শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

করোনাকালে ঘরে থাকা এবং আমাদের স্বভাব

আপডেট : ০৫ এপ্রিল ২০২০, ২২:১৭

চিররঞ্জন সরকার

ঁকাঁকড়াকে খোলা জায়গায় আটকে রাখা আর মানুষকে ঘরে রাখা—দুটিই কঠিন কাজ। কোনো মানুষেরই ঘরে মন বসতে চায় না। মানুষের স্বভাবই হচ্ছে মুরগির মতো টইটই করে ঘুরে বেড়ানো। কিন্তু মরণব্যাধি করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ প্রতিরোধে আমাদের দেশের মানুষকে আপাতত ঘরে থাকার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। সেই নির্দেশ পালন করতে গিয়ে সবাই অস্থির হয়ে পড়েছে। এমনিতেই আইন বা নিয়ম মানার ক্ষেত্রে আমাদের দেশের মানুষের রয়েছে চরম উদাসীনতা। নিতান্ত বাধ্য না হলে মোটা অঙ্কের জরিমানা, জেল খাটার ভয় কিংবা পুলিশের মাইরের আশঙ্কা না থাকলে কেউই আইন মানে না। নিয়ম তো আরো না। আর আমাদের দেশের যে সামাজিক সংস্কৃতি, তাতে ছোঁয়াচে রোগীকেও আলাদা রাখা অত্যন্ত কষ্টকর।

এ ব্যাপারে মনে পড়ছে বাল্যকালে চিকেন পক্সে আক্রান্ত হওয়ার অভিজ্ঞতা। ছোটোকালে দেখেছি, কেউ চিকেন পক্সে আক্রান্ত হলে তাকে আলাদা একটা ঘরে রাখা হতো। সেখানে যেন বাচ্চাকাচ্চারা না যায়, সে ব্যাপারে একটা নিষেধাজ্ঞাও আরোপ করা হতো। যদিও বাস্তবে সেই নিষেধাজ্ঞা কেউ খুব একটা মানত না। ঐ একঘরে থাকা রোগীর মা কিছুক্ষণ পরপর গিয়ে তার গায়ে-মাথায় হাত বুলিয়ে আসতেন। এরপর তিনি যথারীতি হাত না ধুয়েই কাজে লেগে পড়তেন। ভাইয়ের কষ্টে বোনেরাও কিছুক্ষণ পরপর গিয়ে কাঁথা গায়ে দেওয়া কিংবা গা থেকে কাঁথা সরিয়ে দেওয়ার কাজটি করত। একধরনের মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে বাবা কিংবা বড়ো ভাইয়েরাও গিয়ে কপালে হাত বুলিয়ে আসতেন। নানি-দাদিরা তো ঐ ঘায়ের মধ্যে হাত বুলিয়ে দিতেন কিংবা সুড়সুড়ি দিতেন, যেন ব্যথাটা কমে বা কম চুলকায়!

বন্ধুবান্ধবও আসত। প্রথমে একটু দূরেই বসত। তারপর আলাপে-আলাপে শিয়রে গিয়েই বসত। কাছে না বসলে ঘনিষ্ঠতা প্রকাশ পায় নাকি? না গল্প করা যায়? আর ছোটোরাও ঐ রোগীর বেডের চারপাশেই ঘুরঘুর করত বেশি। নিষেধাজ্ঞা থাকলে তার প্রতি আকর্ষণ মানুষের চিরন্তন। শিশুমনও কেবল ঐ বিছানার ধারে যেতে চাইত। আর রোগীও শুয়ে থাকতে থাকতে বিরক্ত। তারাও একসময় বাচ্চাদের কাছে ডাকত। একসময় বিছানায় বসতে বলত। কিন্তু কেউই স্বাস্থ্যবিধি মেনে হাত ধুত না কিংবা কাপড় পরিবর্তন করত না। এভাবে ১০ দিন, ১৫ দিন এমনকি এক মাস ভুগে একসময় ঐ ছোঁয়াচে রোগের হাত থেকে সংশ্লিষ্ট রোগীর রেহাই মিলত। কিন্তু পরিবারের আরো কয়েক জন ক্রমান্বয়ে আক্রান্ত হতো। এই তো আমাদের দেশের কোনো একটি ছোঁয়াচে রোগে আক্রান্ত রোগীর বিচ্ছিন্ন বা একঘরে থাকার নমুনা।

করোনা ভাইরাস নিয়ে যারা ‘হোম কোয়ারেন্টাইনে’ আছেন বলে দাবি করা হচ্ছে, তারা যে কেমন ‘কোয়ারেন্টাইন’ করছেন, তা সহজেই অনুমান করা যায়। দূরত্ব বজায় রেখে চলা, একা থাকা, জনসমাবেশে না যাওয়া, আড্ডা না দেওয়া—এসব আমাদের সমাজে পালন করা খুবই কঠিন। তা ছাড়া আমাদের দেশের মানুষের মধ্যে রয়েছে যে কোনো ব্যাপারে সীমাহীন কৌতূহল। রাস্তার মেরামতকাজ দেখার জন্যও এদেশে ভিড় জমে যায়। হোম কোয়ারেন্টাইন নিয়ে আমার এক সাংবাদিক বন্ধু মজার অভিজ্ঞতা বর্ণনা করেছেন। তিনি লিখেছেন, ‘সিলেটে এক প্রবাসীর বাড়ির সামনে ভিড় দেখে এক সাংবাদিক কয়েক জনের ইন্টারভিউ করার সিদ্ধান্ত নিলেন। পাশে ডেকে একজনকে প্রশ্ন করলেন, কী দেখতে এখানে ভিড় করেছেন?

