১৯৬০-৬২ শিক্ষাবর্ষের নটরডেমিয়ান সহপাঠী আনোয়ার হোসেন মঞ্জু যখন ফাদার টিমকে নিয়ে একটি নিবন্ধ লিখতে অনুরোধ করল, সঙ্গে সঙ্গে আমি উত্তর দিলাম, অবশ্যই! শত হলেও আমি ফাদার টিমের কাছে গভীরভাবে ঋণী। তিনি ছিলেন একজন স্বনামধন্য শিক্ষক। কিন্তু তার চেয়েও বড় কথা, তিনি একজন পরম মানুষ। আজ আমার যেটুকু অবস্থান, তার পথ তৈরিতে চূড়ান্ত অবদান রেখেছেন ফাদার টিম। কিন্তু আমি এই নিবন্ধ লিখতে বসে আমার হূদয় ভারাক্রান্ত হয়ে উঠেছে। ব্যক্তিগতভাবে তাকে হারিয়ে আমি আড়ষ্ট হয়ে গিয়েছি। নির্মল মন আমার কুয়াশাচ্ছন্ন হয়ে উঠেছে। কোথা থেকে শুরু করব? অবশ্যই সেসব কথা রিপিট করব না, যা যুক্তরাষ্ট্রের ইনডিয়ানা অঙ্গরাজ্যে জন্মগ্রহণকারী তার সম্পর্কে ইতোমধ্যে লেখা হয়েছে। হলিক্রসের যাজক হওয়ার ১০ বছর পর, ১৯৫২ সালে এই মানুষটি তার বাকি জীবন বাংলাদেশে সেবা দেওয়ার ব্রত নিয়ে এসেছিলেন।
ফাদার ঈশ্বরের কাছে চিরকালের জন্য শায়িত হতে চলে যাওয়ার চার ঘণ্টা পর আমি ভার্জিনিয়ার বন্ধু জো ডি সিলভার কাছ থেকে সংবাদটি জানতে পেলাম। এমন সময় সংবাদটি এলো, যখন আমি এক দিন পরের একটি গুরুত্বপূর্ণ ওয়েবিনারে মডারেশন নিয়ে ব্যস্ত। জো-র কাছ থেকে সংবাদটি পেয়ে আর ঐ কাজে মন বসছিল না। বন্যার মতো অসংখ্য স্মৃতি এসে ঘিরে ধরছিল।
ফাদার টিমের সঙ্গে আমার প্রথম দেখা হয় ১৯৬০ সালে। আমি ম্যাট্রিক পাশ করে আইএসসি ক্লাসের ভর্তির জন্য আবেদন করলে তা গৃহীত হয়। তত্কালীন প্রিন্সিপাল ফাদার ডব্লিউ এল গ্রাহামের কাছে আনুষ্ঠানিক ইন্টারভিউ দেওয়ার পর আমাকে বলা হয় ফাদার রিচার্ড ডব্লিউ টিমের সঙ্গে দেখা করতে। তিনি তখন স্টাডিজের পরিচালক। ফাদার টিমের অফিস ছিল তিনতলায়। সিঁড়ি দিয়ে উঠলে হাতের ডানে একেবারে শেষ প্রান্তে একটি ছোট কক্ষ। এর পাশেই ছিল বিশাল শ্রেণিকক্ষ, যেখানে পরবর্তী সময়ে আমি অনেক ক্লাস করেছি বিভিন্ন বিষয়ে বিভিন্ন শিক্ষকের কাছে। ফাদার টিম পড়াতেন বায়োলজি। লম্বা হালকা-পাতলা মানুষ, ভরাট কণ্ঠস্বর। যে-ই তার সান্নিধ্যে আসেন, তাকে বন্ধু করে নেন। প্রথম দর্শনেই আমি তার প্রতি একটি আকর্ষণ বোধ করি, যেটা বর্ণনা করে বোঝানো যাবে না।
