খালিদ ফেরদৌস
করোনা ভাইরাস পরিস্থিতির অবনতির কারণে দরজায় কড়া নাড়তে নাড়তে অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত হয়ে গেছে ২০২০ সালের এইচএসসি, আলিম বা সমমানসহ স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের সব পরীক্ষা ও শিক্ষা কার্যক্রম। যা বাংলাদেশের ইতিহাসে একটা বিরল ঘটনা। তবে শিক্ষার্থীসহ সংশ্লিষ্ট সবাইকে মনে রাখতে হবে পড়ালেখা যেমন জীবনের তাগিদে; তেমনি পরিস্থিতি সুবিবেচনায় পরীক্ষা স্থগিত করা হয়েছে জীবনের স্বার্থে। এটা মেনে নিয়ে পরবর্তী করণীয় নির্ধারণ করে সবাইকে পথ চলতে। অনেকে সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা করে সময়ের সদ্ব্যবহার করছেন।
এইচএসসি পরীক্ষার্থীসহ সব শিক্ষার্থীর করোনা ভাইরাসের দ্বারা উদ্ভূত পরিস্থিতিতে হাত গুটিয়ে হোম কোয়ারেন্টাইনে ফেসবুক বা স্যোশাল মিডিয়াতে সময় কাটালে খুব আত্মঘাতী হবে। যেভাবেই হোক বর্তমান পরিস্থিতিতে শিক্ষার্থীদের সামনে জ্ঞান অর্জনের অবারিত একটা সুযোগ এসেছে। এই অপ্রত্যাশিত ঘটনাকে সুযোগ মনে করে তোমাদের যে সমস্ত পাঠ্য বিষয়ে কম প্রস্তুতি ছিল সেগুলোকে ঝালিয়ে নিতে হবে। মনে রাখতে হবে করোনা ভাইরাসের মহামারি অবস্থা শুধু শিক্ষাব্যবস্থায় না, মানুষের জীবনযাত্রার সব ক্ষেত্রে ভয়াবহ প্রভাব ফেলেছে। হয়তো এটার মাধ্যমে প্রাকৃতিক পরিবেশ ফিরে পাচ্ছে তার জীব-বৈচিত্র্য। মানবিক পরিবেশ ফিরে পেয়েছে মানবিকতাবোধ ও ধর্মের ঊর্ধ্বে উঠে মানবহিতৈষী দর্শন। কিন্তু এটা পৃথিবীকে কার্যত স্থবির করে দিয়েছে। করোনা পরিস্থিতির কারণে বিশ্বকে অপূরণীয় ক্ষতির মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছে। করোনা ভাইরাস পরিস্থিতি অন্যান্য ক্ষতির পাশাপাশি শিক্ষাব্যবস্থায়ও চোখে পড়ার মতো নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে, যা শিক্ষার্থীরা খুব সহজে অনুমান করতে পারছে।
এমতাবস্থায় শিক্ষার্থীদের প্রধান দায়িত্ব পড়া, পড়া এবং পড়া। শারীরিকভাবে সুস্থ-সবল থাকতে দরকার হলে বাসার ভেতর শারীরিক ব্যায়াম করতে হবে। কোনোভাবে পরীক্ষা অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত আছে বলে পড়া ফেলে রাখা যাবে না। মনে রেখ, একটা সুই যদি দীর্ঘদিন ব্যবহার না করে ফেলে রাখা হয় তাতে মরিচা ধরে। তেমনি তোমরা যদি তোমাদের শাণিত মগজকে বেশি দিন বিশ্রাম দাও তবে এটি সুইয়ের মরিচা ধরার মতো অকেজো হয়ে যাবে। পরে যখন আবার লেখাপড়া শুরু করবে তখন দেখবে কোনো পড়া মুখস্থ করতে অনেক বেগ পেতে হচ্ছে। পড়া ছেড়ে দেওয়ার মতো আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত কোনোভাবেই চিন্তা করা যাবে না।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এইচএসসি বা সমমানের পরীক্ষা একজন ছাত্রের জীবনে সবচেয়ে তাত্পর্যবহ। এই পরীক্ষার ওপর নির্ভর করবে সে ভালো বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তিসহ ভবিষ্যতে পেশাগত জীবনে কতটা সফল বা ব্যর্থ হবে। তাই পরীক্ষার্থীদের এক মিনিট সময় নষ্ট করার ফুসরত নেই। সময় পেলেই পরীক্ষার বিষয়ভিত্তিক পড়া পড়ে এগিয়ে নিতে হবে।
