বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

বিরোধী অনেক দলে অস্থিরতা

আপডেট : ১৭ নভেম্বর ২০১৯, ০২:৫৬

রাজনৈতিক তেমন কোনো কর্মসূচি এবং উল্লেখযোগ্য সভা-সমাবেশ না থাকলেও নিজেদের বিবাদে পুড়ছে সরকারবিরোধী দল-জোটগুলো। নেতায়-নেতায় দ্বন্দ্ব, দলে নেতৃত্বের প্রশ্ন এবং পারস্পরিক সন্দেহ-অবিশ্বাসের কারণে অস্থিরতা চলছে অনেক দলে। দীর্ঘদিনের নীরব কলহের বহিঃপ্রকাশ শেষ পর্যন্ত কোপ মারছে দলে। কোপে টুকরো হচ্ছে সরকারবিরোধী এসব দল-জোট।

দলের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরাম জাতীয় স্থায়ী কমিটির অন্যতম সদস্য লে. জে. মাহবুবুর রহমান রাজনীতি থেকেই অবসরে চলে যাওয়ায় এবং ভাইস চেয়ারম্যান মোর্শেদ খান দল ত্যাগ করায় ভেতর থেকে চাপে পড়েছে ২০ দল, জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের প্রধান শরিক বিএনপি। সিলেটের মেয়র আরিফুল হকসহ বিএনপির স্থানীয় কয়েক নেতার দল ত্যাগের গুঞ্জণ এই চাপকে আরো ভারি করে তুলেছে। বিএনপির নেতৃত্বাধীন ২০ দলের শরিক লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি (এলডিপি) সহসাই ভাঙনের মুখে পড়তে যাচ্ছে। আবারও খণ্ডিত হওয়ার প্রক্রিয়া চলছে ২০ দলের আরো দুই শরিক বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টি ও জাতীয় গণতান্ত্রিক পার্টি (জাগপা)-তেও। কল্যাণ পার্টির চেয়ারম্যান সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম এবং জাগপা ও জামায়াতকে সঙ্গে নিয়ে এলডিপি সভাপতি ড. কর্নেল অলি আহমদ (অব.) পৃথকভাবে ‘জাতীয় মুক্তি মঞ্চ’ বানানোর কারণে তাদের সাথে বিভাজন-রেখা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে ২০ দলের সঙ্গে। এই মঞ্চের আত্মপ্রকাশের শুরু থেকেই অলি আহমদ ও সৈয়দ ইবরাহিম ২০ দলের সঙ্গেই আছেন বলে আসলেও বাস্তবতা হচ্ছে ২০ দলের হাত প্রায় ছেড়ে দিয়েছেন তারা।
 
গণফোরাম সভাপতি ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে বিএনপিকে নিয়ে গড়ে ওঠা জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের অন্যতম শরিক জাতীয় সমাজতান্ত্রিল দল—জেএসডিতেও চলছে অশান্তি। দলটির সভাপতি আ স ম আবদুর রবের নেতৃত্বেকে চ্যালেঞ্জ করে আগামী ১১ জানুয়ারি পৃথক কাউন্সিল করার ঘোষণা দিয়েছেন জেএসডির বর্তমান সাধারণ সম্পাদক আবদুল মালেক রতন।

এদিকে, বর্তমান সংসদের প্রধান বিরোধীদল জাতীয় পার্টিতে (জাপা) দেখা দিয়েছে নতুন সংকট। জাপার প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান এইচএম এরশাদের তালাকপ্রাপ্তা দ্বিতীয় স্ত্রী বিদিশা দখল নিয়েছেন রাজধানীর বারিধারায় এরশাদের প্রেসিডেন্ট পার্কের ফ্ল্যাট। ছেলে এরিককে নিয়ে বৃহস্পতিবার সন্ধ্যার পর থেকে ঐ ফ্ল্যাটে অবস্থান করছেন বিদিশা। অন্যদিকে, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও নব্বইয়ের স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে শহিদ নূর হোসেনকে নিয়ে কটূক্তি করে বিপাকে পড়া দলের মহাসচিব মসিউর রহমান রাঙ্গাকে নিয়েও এক ধরনের সংকট চলছে জাপার রাজনীতিতে। আগামী ২৮ ডিসেম্বর অনুষ্ঠেয় জাপার কাউন্সিলের আগে-পরে দলের মহাসচিব পদে পরিবর্তন আসছে—জাপার সর্বত্র এখন কান পাতলে এই গুঞ্জন ভেসে আসে।

সরকারবিরোধী দল-জোট এবং সংসদের প্রধান বিরোধী দল জাপায় এরকম নানামুখী অস্থিরতার পাশাপাশি সংকট চলছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ১৪ দলের শরিক বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টিতে। সম্প্রতি ওয়ার্কার্স পার্টি থেকে পদত্যাগকারী (পরে বহিষ্কৃত) দলের সাবেক সাধারণ সম্পাদক বিমল বিশ্বাস এবং গত ২-৫ নভেম্বর অনুষ্ঠিত দলের কংগ্রেস প্রত্যাখ্যানকারী ৬ নেতাসহ তাদের অনুসারীরা আগামী ২৯ নভেম্বর পৃথক সম্মেলন আয়োজনের প্রস্তুতি নিচ্ছেন।

চাপে বিএনপি :দলের একাধিক নেতার রাজনীতি থেকে অবসরে যাওয়ার কিংবা দলত্যাগের ঘটনায় ভেতর থেকেই এক ধরনের চাপ অনুভব করছেন বিএনপির বর্তমান নেতৃত্ব। দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য লে. জে. (অব.) মাহবুবুর রহমান রাজনীতি থেকেই অবসরে গেছেন। মাহবুবুর রহমান জানিয়েছেন, অন্তত দেড় থেকে দুই মাস আগেই নিজের হাতে লেখা পদত্যাগপত্র তিনি দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের কাছে দিয়েছেন। বিগত কয়েক বছরে বিএনপির সিনিয়র নেতাদের মধ্যে ভাইস চেয়ারম্যান শমসের মবিন চৌধুরী, ইনাম আহমেদ চৌধুরী ও কেন্দ্রীয় নেতা আলী আসগর লবির পর গত ৫ নভেম্বর বিএনপি ছাড়েন আরেক ভাইস চেয়ারম্যান এম মোরশেদ খান।

জানা গেছে, মাহবুবুর রহমান ও মোরশেদ খানের পদত্যাগের পেছনে কারণ দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সরাসরি বিরোধিতা করা। গত জানুয়ারিতে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে মাহবুবুর রহমান অভিযোগ করেন, একাদশ নির্বাচনে গিয়ে বিএনপি ভুল করেছে। যদি দলের নেতৃত্ব দিতে হয়, তারেক রহমানকে দেশে আসতে হবে। দেশে এসেই তাকে নেতৃত্ব দিতে হবে। বিদেশ থেকে দলের নেতৃত্ব দেওয়া সম্ভব নয়। মোরশেদ খান বলেছেন, বিএনপি এখন স্কাইপি পার্টিতে পরিণত হয়েছে। দল থেকে একাধিক নেতার চলে যাওয়ার বিষয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় বলেছেন, ‘দুই-একজন নেতার পদত্যাগে বিএনপি বিচলিত নয়। বিএনপি একটি বড়ো দল, দুই-চার জন চলে গেলে কিছু যায় আসে না।’

ভাঙনের মুখে অলির এলডিপি ও ইবরাহিমের কল্যাণ পার্টি : এলডিপি সভাপতি অলি আহমেদ দলের পুনর্গঠিত কমিটি থেকে যুগ্ম মহাসচিব শাহাদাত হোসেন সেলিমকে বাদ দেওয়ার পর দলটির ভেতর নতুন সংকট তৈরি হয়েছে। কমিটি থেকে বাদ পড়ার পর সেলিম দল ছেড়ে দেওয়ারই নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।

এলডিপির প্রতিষ্ঠাকালীন প্রেসিডিয়াম সদস্য আবদুল করিস আব্বাসী ও আবদুল গণি এবং দল প্রতিষ্ঠায় অলির সঙ্গে দ্বিতীয় মুখ্য ভূমিকা রাখা শাহাদাত হোসেন সেলিমসহ দলের বেশ কয়েকজন নেতা গতকাল শনিবার নিজেদের মধ্যে বৈঠক করেছেন। বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়েছে, আগামী দুই-তিন দিনের মধ্যেই তারা সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে দল পরিচালনায় অলি আহমদের ‘স্বেচ্ছাচারিতা, অগণতান্ত্রিক আচরণ ও বিএনপিসহ ২০ দলের নেতৃত্ব বিনাশের ষড়যন্ত্র’ সম্পর্কে দেশবাসীর সামনে তুলে ধরা হবে।

বৈঠক সম্পর্কে শাহাদাত হোসেন সেলিম ইত্তেফাককে জানান, গতকালের বৈঠকে কার্যত দুটি বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। প্রথমত, অলি আহমদকে দল থেকে অব্যাহতি দিয়ে নতুন নেতৃত্বে এলডিপির যাত্রা শুরু করা এবং বিএনপির নেতৃত্বাধীন ২০ দলের সঙ্গেই ঐক্য অটুট রাখা। এর বিকল্প হিসেবে দ্বিতীয়ত জাতীয়তাবাদী শক্তিকে শক্তিশালী করার পদক্ষেপ গ্রহণ। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, শিগিগরই আমরা আমাদের পরবর্তী করণীয় নির্ধারণ করব।

এলডিপির একাধিক নেতার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ‘জাতীয় মুক্তি মঞ্চ’ গঠনের পর থেকেই দলের অনেক নেতার সঙ্গে অলির দূরত্ব দেখা দেয়। বিশেষ করে, জামায়াতকে পুনর্বাসিত করতে পৃথক মঞ্চ গঠন, বিএনপির নেতৃত্বকে নিয়ে আপত্তিকর মন্তব্য করা এবং কাউন্সিল বা প্রেসিডিয়ামের বৈঠক ছাড়াই একক সিদ্ধান্তে দলের কেন্দ্রীয় কমিটি পুনর্গঠনের ঘটনা এ দূরত্বকে আরো বাড়িয়ে দেয়। এ নেতাদের দাবি, এলডিপিতে এখন দলের মহাসচিব রেদোয়ান আহমদসহ কয়েকজন ছাড়া উল্লেখযোগ্য কেউ অলির নেতৃত্ব মানতে রাজি নন।
 