বেশ কয়েকটি কারণে আমি আইএসসি পড়তে মনস্থ করি। সেন্ট গ্রেগরি স্কুলে আমি সাধারণ বিজ্ঞানে ভালো করেছিলাম। ব্রাদার ডোনাল্ডের দ্বারা জীববিজ্ঞানের প্রতি আগ্রহ তৈরি হয়েছিল। (তিনি ছিলেন একজন আইরিশ। হঠাত্ রেগে যেতেন। কিন্তু গান গাইতে খুব পছন্দ করতেন।) দি মাইক্রোভ হান্টার্স নামে একটি বই পড়েও উদ্বুদ্ধ হয়েছিলাম। রোমাঞ্চিত হয়েছিলাম মাইক্রোবায়োলজিস্ট হওয়ার জন্য। কিন্তু অঙ্ক ছিল আমার জন্য অভিশাপের মতো। আমি অঙ্ক দেখলে ভড়কে যেতাম। যা-ই হোক, আমি ম্যাট্রিকে পাশ নম্বর পেয়েই পার হলাম।
ফাদার টিমের সঙ্গে সেই প্রথম সাক্ষাতে তিনি আমার সবকিছু জানলেন। তিনি আমার ইংরেজি ক্ল্যাসিক পড়ার আগ্রহের বিষয়টিও জানলেন। ছোট করে হাসলেন, কিন্তু বড় করে স্বাগত জানালেন। আমার সাহিত্যপ্রীতির কারণে তিনি আমাকে পরামর্শ দিলেন কলেজের প্রকাশনার সঙ্গে যুক্ত হতে।
স্বীকার করতেই হবে, যে দুটো ক্লাস আমি আইএসসি ক্লাসে উপভোগ করতাম তার একটি হলো ফাদার টিমের জীববিজ্ঞান ও ইংরেজি, যা পড়াতেন ফাদার বানাস এবং ফাদার লোরাসো। দ্বিতীয় বর্ষে থাকতে একদিন ফাদার টিমের মুখোমুখি হলাম। তিনি মাঝেমধ্যেই হঠাত্ করে আমাদের পরীক্ষা নিতেন। একদিন আমি সম্পূর্ণ অপ্রস্তুত ছিলাম। তিনি আমাকে দুটি প্রশ্ন দিলেন। একটির ব্যাপারে আমার কোনো ধারণাই নেই। অন্য প্রশ্নটি ছিল মেটামোরফোসিস নিয়ে। সেই বেখাপ্পা অবস্থাতেই আমি মেটামোরফসিস সম্পর্কে যা জানি তা লিখতে শুরু করলাম। মেটামোরফসিস সাহিত্য নিয়ে কয়েক পৃষ্ঠা লিখে ফেললাম। দ্বিতীয় প্রশ্নটি কোনোমতে দায়সারাভাবে লিখলাম। কয়েক দিন পর তিনি নিঃশব্দে মুচকি হেসে আমার হাতে আমার পেপার ধরিয়ে দিলেন। তিনি পেনসিল দিয়ে মাত্র দুটি শব্দ লিখেছেন এবং আশ্চর্যবোধক চিহ্ন ব্যবহার করেছে, ‘কত কাব্যিক!’
