ঊনবিংশ থেকে বিংশ শতাব্দীর সবচেয়ে ভয়ংকর মহামারির সময় চলছে এখন, যা এখন পর্যন্ত লাখ লাখ মানুষের প্রাণহানি ঘটিয়েছে। প্রাণহানির সংখ্যাটি যে লাখ থেকে কোটিতে গিয়ে পৌঁছাবে না, এখন পর্যন্ত তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। এই মৃত্যুর মধ্যেও যে মৃত্যুগুলো আমাদের বেশি ব্যথিত করবে তা হলো মানুষ যখন খাদ্যাভাবে মৃত্যুবরণ করবে।
কিছু দিন আগেও কোভিড-১৯-এর সংক্রমণের দরুন মানবেতর জীবন-যাপন করছিল আমাদের দেশের দরিদ্র শ্রেণির মানুষজন। কয়েকটা দিনের ব্যবধানে দারিদ্র্য গ্রাস করতে শুরু করেছে আমাদের মধ্যবিত্তদেরও। দেশের নিম্ন আয়ের মানু্ষ তো দূরের কথা মধ্যবিত্তদেরই বর্তমানে জীবনযাত্রার মান বজায় রাখতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। কোভিড-১৯-এর প্রভাবে যেমন স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি হয়েছে, তেমনি জীবিকা নিয়েও বিপদে পড়েছেন বিশেষত মধ্য ও নিম্ন আয়ের অনেক মানুষ। এমন দু-একটি প্রতিষ্ঠান নয়, করোনার থাবায় ভয়াবহ সংকটে পড়েছেন দেশের ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তা।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর ২০১৯ সালের জরিপ অনুযায়ী দেশে বর্তমানে ৪৬ হাজার ২৯১টি উত্পাদন ইউনিটের মধ্যে ৮৭ শতাংশই ক্ষুদ্র ও কুটিরশিল্প। বর্তমানে দেশের উত্পাদন খাতের ৩৩ শতাংশ উত্পাদন করে থাকে ক্ষুদ্র ও কুটিরশিল্প। এ শিল্পের সঙ্গে ১৩ লাখ ৯১ হাজার শ্রমিক ও কর্মকর্তা-কর্মচারী জড়িত রয়েছেন। দেশের কর্মসংস্থানের সিংহভাগ রাজধানী ঢাকাকেন্দ্রিক হওয়ায় বিভিন্ন অঞ্চলের লোকজন কাজের সন্ধানে রাজধানীমুখী হতেন। প্রতিদিনই কর্মসংস্থান বা ভাগ্য পরিবর্তনের আশায় ঢাকায় আসতেন মানুষ। এভাবে দেড় হাজার বর্গকিলোমিটারের এ নগরীর বাসিন্দার সংখ্যা দাঁড়িয়ে যায় প্রায় ২ কোটি, যাদের প্রায় ৮০ শতাংশই ভাড়া বাসার বাসিন্দা। নিরুপায় ও বাধ্য হয়ে প্রাণের শহর ঢাকাকে বিদায় জানাতে হচ্ছে হাজার হাজার নিম্নমধ্যবিত্ত ও মধ্যবিত্তদের।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম, টেলিভিশন বা পত্রপত্রিকায় আমরা প্রতিদিনই দেখছি মালপত্র ট্রাকে ভরে শহর ছাড়ছে মানুষ। কেউ কেউ মালপত্র রেখেই যাচ্ছে। তাদের মধ্যে রয়েছেন বেসরকারি চাকরিজীবী, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী, গার্মেন্টস শ্রমিক, ছাত্র-শিক্ষক ও বিভিন্ন পেশার মানুষ।এমতাবস্থায় নিম্নমধ্যবিত্তদের অর্থনৈতিক অবস্থার অবনতির বিষয়টি স্বাভাবিক হলেও মধ্যবিত্তদের মাত্র চার মাসেই অর্থনৈতিক অবস্থার এতটা অবনতি মেনে নেওয়াটা একটু কষ্টকর নয় কি? মধ্যবিত্ত বলতে আমরা কী বুঝি? যারা মাসিক বেতনের ভিত্তিতে কাজ করে, যাদের আয় নির্ধারিত, এই নির্ধারিত আয়ের বাইরে কোনো আয় নেই—মূলত তারাই মধ্যবিত্ত। মধ্যবিত্তরা দারিদ্র্যসীমার ওপরে বসবাস করে কিন্তু তারা উচ্চবিত্ত নয়। আমাদের মধ্যবিত্তদের জীবনযাপনে নির্ধারিত আয়ের মতো জীবনব্যবস্থার মানও হয় নির্ধারিতই। আমরা মধ্যবিত্তরা যদি হঠাত্ কোনো বিপদে পড়ি, তাহলে কিন্তু সেই বিপদ মোকাবিলার জন্য পরিবারের উপার্জনক্ষম ব্যক্তির আয় নির্ধারিত থেকে একটুও বাড়বে বা কমবে না। যেমন, হঠাত্ করে যে এভাবে করোনা মহামারি হানা দেবে, আমরা কেউই জানতাম না। কারণ বিপদ কখনো বলে-কয়ে আসে না। এজন্য বিপদ মোকাবিলার জন্য নিম্নবিত্ত থেকে শুরু করে মধ্যবিত্ত সবারই কিছু সঞ্চয় রাখা আবশ্যক।
দেশের শ্রমশক্তি জরিপ অনুযায়ী দেশের প্রায় ২৭ লাখ বেকার আছেন এবং এ বেকারদের মধ্যে ৩৯ ভাগই শিক্ষিত বেকার। শিক্ষিত তরুণ সমাজকে যে কোনো ক্ষুদ্র ব্যবসায়ের মাধ্যমে আমরা আমাদের বর্তমান সময়ের মোকাবিলা করতে পারি। সবজি চাষ, মাছের পুকুর, হাঁস-মুরগি পালন, কুটিরশিল্প ইত্যাদি বিভিন্ন মাধ্যমে নারী-পুরুষনির্বিশেষে একত্র হয়ে এই কঠিন সময়ের ঢাল হতে পারে তরুণ সমাজ। বর্তমানে দেশের সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের প্রণোদনার অংশ হিসেবে দেশে গ্রামীণ ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের সরকারিভাবে সহজ শর্তে ও বিনা সুদে ঋণ প্রদান করতে হবে। তাদের উত্পাদিত পণ্য যাতে পুনরায় বাজারে সহজে প্রবেশ করতে পারে, সেজন্য সরকারি এবং বেসরকারি উদ্যোগ নিতে হবে। সেই সঙ্গে এই অসুস্থ পৃথিবী একদিন না একদিন সুস্থ হবেই, সেই দিনের প্রত্যাশা করি এবং বিগত দিন থেকে শিক্ষা নিয়ে হলেও আমরা ভবিষ্যতের জন্য একটু দায়িত্বশীল হই।
n লেখক :শিক্ষার্থী, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া