শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

ভেজাল নিয়ে বিড়ম্বনার শেষ নেই

আপডেট : ১৯ জুলাই ২০১৯, ২০:৩৭

বিপ্লব বিশ্বাস

 

সম্প্রতি বিভিন্ন কোম্পানি থেকে সরবরাহ করা বাজারের প্যাকেটজাত দুধ নিয়ে শুরু হয়েছে আলোচনা। একাধিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান থেকে বলা হচ্ছে, বাজারের পাস্তুরিত প্যাকেটজাত দুধে ডিটারজেন্ট, সীসা, একাধিক ধরনের অ্যান্টিবায়োটিকসহ অন্যান্য ক্ষতিকর উপাদানের অস্তিত্ব পাওয়া গেছে। প্রশ্ন হলো—দুধে অ্যান্টিবায়োটিক, ডিটারজেন্ট বা সীসা কেমন করে আসে? এর উত্স সম্পর্কে কোনো গবেষণায় পরিষ্কার কোনো ধারণা দেওয়া হয়নি বা এ নিয়ে কোনো অনুসন্ধানও চালানো হয়নি। কাজেই সবার আগে এই প্রশ্নের উত্তর আমাদের খুঁজে বের করতে হবে। আমরা জানি, অ্যান্টিবায়োটিক একটি জীবন রক্ষাকারী ওষুধ হিসেবে চিকিত্সাবিজ্ঞানে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। ১৯৪১ সালে প্রথম মানবদেহে এই ওষুধ প্রয়োগ করা হয়। এখন পর্যন্ত অ্যান্টিবায়োটিক চিকিত্সাক্ষেত্রে একটি অত্যাবশ্যকীয় উপাদান হিসেবেই বিবেচিত। বর্তমানে অ্যান্টিবায়োটিক ছাড়া মানবদেহের বিভিন্ন জটিল ও কঠিন রোগ নিরাময় প্রায় অসম্ভব। একইভাবে গবাদিপশুর বিভিন্ন জটিল ও কঠিন রোগেও বিভিন্ন ধরনের অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার করা হচ্ছে।

বর্তমানে দেশে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে এবং  বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে গবাদিপশু, হাঁস-মুরগি ও মাছ চাষ করা হচ্ছে। এই পশু-পাখির চিকিত্সায় সারা দেশে বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রিপ্রাপ্ত হাজার হাজার চিকিত্সক নিয়োজিত রয়েছেন। তাঁরা বিজ্ঞানসম্মত উপায়েই গবাদিপশু ও হাঁস-মুরগি বা মাছের চিকিত্সা করছেন। এক্ষেত্রেও অ্যান্টিবায়োটিক বা রাসায়নিক ওষুধ ব্যবহার করা ছাড়া কোনো উপায় নেই। কারণ বাণিজ্যিকভিত্তিতে গবাদিপশু পালন করতে হলে অবশ্যই দুধ ও মাংস বৃদ্ধি যেমন প্রয়োজন, তেমনি পশুপাখি সুস্থ ও বাঁচিয়ে রাখাও অপরিহার্য। কাজেই পশুপাখির চিকিত্সায় আধুনিক ও বিজ্ঞানম্মত পদ্ধতি অবলম্বন করতেই হবে। আর শতভাগ বিশুদ্ধ দুধ, মাছ, মাংস বা ডিম পেতে হলে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির পরিবর্তে সেই সনাতন পদ্ধতিতে ফিরে যেতে হবে। যা বর্তমানে একেবারেই অসম্ভব,  অবাস্তব ও অগ্রহণযোগ্য। তাহলে শুধু দেশের ডেইরি বা পোল্ট্রি শিল্পই ধ্বংস হবে না, দেশের মানুষের এক শতাংশ চাহিদাও পূরণ করা সম্ভব হবে না এবং দেশে দুধ, মাছ, মাংস ও ডিমের জন্য হাহাকার পড়বে। মনে রাখতে হবে, বিজ্ঞানের ক্ষতিকর দিকগুলো সহ্য করতে না পারলে এর ভালো দিকগুলো থেকেও আমাদের বঞ্চিত থাকতে হবে। 