ফাদার টিম আমাদের বোটানির প্র্যাকটিক্যাল ক্লাসের জন্য বাইরে নিয়ে যেতেন। একদিন তিনি আমাদের কলেজের কাছেই একটি বিলের ধারে নিয়ে গেলেন শাকসবজি ধরনের গাছ দেখাতে। আমরা ক্লাসে কী পড়েছি এবং বাস্তবে সেগুলো কী তা দেখাতেন। যে বই পড়তাম, তা লিখেছিলেন যৌথভাবে ভুঁইয়া ও টিম। তিনি ছাত্রদের হাতে-কলমে শিক্ষা দিতে পছন্দ করতেন, হোক সেটা ল্যাবরেটরি ক্লাসে অথবা মাঠ পর্যায়ে। একজন শিক্ষার্থী একটি উদ্ভিদ চিনতে না পেরে হতাশ হয়ে বলল, ‘ফাদার টিম কাঁহা হ্যায়!’ আমাদের পেছন থেকেই গলার স্বর ভেসে এলো, ‘ফাদার টিম ইহা হ্যায়!’ তারপর স্বতঃস্ফূর্ত হয়ে আমাদের সঙ্গে যোগ দিয়ে তিনি ছোটখাটো একটা লেকচার দিলেন ঐ উদ্ভিদটি সম্পর্কে। আমরা বার্ষিক পিকনিকে কোথাও না কোথাও যেতাম। তখন সেখানে শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের মাঝের দেওয়ালটি উঠে যেত। আমরা তখন একসঙ্গে ফুটবল খেলতাম অথবা তাস খেলতাম। ফাদার টিমই আমাদের ব্ল্যাকজ্যাক খেলতে শিখিয়েছিলেন। তবে অবশ্যই পয়সা বা বাজি ধরে নয়।
নটরডেম কলেজ থেকে বিদায় নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার আগে আমার ফাদার টিমের সঙ্গে সাক্ষাত্ হলো। আমাকে ডাকা হয়েছিল। তার রুমে প্রবেশ করতেই তিনি আমাকে বসতে বললেন। তিনি তার হাতের দুটো জিনিস আমাকে দেখালেন। এক হাতে একটি সাইড রুলার (যা অঙ্কের হিসাব মেলাতে লাগে) আর অন্য হাতে নটরডেমের প্রতীক অঙ্কিত একটি টাইপিন। জানতে চাইলেন, আমি কোনটা চাই। আমি একটু ভড়কে গেলাম। আমি জানি, কোনো পুরস্কার পাওয়ার মতো পরীক্ষার ফলাফল আমার নয়। তিনি একটু মুচকি হেসে বললেন, ‘তোমাকে এই বছর নটরডেমের ম্যান অব দ্য ইয়ার হিসেবে বেছে নেওয়া হয়েছে।’ শুনে মহানন্দ অনুভূত হলেও আমি হতবাক হয়ে রইলাম। তিনি বললেন, ‘এটা বাছাইয়ের সময় আমরা পরীক্ষার গ্রেডের বিষয়টি বিবেচনায় নিইনি।’
১৯৬৭ সালের অক্টোবরে ফরেন সার্ভিসে যোগদানের পর বাইরের দেশে থাকা এবং নিজে ব্যবস্থা থাকা শুরু হয়। আমি দেশ থেকে বাইরে যাওয়ার আগে বেশ কয়েক বার তার সঙ্গে দেখা করেছি। ১৯৭৩ সালে আমি স্বাধীন বাংলাদেশে ফেরার পর তার সঙ্গে দেখা করি। আমার এক ছোট ভাই নটরডেমে ভর্তি হলে তাকে পরিচয় করিয়ে দিতে গেলাম। তিনি সব সময় আমার প্রতি ছিলেন উষ্ণ। ২০০৯ সালে আমি সরকারের কাজে যোগদানের পর আমি নটরডেমের সঙ্গে, আমার শিক্ষক টিমের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে আপ্রাণ চেষ্টা করি। আমি তার সঙ্গে অল্প কিছুকাল যোগাযোগ রক্ষা করতে পেরেছিলাম। তারপর আবার আমাকে দীর্ঘ আট বছরের জন্য দিল্লিতে অ্যাসাইনমেন্ট দিয়ে পাঠানো হয়। এরপর আমি বিক্ষিপ্তভাবে তার সঙ্গে যোগাযোগ রেখেছি। তিনি খুব খুশি হতেন যোগাযোগ করলে। ২০১১ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত আমরা বছরে অন্তত একটা ইমেইল যোগাযোগ করেছি। তারই তিনটি ইমেইল আলাপ আমি উদ্ধার করেছি। দুটি ২০১২ সালের এবং একটি ২০১৩ সালের। চূড়ান্তভাবে আমি ২০১৭ সালের ঢাকায় ফিরে আসার পর ফাদার টিমের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে চেষ্টা করি। আমি নটরডেমে যাই। জানতে পারি, ফাদার টিম এবং ফাদার বানাস দুজনই শারীরিকভাবে অসুস্থ। এবং দুজনই চিকিত্সার নিমিত্তে যুক্তরাষ্ট্রে গিয়েছেন। আমি প্রথম সংবাদটি পাওয়ার অল্প কিছুদিনের মধ্যেই ফাদার বানাস পরলোকগমন করেন। কিন্তু জানতে পারি যে ফাদার টিম ক্রমাগত দুর্বল হয়ে পড়লেও হসপিস কেয়ারে আছেন।
২০১২ সালের একটি ইমেইলে তিনি লিখেছিলেন, তিনি বাংলাদেশেই হলিক্রসের ধর্মীয় শপথের ৬০ বছর এবং ৭০ বছর সেলিব্রেট করেছেন। তিনি একটি ছবি শেয়ার করে ২০১২ সালের ২৫ ডিসেম্বর লিখেছেন, ‘মেরি ক্রিসমাসের এবং নতুন বছরের শুভেচ্ছা। তোমাদের অনেকের কাছেই এটা আমার বার্ষিক শুভেচ্ছা বার্তা। আমার নিজের বিশেষ কোনো খবর নেই। এমনিতে আমি ভালোই আছি। মাঝেমধ্যে ঠান্ডা জ্বর ও ডায়রিয়ার সমস্যা দেখা দেয়। অনেকেই চাইছে যে আমি যেন ১০০ বছর বেঁচে থাকি। আগে আমার পিতার সমান বয়স পর্যন্ত তো যাই! আমার পিতা বেঁচে ছিলেন ৯৩ বছর। তার পরও আমি একজন আশাবাদী মানুষ। ঈশ্বরের প্রতিরূপ গ্রহণ করাই একজন মানুষের জন্য সবচেয়ে মর্যাদার বিষয়। মানবাধিকারেরও মূল ভিত্তি সেটাই। ক্রিসমাস শুধু আনন্দের দিন নয়। এটি একই সঙ্গে গভীরভাবে উপলব্ধি করার বিষয় মানুষের পরিণতি নিয়ে। আমি প্রার্থনা করি এবং আশা করি, ঈশ্বর তোমাদের সহায় হোন যার যার ধর্মীয় বিশ্বাস অনুসারে।’
তার শেষ ইমেইল আমি যেটা পেয়েছি, তাতে তার শারীরিক অবস্থার আভাস ছিল। এটি তিনি পাঠিয়েছিলেন ২০১৩ সালের ২৫ ডিসেম্বর :‘এ বছরের শুরু থেকেই আমি জরাগ্রস্ত অনুভব করছি। আমি মেডিক্যাল চেকআপ করতে গিয়ে ধরা পড়ে যে আমার রক্তস্বল্পতা দেখা দিয়েছে। আমি প্রয়োজনীয় ভিটামিন ও ওষুধ গ্রহণ করছি প্রতিদিন। ডাক্তারের কাছ থেকে ক্লিয়ারেন্স পেতে ছয় মাস সময় লেগে যাবে। ঢাকা অর্ধগোলার্ধ দূরে। ইলেকট্রনিক সুবিধা থাকা সত্ত্বেও আমি আমার বন্ধুদের কোনো সংবাদ জানতে পারছি না। আসুন, আমরা ২০১৪ সালে সবাই একে অপরের সঙ্গে যুক্ত থাকি।’
এটিই ছিল তার শেষ চিঠি। তিনি এর সঙ্গে তার ৯০ বছর বয়সের একটি ছবিও যুক্ত করেছিলেন। তিনি তার পিতার চেয়ে বেশি দিন বেঁচেছিলেন। তিনি ৯৭ বছর বয়সে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। শান্তিতে থাকুন প্রিয় ফাদার। আপনার আবাহন যেন আমাদের কাছে প্রেরণা হয়ে থাকে।
লেখক :বাংলাদেশ সরকারের সাবেক রাষ্ট্রদূত
(লেখাটি ইংরেজি থেকে অনূদিত)