: কোয়ারেন্টিন দেখতে।

: কোয়ারেন্টিন দেখার কী আছে?

: শুনেছি কোয়ারেন্টিনে নাকি পা ওপরে আর মাথা নিচে দিয়ে থাকতে হয়। এই প্রবাসী সেটা কীভাবে করছে দেখতে এসেছি।’

এই দুঃসময়ে আসলে আমরা সবাই খুব বিপদে আছি, দুশ্চিন্তায় আছি। মানুষের সব অহংকার, সব বড়াই আজ প্রশ্নবিদ্ধ। করোনা ভাইরাস ইতিমধ্যে বুঝিয়ে দিয়েছে, সভ্যতা এগোলেও মানুষের আদিম অসহায়ত্ব এখনো ঘোচেনি। একটা অদৃশ্য ভাইরাসের কাছে উন্নয়ন-অগ্রগতি, মহাকাশ গবেষণা, যুদ্ধবিমান, আর্টিফিশিয়াল ইন্টিলিজেন্স, অত্যাধুনিক প্রযুক্তি, অর্থবিত্ত-ক্ষমতা কতটা অসার! মিথ্যা অহংকারে ঠাসা একটা কৃত্রিম জীবন আমরা যাপন করছি। পুরোটাই ম্যাকানিক্যাল। কোথাও প্রাণের ছোঁয়া নেই। এই অভ্যস্ত জীবন আমাদের এতটাই দেউলিয়া বানিয়েছে যে আমরা এখন সময় কাটাতেও পারি না। রুটিনের বাইরে গিয়ে বাঁচার উপায় যেন ভুলে গেছি!

করোনা ভাইরাসের মোকাবিলা করতে গিয়ে এখন উচ্চবিত্ত আর মধ্যবিত্তরা সবাই প্রায় ‘গৃহবন্দি’। ক্রমশই প্রকাশ পাচ্ছে, নিজের বাড়িতে এসব ‘আধুনিক’ মানুষের কিছুই করার নেই! সিনেমা হল বন্ধ, শপিং মল বন্ধ। টিভি খুললে খেলা নেই। সিরিয়ালও রিপিট শুরু করল বলে! কারণ শুটিংও তো বন্ধ! তাহলে লোকে করে কী? সবাই তো আর নেটফ্লিক্স, অ্যামাজন প্রাইম—এগুলোয় অন্তরঙ্গ (ফ্যামিলিয়ার) হতে পারেনি।

টিভিতে যে খবর দেখব তারও উপায় নেই। কারণ তাতে সারাক্ষণ করোনা নিয়ে এত আলোচনা চলছে, কিছুক্ষণ পরেই মাথা ঝিমঝিম করে। এসব শুনলে মনে হতে বাধ্য যে আমার মধ্যে সব কটা লক্ষণ দেখা যাচ্ছে করোনা ভাইরাস আক্রমণের।

ফেসবুকেও শুধু এই এক ভাইরাস নিয়ে একঘেয়ে সব আলোচনা, উদ্বেগ, হতাশা, প্যাঁচাল! বাকি রইল বই পড়া। কিন্তু সেই অভ্যাস বহুদিন আগেই যে চলে গেছে। একটা বড়সড় উপন্যাস খুলে বসলেই মাথা ঝিমঝিম করে। শেষে কি তাহলে বাড়ির লোকের সঙ্গে, মানে স্ত্রী, সন্তান, ‘কাজের লোক’—এদের সঙ্গে গল্পগুজব করে দিন কাটাতে হবে? এদের সঙ্গে বড়োজোর কিছু ‘প্রয়োজনের’ কথা চলতে পারে, দু-চারটা কাটা কাটা বাক্য বলে, মেজাজ দেখিয়ে গটগট করে অফিসে চলে যাওয়া যায়। এরা কথা বলতে এলেই ‘কাজ আছে’ বলে খেঁকিয়ে ওঠা যায়। কিন্তু সত্যি সত্যি বসে গল্প, আড্ডা, মজা করা? পুরোনো দিনের স্মৃতি রোমন্থন, নতুন দিনের পরিকল্পনা? আমরা কি সত্যিই তা শিখেছি? গত কয়েক দশকে অলক্ষে আমরা সবাই যে একেকজন ‘মহান’ অসামাজিক জীবে পরিণত হয়েছি!