অন্যদিকে আমাদের কৃষিব্যবস্থা বর্তমানে সম্পূর্ণভাবে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির ওপর নির্ভরশীল। দেশের কৃষি উত্পাদনে যে বিপ্লব ঘটেছে তার জন্য বিজ্ঞানের অবদানই সবচেয়ে বেশি। এক্ষেত্রেও বিজ্ঞানের ইতিবাচক ও নেতিবাচক প্রভাব রয়েছে। ফসল ও শাকসবজির উত্পাদন বৃদ্ধির জন্য অতিমাত্রায় রাসায়নিক সার ও কীটনাশক ব্যবহার করা হচ্ছে। এর ফলে কৃষির উত্পাদন যেমন বাড়ছে, তেমনি দেশের মাটি ও পানি দূষণের মাত্রা দিন দিন ভয়াবহ আকার ধারণ করছে। এই দূষিত পানি দ্বারা মাটিতে যে শাকসবজি, ফলমূল ও ফসল উত্পাদন করা হচ্ছে সেগুলোতেও মানবদেহের জন্য ক্ষতিকর উপাদানের অস্তিত্ব্ব পাওয়া যাচ্ছে। গবাদিপশুকে যে ঘাস বা খড় খাওয়ানো হয় তার মধ্যেও রাসায়নিক সার ও কীটনাশকের প্রভাব রয়েছে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে খাদ্যে ভেজালের জন্য উত্পাদনকারী, পাইকারি  বা খুচরা বিক্রেতা কেউ সরাসরি দায়ী না হলেও বাজারে ভেজালবিরোধী অভিযান চালিয়ে বিক্রেতাদের কাছ থেকে জরিমানা আদায় করা হচ্ছে অথবা নানাভাবে হয়রানির শিকার হতে হচ্ছে। এভাবে ক্রেতা-বিক্রেতাসহ সাধারণ মানুষের মধ্যেও খাদ্যে ভেজাল নিয়ে এক আতঙ্ক বিরাজ করছে।

সুতরাং খাদ্যে ভেজাল নিয়ে জনমনে আতঙ্ক সৃষ্টি না করে কিভাবে এই সমস্যা সমাধান করে সহনীয় পর্যায়ে রাখা যায় তা নিয়ে গবেষণা চালাতে হবে। প্রায় সতরো কোটি মানুষের ব্যাপক চাহিদার বাজারে শতভাগ বিশুদ্ধ খাদ্য নিশ্চিত করা খুব কঠিন কাজ। বাস্তব অবস্থা বিবেচনা করেই খাদ্যদ্রব্যের বিষয়ে মন্তব্য করতে হবে। সারা বিশ্বেই খাদ্যদ্রব্য সংরক্ষণে মানবদেহের জন্য ক্ষতিকর নয় এমন প্রিজারভেটিভ সহনীয় মাত্রায় ব্যবহার করা হয়ে থাকে। আমাদের দেশে বিভিন্ন খাদ্য উত্পাদন, বাজারজাত ও বিক্রির সঙ্গে যারা জড়িত তাদেরকে বিজ্ঞানসম্মত উপায়ে খাদ্যে প্রিজারভেটিভ প্রয়োগের ব্যাপারে সচেতন করতে হবে। খাদ্যদ্রব্য ক্ষতিকর উপাদানমুক্ত করার প্রক্রিয়া উদ্ভাবন করতে হবে এবং যে কোনো মূল্যে আমাদের কৃষি, ডেইরি ও পোল্ট্রি শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে। খাদ্যে ভেজাল নিয়ে যাতে জনমনে আতঙ্ক বা বিড়ম্বনা সৃষ্টি না হয় সে দিকেও আমাদের খেয়াল রাখা জরুরি।

ফরিদপুরধী