শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

অণুগল্প

চার টাকা

আপডেট : ০৩ ডিসেম্বর ২০১৯, ১৯:৩২

 

জানালার শার্সিতে চোখ এঁটে বসে আছি। দৃষ্টিজুড়ে অসংখ্য গাড়ির চিত্র। বড়ো গাড়ি, মেজো গাড়ি, ছোটো গাড়ি, লম্বা গাড়ি, বেঁটে গাড়ি, মোটা গাড়ি, চিকন গাড়ি, মানুষ গাড়ি; মোদ্দা কথা গাড়ির জট সারা পথজুড়ে ।

দৃষ্টিজোড়া একটু ওপরের দিকে তুলতেই রং-বেরঙের বহু ঢঙের বিলবোর্ড ভূমিছাড়া-আকাশছোঁয়া বায়না ধরে বিভিন্ন পণ্যের যে গুণকীর্তন করছে তা চোখে পড়ল। বাড়ি-গাড়ি, শাড়ি-চুড়ি, বাবার পাঞ্জাবি, মায়ের শাল, বাবুর জামা, ভাইয়ের জিন্স, বোনের টপস, বৌয়ের ডায়মন্ড সেট, সংসারের টিভি-ফ্রিজ-এয়ারকন্ডিশান, ক্যারিয়ারের সাফল্য অর্জনের পথ, দাঁতের চিকিত্সাখানা, চুলের যত্নে তেল-শ্যাম্পু, সস-মসলা ও বিলেত যাওয়ার এয়ারপ্লেনসহ আরো কত্তো কিছুর বিজ্ঞাপনের বিলবোর্ড যে রয়েছে তার ইয়ত্তা নেই।

দৃষ্টি ঘুরিয়ে এপাশ-ওপাশ করে বাসের ভেতর তাকালাম, কিছু যাত্রীর চান্দি গরম আর বেশিরভাগের নির্লিপ্ত দৃষ্টি। আর এই হলো আসাদগেট মোড়ে আমার যাত্রাপথে প্রতিদিন সকালবেলার হালচিত্র। যান্ত্রিক সভ্যতার আশীর্বাদ, চলতি পথের ওপর বাসের ভেতর বেশ কিছুটা সময় বিনা কারণে বসে থাকা। হঠাত্ করেই দৃষ্টিপথ পরিবর্তিত হলো জ্যামের জেলিতে ভরপুর পথের দিকে। পাঁচ-ছয় বছরের একটি শিশু তিন-চার বছরের আর একটা শিশুকে কোলে নিয়ে অর্থ সাহায্য চাইছে। বড়ো শিশুটার চাওয়ার ভঙ্গি দেখে বোঝাই যাচ্ছে সে এই পেশায় নবীন। দুর্বল, ক্ষীণকণ্ঠে ছোট্ট শিশুটার খাবারের জন্য অর্থ চাইছে আর ভীত-সন্ত্রস্ত চোখ মেলে ছোট্ট ভাই তাকিয়ে আছে বড়ো ভাইয়ের বাড়িয়ে দেওয়া হাতের তালুর দিকে। রাস্তার ওপর জমে থাকা একটা গাড়ির ভেতর থেকে আহ্বান এলো বড়ো শিশুটির জন্য। ছোট্ট শিশুটাকে পথের ওপর বসিয়ে রেখে বড়োটি ছুটল সেদিকে। চোখভর্তি ভয় আর মুখভর্তি কান্না নিয়ে ছোট্টটি তাকিয়ে রইল সেদিকে। ব্যাগে হাত দিতে দু’টাকার দুটি নোট ঠেকল হাতের তালুতে আমার। মুঠোতে পুরে জানালার বাইরে বের করলাম। কিন্তু বড়ো শিশুটিকে দেখতে পেলাম না। ছোট্ট শিশুটি ফুটপাতে বসে আছে। রাস্তাভর্তি গাড়ির ভেতর ওকে ডাকা ঠিক নয় ভেবে জানালা দিয়ে মাথা বের করে খুঁজলাম বড়ো শিশুটিকে। সিগন্যালটা ছেড়ে দিল এইসময়, আর ছেড়ে দিচ্ছে আমার বাসটিও, মুঠো ধরা হাতটা বাড়ানোই রইল। ফুলস্পিডে বাস ছেড়ে গেল আসাদগেটের মোড়। চোখে আটকে রইল ভীত-সন্ত্রস্ত এক শিশুর চাহনি। আর হাতের মুঠোতে ধরা থাকল চারটা টাকা। দুই টাকার দুটি নোট, জাতীয় পাখি দোয়েলের ছবি সম্বলিত, বিশ্বের সবচেয়ে আর্কষণীয় টাকা।