করোনা ভাইরাস আমাদের নতুন করে জীবন যাপন করতে শেখাচ্ছে! জীবন সম্পর্কে নতুন করে ভাবাচ্ছে!

তার পরও মানুষকে ঘরে থাকতে হবে। কারণ এই রোগ থেকে বাঁচার কোনো উপায় এখনো আবিষ্কৃত হয়নি। এই ভাইরাসের সংক্রমণ যেন না ঘটে, সে জন্য নিজেকে আলাদা রাখা, ঘরে থাকা, স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলাকেই তাই আপাতত করোনা থেকে রেহাই পাওয়ার শ্রেষ্ঠ পথ বলে মনে করা হচ্ছে। এ জন্য কষ্ট করে হলেও আমাদের ঘরে থাকতে হবে। স্বাস্থ্যবিধি ও সরকারি ঘোষণা মেনে চলতে হবে।

এ ব্যাপারে প্রশাসনকেও প্রয়োজনে কঠোর হতে হবে। পুরো ব্যাপারটিকে মানুষের ‘সচেতনতা’র ওপর ছেড়ে দিলে বিপদ বাড়তে পারে।

পুনশ্চ :একটা প্রাচীন গল্প দিয়েই শুরু করা যাক। এক গরিব লোক খুব সকালে তার বাড়ির সামনের রাস্তায় বসে চিত্কার করে বিলাপ করছে: হায় হায়, আমার কী হইল রে, আমার সর্বনাশ হইয়া গেল রে, সব মুরগি শেয়ালে খাইয়া সাফ কইরা দিছে রে...!

এই বিলাপ শুনে এক প্রতিবেশী এগিয়ে এসে তার গায়ে-মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। সহানুভূতি জানিয়ে তাকে শক্ত হতে বলে। এরপর ভদ্রলোক জিজ্ঞেস করে, মুরগিগুলো শিয়ালে কীভাবে নিল? কোথায় ছিল?

ওই বিলাপরত লোকটি বিলাপ করেই বলতে তাকে :ঐগুলারে আমি তো খোপের মধ্যেই রাখছিলাম রে ভাই!

এবার প্রতিবেশী ভদ্রলোক অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, খোপের মধ্য থেকে শিয়াল কীভাবে মুরগি নিল? দরজা ভেঙে?

বিলাপকারী ব্যক্তি বলতেই থাকে, নারে ভাই, দরজা শিয়ালে ভাঙে নাই, দরজা তো খোলাই আছিল রে ভাই?

এবার প্রতিবেশী ভদ্রলোক বিস্ময়ের সঙ্গে জিজ্ঞেস করে, মুরগির খোপের দরজা আটকাও নাই? ভোদাই নাকি তুমি? তাইলে তো তোমার মুরগি শিয়ালে নেবেই! কিন্তু তুমি দরজা আটকাও নাই কেন?

জবাবে লোকটি আরো করুণভাবে বিলাপ করতে করতে বলে :আমি শিয়ালের ইমানডা পরীক্ষা করতে চাইছিলাম রে ভাই...!

জাতি হিসেবে আমরা জাপানিদের মতো ভদ্র, সভ্য, নম্র নই। আমরা হলাম খেয়ালি, অপরিণামদর্শী, বেপরোয়া ও বিদঘুটে স্বভাবের। ‘এখানে প্রস্রাব করিবেন না’ বিজ্ঞাপন দেখলে আমরা ব্যাকুল হয়ে উঠি সেখানে প্রস্রাব করার জন্য। ‘হাত দেবেন না’ লেখা দেখলে যাওয়ার সময় পা দিয়ে একটা গুঁতো মারার চেষ্টা করি। আমাদের যেটা নিষেধ করা হয়, সেটা করতে আমরা আগ্রহী হই বেশি।

এমন স্বভাব যাদের, তাদের বলে-কয়ে, অনুরোধ করে তেমন কোনো উপকার পাওয়া যায় না। তবে এদেশের মানুষ লাঠি আর বন্দুককে ভয় পায়। র্যাব কিংবা আর্মি দেখলে তাই অতি বড়ো ঘাড়ত্যাড়া বেয়াদবও মাথা নিচু করে কথা বলে, সোজা হয়ে পথ চলে। কারণ ঐ বাহিনী পশ্চােদশে লাঠি ও লাথি বসাতে খুব একটা সময় নেয় না। ‘যেমনে খুশি তেমনে চলি’ স্বভাবের বঙ্গসন্তানদের মোক্ষম দাওয়াই হচ্ছে প্যাদানি! বাধ্য না করলে, প্যাদানি না দিলে কেউ দায়িত্ব-কর্তব্য পালনে আগ্রহ দেখায় না!

কাজেই এখানে শুধু ‘শিয়ালের ইমান পরীক্ষা’ করলেই চলবে না, প্রয়োজনে কঠোর হওয়ার বিকল্প নেই।

n লেখক :রম্যরচয়িতা