শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

আরো সমৃদ্ধ কাশ্মীর গড়ে তুলছে ভারত

আপডেট : ২১ সেপ্টেম্বর ২০১৯, ০০:৪১

হর্ষ বর্ধন শ্রিংলা

গত কয়েক সপ্তাহ ধরে আমরা দেখছি যে, জম্মু ও কাশ্মীর প্রদেশ নিয়ে ভারতের নতুন উদ্যোগের ব্যাপারে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান এবং তার সরকারের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা এমন অস্বাভাবিক, অশুভ ও ভীতিজনক একটি চিত্র আঁকার চেষ্টা করছেন—যা ভারতের সঙ্গে পাকিস্তানের  বিরোধকে আরো তীব্র করে তুলছে। একইসঙ্গে পারদ চড়িয়ে দিচ্ছে পরমাণু যুদ্ধেরও।

পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের নেতৃত্বে দেশটি অর্থনৈতিক মন্দায় পতিত হয়েছে। পাকিস্তানের মুদ্রাস্ফীতি পাঁচ বছরের মধ্যে এখন সবচাইতে বেশি, জাতীয় ঋণের পরিমাণ ছাড়িয়ে গেছে অভ্যন্তরীণ উত্পাদনকে এবং আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলকে এবার নিয়ে ২২ বার বেলআউট করতে হয়েছে। পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ইমরান খানের অবশ্যই সম্পূর্ণ অধিকার রয়েছে দেশটির অর্থনীতিকে তলানিতে নিয়ে যেতে। কিন্তু তিনি যদি দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হন যে, পাকিস্তানের মতো তার প্রতিবেশী দেশের নিকটবর্তী রাজ্যটিকেও অর্থনৈতিকভাবে ধ্বংসের দিকে নিয়ে যাবেন, তাহলে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় নিশ্চয়ই চুপ করে বসে থাকবে না। নিশ্চয়ই এমন দুষ্কর্মকে চ্যালেঞ্জ জানাবে।

প্রধানমন্ত্রী জনাব খান যা মেনে নিতে অসুবিধা বোধ করছেন তা হলো—কাশ্মীর অঞ্চলটি এখন উন্নতি ও সমৃদ্ধির পথে ফিরে গেছে, কারণ ভারত সরকার সেখানকার একটি অ্যানক্রোনিস্টিক তথা কালাতিক্রমণ দোষযুক্ত এবং অস্থায়ী আইনের বিধানটি বাতিল করেছে, যা এতদিন ধরে সেখানে উন্নয়নের পথে বাধা সৃষ্টি করে রেখেছিল।   

ভারতের সংবিধানের ৩৭০ অনুচ্ছেদের বিধানটি ভারত সরকারকে জম্মু ও কাশ্মীরের বিষয়ে প্রতিরক্ষা, অর্থ, বিদেশনীতি এবং যোগাযোগের বিষয়গুলো বাদে বাকি সব ক্ষেত্রে কিছু বলার অধিকার রহিত করেছিল। এর ফল জম্মু ও কাশ্মীরের জন্য ভালো হয়নি। কারণ, জম্মু ও কাশ্মীর ব্যতীত বাকি ভারত যখন শক্তিশালী সামাজিক ও অর্থনৈতিক বিকাশের মধ্য দিয়ে এগিয়ে চলেছে, তখন জম্মু ও কাশ্মীর অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, কর্মসংস্থান, দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াই, লিঙ্গসমতা, সাক্ষরতা এবং অন্যান্য অনেক সূচকের ক্ষেত্রে ক্রমাগত পিছিয়েই পড়েছে।

জম্মু ও কাশ্মীর এবং লাদাখ অঞ্চলে সমৃদ্ধি রোধে পাকিস্তানের কায়েমি স্বার্থ রয়েছে। কারণ, একটি অঞ্চলকে যদি অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল করে রাখা যায়, তাহলে কিছু মহল বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সহজে উসকাতে পারবে। সন্ত্রাসবাদকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহারের ক্ষেত্রে পাকিস্তানের যে বৃহত্তর কৌশল রয়েছে, তার সঙ্গে এটি খাপ খায়। পাকিস্তান এমন একটি দেশ, যার নিজস্ব ছাপ রয়েছে বিশ্ব জুড়ে সন্ত্রাসবাদী হামলায় এবং ওসামা বিন লাদেন তার জীবনের শেষ দিনগুলোতে আশ্রয় পেয়েছিলেন এই দেশটির ভেতরেই। সুতরাং ভারতের সংবিধানের যেই ৩৭০ ধারাটি জম্মু ও কাশ্মীরের বৈষম্যকে বৈধতা দেয় এবং অর্থনৈতিক অগ্রগতিতে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে, সেই ধারাটি বাতিল করার বিরোধিতা পাকিস্তান তো করবেই।