জাতীয় মুক্তিমঞ্চ গঠনের সময় বিএনপি-জোটের যেসব শরিক দলের নেতারা অলি আহমদের পাশে বসেছিলেন, সেসব দলের মধ্যে জামায়াত ও খেলাফত মজলিস ছাড়া কল্যাণ পার্টি ও জাগপায় অভ্যন্তরীণ কোন্দল চলছে। এরই মধ্যে কল্যাণ পার্টির মহাসচিব এম আমিনুর রহমান দল থেকে পদত্যাগের চিঠি দিয়েছেন। জাগপার কেন্দ্রীয় নেতা লুত্ফর রহমানও জাতীয় মুক্তিমঞ্চের সঙ্গে পথ চলবেন না বলে জানিয়ে ২০ দলের সঙ্গে থাকার কথা দলের নেতৃত্বকে জানিয়ে দিয়েছেন।

রবের জেএসডিতে সংকট : আ স ম আবদুর রবের নেতৃত্বাধীন জেএসডিতে ভাঙন স্পষ্ট হয়ে উঠছে। এরই মধ্যে দলের সাধারণ সম্পাদক আবদুল মালেক রতন কাউন্সিল প্রত্যাখ্যান করে কনভেনশন ডেকেছেন। আগামী ১১ জানুয়ারি রাজধানীর কোনো একটি মিলনায়তনে এ সম্মেলন আয়োজন করা হবে। মালেক রতন জানান, মূলত রাজনৈতিক ও সাংগঠনিক কারণে জেএসডিতে সমস্যা তৈরি হয়েছে। দলের গঠনতন্ত্র না থাকায় কাউন্সিলের কোনো বৈধতা থাকে না। আমরা বলেছিলাম, আগে গঠনতন্ত্র তৈরি হোক, এরপর কাউন্সিল করা যাবে। কিন্তু আ স ম রব তা মানলেন না। ফলে আমরা নতুন করে আগে কনভেনশন করব।

প্রেসিডেন্ট পার্কে বিদিশা : ইত্তেফাকের সঙ্গে আলাপকালে বিদিশা অভিযোগ করেন, এরশাদের গাড়িচালক আউয়াল এরিককে বকাঝকা করেছে ও গায়ে হাত তুলেছে। এরিকের ফোন পেয়ে তিনি বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় প্রেসিডেন্ট পার্কে ছেলের কাছে যান। এখন সেখানেই অবস্থান করছেন। বিদিশার অভিযোগ, এখানে আসার পর তার কোনো লোকজনকে বাসায় ঢুকতে দেওয়া হচ্ছে না। পুলিশ বলছে কাউকে এ বাসায় ঢুকতে হলে জাপা চেয়ারম্যান ও এরশাদের ভাই জি এম কাদেরের অনুমতি লাগবে। এ অবস্থায় নিজেদের অবরুদ্ধ বলে দাবি করেন বিদিশা। এ বিষয়ে জি এম কাদের বলেছেন, এরশাদের অবর্তমানে এরকিকে কে দেখবেন, এই বাসায় কে থাকতে পারবেন কি পারবেন না—সেসব বিষয়ে জীবিত থাকাকালে এরশাদ সিদ্ধান্ত দিয়ে গেছেন। শিগিগরই বিষয়টি পরিষ্কার করা হবে বলে জানান জি এম কাদের।

ওয়ার্কার্স পার্টির বিদ্রোহীরা সম্মেলন করতে চান ২৯ নভেম্বর : রাশেদ খান মেননের নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টিতে অভ্যন্তরীণ সংকট এখনো কাটেনি। দলটির পলিটব্যুরোর প্রবীণ সদস্য ও সাবেক সাধারণ সম্পাদক বিমল বিশ্বাসের দল থেকে পদত্যাগের পর ‘বিদ্রোহ’ করেন দলটির ১১ সদস্যবিশিষ্ট সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরাম পুলিটব্যুরোর আরো দুই সদস্যসহ কেন্দ্রীয় ছয় নেতা। তারা হলেন—পলিটব্যুরোর সদস্য নুরুল হাসান ও ইকবাল কবির জাহিদ এবং দলের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য জাকির হোসেন হবি, মোফাজ্জেল হোসেন মঞ্জু, অনিল বিশ্বাস ও তুষার কান্তি দাস। গত ২ থেকে ৫ নভেম্বর অনুষ্ঠিত কংগ্রেসে রাশেদ খান মেনন দলের সভাপতি ও ফজলে হোসেন বাদশা সাধারণ সম্পাদক পুনর্নির্বাচিত হয়েছেন। তবে আগামী ২৯ নভেম্বর পৃথক সম্মেলনের প্রস্তুতি নিচ্ছেন বিদ্রোহীরা।

ইত্তেফাক/বিএএফ