অণুগল্প
মুক্তির ডাক
আতা সরকার
সিলিংয়ের রিংয়ে পা দুটি বেঁধে তাঁকে ঝোলানো হয়েছে। নিচের দিকে মাথা। রক্তাক্ত উদোম দেহ। শুধু একটা আন্ডারওয়্যার পরনে। ক্ষতবিক্ষত শরীর থেকে ঝরঝর রক্ত ঝরছে। মেঝেতে জমাট রক্ত। তবু থামছে না জল্লাদের বেত। বাইরে বিদ্যুতের চমক। ঝড়-বাদলার গর্জন। সব ছাড়িয়ে পরিবেশ ভারী করে তুলছে তাঁর আর্তনাদ। এতেই যেন জল্লাদের সুখ। ফেটে পড়ছে হায়েনার হাসিতে। বেতের একেকটি ঘায়ের সাথে অকথ্য গালিগালাজ। আর প্রশ্নের পর প্রশ্ন।
: শালা, তোর বাড়িতে মুক্তিদের ক্যাম্প বানিয়েছিস কেন?
: বল হারামজাদা, মুক্তিদের জায়গা দিয়েছিস কেন?
: ওদেরকে খাবার দিয়েছিস কেন, শূয়ার কা বাচ্চা?
সব প্রশ্নের একটাই জবাব, না। সাথে সাথে বেতের আঘাতও তাঁর গায়ে দাগ কেটে দিচ্ছে। তাঁর মুখ থেকে বেরিয়ে আসছে আর্তরব।
একসময় আর্তনাদ থেমে গেল। বেতের আঘাতেরও কোনো প্রতিক্রিয়া নেই। ঝুলন্ত লোকটাকে নামিয়ে গড়িয়ে দেয়া হলো মেঝেতে।
উপুড় হয়ে জবুথবু পড়ে রইলেন তিনি। চেনা যায় না তাঁকে। ভাবা যায় না, তিনি নেত্রকোণা কলেজের দর্শনের অধ্যাপক। ক্ষতবিক্ষত সারা শরীর। সাদাসিধে আত্মভোলা লোকটি নিজের খেয়ালে থাকলেও ছিলেন প্রাণবন্ত। একা বিড়বিড় করে আপন মনে কথা বলতেন। আবার গুনগুন গানও গাইতেন। দেশাত্মবোধক গানেই ঝোঁক বেশি, বিশেষ করে সাম্প্রতিক সময়ের উন্মাতাল গান।
আরজ আলীকে নেড়েচেড়ে কোনো সাড়া না পেয়ে তাঁর চোখেমুখেগায়ে গরম পানি ছিটিয়ে দেয়া হলো। সাড় পাওয়া দেহ। তাঁর চোখ মিটমিট করে উঠল। সাথে সাথে সর্বাঙ্গের ব্যথাও জেগে উঠল। কঁকিয়ে উঠলেন তিনি। সেন্ট্রি এসে তাঁকে মেঝের উপর বসিয়ে দিল।
বেত নাচাতে নাচাতে রুমে ঢুকল কর্নেল। চোখেমুখে তার জিঘাংসা। আরজ আলীর সামনে দুই পা ফাঁক করে দাঁড়াল। জিজ্ঞেস করল: তারপর কী খবর আরজ আলী সাহাব?
একই ধারার প্রশ্ন। ক্ষীপ্ত আরজ আলী চিত্কার করে উঠলেন: কিছুই জানি না আমি।
কর্নেলের চোয়াল শক্ত হয়ে উঠল। বেরিয়ে গেল হনহন করে। নরপিশাচ জল্লাদরা সম্মিলিতভাবে ঝাঁপিয়ে পড়ল আরজ আলীর উপর। জল্লাদের কসাইখানা আর্তনাদে ভরে উঠল।
ক্লান্ত হয়ে ক্ষান্ত দিল তারা। রুম থেকে বেরিয়ে যাওয়ার আগে তারা তাঁর হাত-পা-চোখ কাপড় দিয়ে বেঁধে দিল। নির্যাতিত হতমান মর্মাহত শিক্ষক মাথা নত করে বসে রইলেন। মনের ভেতর তিনি শক্তি সঞ্চার করতে লাগলেন। বাংলার দর্শন সংস্কৃতি সভ্যতা থেকে, মুক্তিযুদ্ধের বৈপ্লবিক চৈতন্য থেকে, শিক্ষক জি সি দেবের শিক্ষা থেকে। এ সময় এক কিশোরীর মুখও তাঁর মানসে ভেসে আসছে। ফরিদার নিষ্পাপ পবিত্র মুখ। আর ভেতরে পুঞ্জীভূত হচ্ছে প্রবল ঘৃণা। বর্বর পাকিস্তানি শাসক ও বাহিনীর প্রতি। তাদের দোসরদের প্রতি। দুর্গাপুরের শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান তালুকদার আর কুকর্মের সঙ্গী হামিদ মেম্বারের প্রতি। তালুকদার একটা কলেজ প্রতিষ্ঠা করেছিল। সে কলেজের প্রিন্সিপ্যালের দায়িত্ব নেয়ার জন্য প্রস্তাব দিয়েছিল আরজ আলীকে। বিনিময়ে বিয়ে করতে হতো তালুকদারের মেয়েকে। সম্মত না হওয়ায় আরজ আলীকে তার মূল্য চুকাতে হচ্ছে এখন।
আরজ আলীকে নেত্রকোণা থেকে প্রথমে ট্রেনে, বাকি পথ মিলিটারি লরিতে দুর্গাপুর আর্মি ক্যাম্পে নিয়ে আসা হয়। সেদিনই পুরো দুর্গাপুরে খবর ছড়িয়ে পড়ে, আরজ আলীকে মেরে ফেলা হবে। সে রাতেই তালুকদার হামিদ মেম্বার গং আর্মিদের নিয়ে তাঁদের বাড়ির প্রতিটি ঘরে আগুন জ্বালিয়ে দেয়।
পাকিস্তানি কর্নেল দুর্গাপুর এসেছিল। পরের দিন সকালে আরজ আলীকে ক্যাম্পের কাছেই সোমেশ্বরী নদীর পাড়ে নিয়ে আসা হলো হাত-পা-চোখ বাঁধা অবস্থায়।
কর্নেলের হাতে বেত শূন্যে হাওয়ায় সপাং সপাং আওয়াজ তুলছে। কর্নেল বলল: এখনো বলুন, মুক্তিরা আপনাদের বাড়িতে ছিল কি না।
আরজ আলী অকম্পিত গলায় দৃঢ় কণ্ঠে বললেন: জানি না। আমি দার্শনিক জি সি দেবের ছাত্র। মিথ্যা বলতে শিখিনি।
জি সি দেবের নাম শুনেই কি না কে জানে কর্নেল ক্ষীপ্ত হয়ে উঠল। গর্জে উঠল মেশিনগান। ঢলে পড়লেন আরজ আলী। দুজন আর্মি তাঁকে তুলে ধরে ছুড়ে দিল নদীতে।
সোমেশ্বরীর জল পরম মমতায় তাঁকে টেনে নিল। উত্তাল জলতরঙ্গে সোমেশ্বরীর অতলে জমে উঠছে নবতরঙ্গ। রক্ত উচ্ছল মুক্তির আহ্বান।