এর পরেও একটা বিষয়ের ওপর লক্ষ্য রাখতে হবে, এইচএসসি বা একাডেমিক পরীক্ষা জীবনের শেষ কথা নয়। পরীক্ষা স্থগিত হয়ে গেছে বলে কোনোভাবে গড্ডালিকা প্রবাহে গা ভাসিয়ে দেওয়া যাবে না। বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষার আগ পর্যন্ত সময়ের উপযুক্ত ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। এই সময়ের সদ্ব্যবহারের ওপর এইচএসসি শিক্ষার্থীদের ভালো প্রতিষ্ঠানে ভর্তি অনেকাংশে নির্ভর করে। দেখা গেছে, তুলনামূলক কম সিজিপিএ পেয়েও অনেক ছাত্রছাত্রী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, বুয়েট, মেডিক্যালসহ বিভিন্ন ভালো ভালো প্রতিষ্ঠানে ভর্তি ও ভালো ভালো সরকারি-বেসরকারি সংস্থায় চাকরি করার সুযোগ পেয়েছে। যদি প্রাণান্তকর চেষ্টার পরও আশানুরূপ একাডেমিক রেজাল্ট বা সফলতা না আসে তবে ভেঙে পড়া যাবে না। বিল গেইটস, স্টিভ জবস, মার্ক জাকারবার্গ, টমাস আলভা এডিসন, আর্লবার্ট আইনস্টাইন কেউই ভালো ছাত্র ছিল না। কিন্তু তারা আজ নিজ উদ্যোগ ও উদ্ভাবনী গুণাবলীর মাধ্যমে ভালো ছাত্রছাত্রীদের কাছে রোল মডেল। ভালো রেজাল্ট না হলে, ভালো বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে না পারলে হয়তো পেশাগত জীবনে ভালো ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার বা ভালো সচিব-আমলা হওয়া যায় না; কিন্তু নিজের উদ্যোগ ও কর্মযোগ্যতায় প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলে যোগ্য ও দক্ষ ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, সচিব-আমলাদের চাকরির সংস্থান করা যায়।
যার প্রমাণ বাংলাদেশসহ সারাবিশ্বে ভূরি ভূরি আছে।
যা হোক, করোনা ভাইরাস সৃষ্ট সমস্যা হয়তো বদলে দিতে পারে তোমার ভবিষ্যত্। তাই বিদ্যমান পরিস্থিতিকে ইতিবাচকভাবে নিয়ে পড়ায় আত্মনিয়োগ করতে হবে। করোনা পরিস্থিতি ভালো হয়ে গেলে অত্যন্ত সংক্ষিপ্ত নোটিশে নতুন পরীক্ষার রুটিন হয়ে যাবে। ধারণা করা হচ্ছে, শিক্ষাবর্ষ ঠিক রাখার জন্য নতুন এইচএসসি ও অন্যান্য পরীক্ষার রুটিনে শুক্রবারে ছুটি ছাড়া পরীক্ষার মাঝে কোনো বন্ধ বা বিরতি নাও থাকতে পারে। এমনকি শুক্রবারেও যদি পরীক্ষা হয় তবে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে শিক্ষার্থীদের এখন ধ্যান-জ্ঞান হওয়া উচিত্ হবে—এক মুহূর্ত সময় নষ্ট না করে আগামী এইচএসসি বা যার যে একাডেমিক পরীক্ষা আছে তা সফল ও সুন্দরভাবে শেষ করার জন্য পড়াশোনার মাঝে মশগুল থাকা।
n লেখক: এমফিল গবেষক,
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়