শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

অণুগল্প

নিঃসঙ্গ বৃক্ষ

আপডেট : ০২ জুন ২০২০, ২১:৩৪

ছবিটি প্রিন্ট করার পরেই রাজিবের মন খারাপ হয়ে যায়। কোনো না কোনো সমস্যা তো ছিলই, না-হয় ছবিটি এত ডার্ক হওয়ার কথা নয়। কী সমস্যা ছিল? সারা রাত ভাবল কিন্তু কোনো সুরাহা করতে পারেনি। কয়েকবার ক্যামেরা নিয়ে নাড়াচাড়া করেছে এবং শেষ পর্যন্ত অনুমান করল (যা সঠিক নাও হতে পারে) যে লাইটের যে ইনডিকেটর ফোকাস বিন্দুতে থাকে সেটিই নষ্ট। ছবিটির জন্য ওর বুক জুড়ে হাহাকার। হবে না কেন? এত কষ্ট আর এমন সুন্দর সাবজেক্ট, কম্পোজিশন, দৃশ্য, সূর্যাস্তের বিরল সময়ের ছবি জীবনে একটিই তুলেছিল। সেটিই নষ্ট।  

বৃক্ষটি ছিল সমুদ্রের কিনারে। চারপাশ উন্মুক্ত। দিগন্তে সমুদ্রের জলরাশি ছুঁয়ে আছে নীল আকাশ। এটি মূল সমুদ্রসৈকত থেকে অনেকটা দূরে বলে কোনো মানুষ এদিকে আসে না। পেছনে নির্জন স্তব্ধ পাহাড়। পাহাড়ের তলদেশে একটি বহতা খাঁড়ি। গোধূলির আবছা আঁধার যখন নেমে এসেছিল ঠিক তখনই নিঃসঙ্গ বৃক্ষটিকে ফ্রেমবন্দি করে সে ভেবেছিল হয়তো এই ছবিটি তার অ্যামেচার ফটোগ্রাফারের জীবনের টার্নিং পয়েন্ট হতে পারে। হয়নি।

হ্যাঁ। সে আবার সেই সাগরপাড়ে সেই ছবিটি তুলতে যায় এক মিঠেল রোদের নরম বিকেলে। এত দূর থেকে যাওয়া, এত টাকা খরচ আর এত কষ্ট...। কিন্তু গাছটি নেই। গাছের গোড়াটিও শুকিয়ে গেছে। কয়েকটি মরা ডালপালা, শুকনো পাতা নিউর্বর চরে ওড়াউড়ি করছে। বিষাদপূর্ণ জমাট নৈঃশব্দ্য। সন্ধ্যার আবছা অন্ধকার ক্রমে দিগন্ত থেকে নেমে আসছে।

বুকের ভেতরে হাহাকার করে রাজিবের। দু’হাঁটুর উপর মাথা গুঁজে বসে থাকে। শুকনো পাতার মর্মর শব্দে পেছন ফিরে তাকায়। এক অপূর্ব সুন্দরী তরুণী পাহাড় থেকে নেমে এসেছে। রাজিব উঠে দাঁড়ায়। তরুণীর ঠোঁটে শেষ বিকেলের মিঠেল রোদের মতো মিষ্টি হাসি। পাগলা বাতাসে চুলগুলো এলোমেলো উড়ছে। সে বলল, বৃক্ষটি নেই বলে কি মন খারাপ?

হ্যাঁ। আপনি কীভাবে জানলেন?

হুম। সেদিন আপনাকে ছবি তুলতে দেখেছিলাম। আসলে জানেন, মানুষের ধর্মই হলো ধ্বংস করা। ধ্বংসেই মানুষের আনন্দ! মেয়েটি হি হি হি করে হাসে।

বিমূঢ় রাজিব অন্তহীন আকাশে চেয়ে থাকে। কী বলল মেয়েটি?

হুম। ঠিকই বলেছি। এই যে আপনার ছবিটি যদি পারফেক্ট হতো তাহলে এখানে আসতেন না। তার মানে এই এক ভয়াল নির্জনতায় নিঃসঙ্গ বৃক্ষটির সৌন্দর্য হরণ করে আপনি শুধু ছবিটি নিয়েই থাকতেন। ভালোবাসতেন ছবিটি। তারপর যদি অন্য কোনো অধিকতর ভালো ছবি পেতেন তাহলে এটিকে ভুলে গিয়ে মানে, মানে ভুলে যাওয়া মনের কোণে এক প্রকার ধ্বংস করা...বুঝলেন...সেই ভালো ছবিটি নিয়ে থাকতেন। 

মেয়েটির কথায় স্তব্ধ হয়ে যায় রাজিব।

দু’জনের মধ্যে কথা হয়। ভাব বিনিময় হলে রাজিব বলল, আপনি বুঝি প্রায়ই এখানে আসেন?

হ্যাঁ। আমিও বৃক্ষটির মতো নিঃসঙ্গ। বৃক্ষটিই ছিল আমার নির্জনতার, একাকিত্বেও ভাব বিনিময়ের একমাত্র সঙ্গী। এখন এই নির্জনতায় আমি একা, মাঝে মাঝে আসি এই চরে এবং অনুভব করি ভয়াল একাকিত্ব। মানুষ প্রকৃতই একা, তাই না? এখানে বেশ ভালো লাগে।

আপনার একটি ছবি তুলতে চাই।

অবশ্যই। নিঃসঙ্গ বৃক্ষের ছবি নেই তাতে কী? নিঃসঙ্গ নারীর ছবি তো পাবেন। নারী আর বৃক্ষ...হি হি হি... আসলেই প্রকৃতির কাছে একই জিনিস। 

সন্ধ্যার অন্ধকার ধাবমান। দুজন ফেরে নিজ নিজ রাত্রি যাপনের আস্তানায়।

ছবিটি মন কেড়েছে রাজিবের। গোধূলির আবিরমাখা সুদূর বিস্তৃত প্রাঙ্গণ, প্রেক্ষাপটে সাগরের প্রমত্ত ঢেউয়ের ঠোঁটে ফসফরাসের শুভ্র আচ্ছাদন আর মধ্যে গৌর বর্ণের এক অপূর্ব সুন্দরী তরুণীর উজ্জ্বল মুখটি যেন ঘোর অন্ধকারে ঝুলন্ত চাঁদ।

পরদিন বিকেলে সেই তরুণীর সঙ্গে দেখা হবে এই প্রত্যাশায় রাজিব সেই শূন্য চরাচরে গিয়ে হাজির হয়। মুহূতেই চোখজোড়া নিশ্চল হয়ে পড়ে। বিক্ষিপ্ত অবস্থায় তরুণীর আকাশি রঙের শাড়ি, হলুদাভ পেটিকোট, কালো অন্তর্বাস আর লালচে রঙের ব্লাউজ জলবালিকাদার চরে পড়ে আছে।