূষণ নির্মূল হোক এটাই কাম্য।
* লেখক :শিক্ষার্থী, ভেটেরিনারি মেডিসিন বিভাগ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, গোপালগঞ্জ
ইত্তেফাক/বিএএফ