তথাপি ভারতীয় সংসদ এই প্রদেশটিকে পুনর্বিন্যাস করার এবং এই সাংবিধানিক ধারাটি বিলোপের মাধ্যমে একটি ঐতিহাসিক ভুলকে সংশোধন করেছে। এই সিদ্ধান্তের ফলে ঐ অঞ্চলের মৃতপ্রায় অর্থনীতি চাঙ্গা হওয়ার ক্ষেত্রে প্রদেশটির হর্টিকালচার, পর্যটন এবং হস্তশিল্পকে উন্নতির বৃহত্তর সোপানে উন্নীত করার দ্বার উন্মোচিত করেছে—যাকে বলা যায় ঐ অঞ্চলটির সংস্কৃতির এক অতুল্য শক্তি।

এটাও সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ যে, এই পরিবর্তনটি এমন একটি অঞ্চলে সামাজিক ও অর্থনৈতিক ন্যায়বিচার পৌঁছে দেবে—যা ভারতের বাকি অংশের পদাঙ্কের বাইরে ছিল। যেসব কাশ্মীরি নারী অ-কাশ্মীরিদের বিয়ে করেছিলেন, সেসব নারীর সন্তানদের উত্তরাধিকার বা সম্পত্তির অধিকার অর্জনের পথে শক্ত প্রাচীর হয়ে দাঁড়িয়েছিল এই সাংবিধানিক ধারা। এটি একটি কায়েমি স্বার্থের পরিবেশ তৈরি করেছিল, যার ফলে অত্যন্ত কঠিন হয়ে পড়েছিল বিবিধ অনিয়ম প্রতিহত করা।

এবং যেটা সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ, তা হলো—ঐ ধারাটি ছিল ভারতের বাকি অঞ্চলে প্রচলিত প্রগতিশীল আইনগুলোর বিপরীতে কাঁটার মতো। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, ইতিবাচক পদক্ষেপ (affirmative action), নারীদের সমান অধিকার, অল্পবয়সিদের সুরক্ষা এবং পারিবারিক সহিংসতার বিরুদ্ধে সুরক্ষা জম্মু ও কাশ্মীরে প্রযোজ্য ছিল না। ভারতীয় সংবিধানের আওতায় যে শিক্ষার অধিকার এবং তথ্যের অধিকার সুরক্ষিত করা হয়েছে—সেগুলোও প্রযোজ্য ছিল না ঐ প্রদেশটিতে।

স্পষ্টতই, এই ধারাটি বাতিলের ফলে জম্মু ও কাশ্মীর এবং লাদাখে যুগপত্ যেই অমিয় সম্ভাবনার দ্বার খুলে গেছে, সেটিই সরিয়ে দিয়েছে পাকিস্তানের পায়ের তলার মাটি। পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী দাবি করেছেন যে, তিনি ভারতের সঙ্গে শান্তি, অগ্রগতি ও সমৃদ্ধির জন্য কাজ করার প্রস্তাব দিয়েছিলেন। তিনি যা বলছেন না—তা হলো—সন্ত্রাসের আঁতুড়ঘর হিসাবে যেই বৃহত্ কারখানা তার দেশে গড়ে উঠেছে, সেখানে সন্ত্রাসী উত্পাদন অব্যাহত রয়েছে বিরতিহীনভাবে।

পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ধারণা দিয়েছেন যে, সন্ত্রাসী অর্থায়নের তদন্তকারী আন্তর্জাতিক সংস্থা ফিনান্সিয়াল অ্যাকশন টাস্কফোর্সের মতো প্রতিষ্ঠানগুলো পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছে। কিন্তু তিনি বিষয়টি আড়াল করেছেন যে, ২০০৮ সালের মুম্বাই সন্ত্রাসবাদী হামলার মূল পরিকল্পনাকারীকে পাকিস্তান আগলে রেখেছে। এবং এই যে পুলওয়ামার আত্মঘাতী বোমা হামলা চালানো হয়েছিল জাতিসংঘের নিষিদ্ধ-ঘোষিত সন্ত্রাসবাদী সংগঠন জইশ-ই-মুহাম্মদ দ্বারা—এই সংগঠনটিও পাকিস্তানের বড়ো শহরগুলোতে কাজ করছে প্রকাশ্যে।

মুসলমান এবং অন্যান্য অ-হিন্দু সংখ্যালঘুদের প্রতি ভারতবর্ষের আচরণের জন্য সমালোচনা করেছেন জনাব ইমরান খান। বাস্তবতার বিপরীতে এই সমালোচনা নিপাট হাসির খোরাক জোগায়। পাকিস্তান যখন তৈরি হয়েছিল, তখন দেশটির জনসংখ্যার ২৩ শতাংশ ছিল সংখ্যালঘু। কী করুণ বাস্তবতা—এটি এখন ৩ শতাংশে নেমে এসেছে! পাকিস্তানের শিয়া, আহমাদিয়া, খ্রিষ্টান, হিন্দু ও শিখ—এদের মধ্যে অগণিত মুখ রয়েছে যারা এই করুণ বাস্তবতার সাক্ষ্য দিতে পারে। এমনকি ভিন্নধারার মুসলমানদেরও রেহাই দেওয়া হয় না—দেশটির শিয়া, পশতুন, সিন্ধি বা বালুচদের জিজ্ঞাসা করে দেখুন।

এবং পরিহাসের বিষয় হলো, ইসলামাবাদ ইসরায়েলের বৈধতা স্বীকৃতি দিতে অস্বীকার করে এবং অ্যান্টি-সেমেটিক মনোভাবে আপত্তি করে না। অথচ এখন তারা ইউরোপীয় ফ্যাসিবাদের চিত্রকে আবাহন করে, যা সম্পূর্ণভাবে স্তম্ভিত করে দেয়।

জম্মু ও কাশ্মীর এবং লাদাখ এখন পরিবর্তনের পথে। যারা পুরোনো ব্যবস্থা থেকে নিজেদের স্বার্থ হাসিল করতে পারছিল তারাই এখন ভারতের এই পরিবর্তনকে চ্যালেঞ্জ করছে। সুতরাং তাদের মাধ্যমে সীমান্ত পেরিয়ে সহিংসতা ও সন্ত্রাসবাদের উসকানি আসাটাই স্বাভাবিক। জনসাধারণের শৃঙ্খলা ও সুরক্ষা নিশ্চিতকরণে ভ্রমণ এবং যোগাযোগের ওপর অনেকগুলো বিধিনিষেধ এখন শিথিল করা হয়েছে। এক্ষেত্রে সহিংসতা থেকে প্রত্যেকের জীবন রক্ষা করাটাই ছিল সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার।

৩৭০ অনুচ্ছেদের বিধানটি বাতিলের পরিপ্রেক্ষিতে এর কোনো প্রভাব ভারতের বাইরে নেই। ভারতের বাহ্যিক সীমানার কোনো পরিবর্তন সাধিত হয়নি। কিংবা পাকিস্তানের সঙ্গে নিয়ন্ত্রণ রেখাও প্রভাবিত হয়নি। যা পরিবর্তিত হয়েছে তা হলো—এই অঞ্চলের উন্নয়নের প্রত্যাশা। আর এই উন্নয়নের সুফল পাবেন এখানকার বাসিন্দারাই। অন্যদিকে এই পরিবর্তন পাকিস্তানের সীমান্ত-সন্ত্রাসবাদের দীর্ঘকালীন সমর্থনকেও বাধা প্রদান করবে। এই কারণেই পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী মিথ্যা-মিশিয়ে একটি উদ্বেগজনক চিত্রনাট্য তৈরি করেছেন, যাতে তিনি এই অঞ্চলে এখন নতুন করে তৈরি হওয়া উন্নতির বিপুল সম্ভাবনার দ্বার রুদ্ধ করতে পারেন।

তবে প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের ঘুম ভাঙা প্রয়োজন। প্রয়োজন চায়ের কাপে ঘ্রাণ নেওয়া। এই অঞ্চলে উন্নয়ন হবে, অগ্রগতি দৃশ্যমান হবে, সমৃদ্ধির শিকড় ছড়িয়ে পড়বে এবং নির্মূল হবে সন্ত্রাসবাদ। এর সঙ্গে ভারত আশা করে যে—শত্রুতা, সহিংসতা ও সন্ত্রাসবাদ ত্যাগ করে পাকিস্তান স্বাভাবিক প্রতিবেশী হয়ে উঠবে—যা দক্ষিণ এশিয়ার সমস্ত দেশ চায়।

(দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস থেকে অনূদিত)

অনুবাদ : তাপস কুমার দত্ত

লেখক : যুক্তরাষ্ট্রে নিযুক্ত ভারতীয় রাষ্ট্রদূত