তিনি কয়েকদিন আগে উপন্যাসটি পড়তে শুরু করেন। এক জরুরি ব্যবসায়িক আলোচনায় অংশগ্রহণের জন্য বইটি পড়া থামিয়ে রাখতে হয়েছিল। ট্রেনে ফেরার পথে আবার খুললেন। ক্রমেই উপন্যাসের কাহিনি ও চরিত্র-চিত্রণের ভেতর নিজেকে নিমগ্ন করলেন। ঐদিন বিকেলে তাঁর এস্টেটের ব্যবস্থাপক বরাবর একটা পত্র লিখে এবং জরুরি আলোচনা সেরে বইটি নিয়ে পড়ার ঘরের মনোরম পরিবেশে বসলেন। এখান থেকে উদ্যানের ওক গাছগুলো দেখা যায়। আরাম-চেয়ারে হাত-পা ছড়িয়ে ঘরের দরজার দিকে পিঠ দিয়ে বেশ আয়েশ করে পড়া শুরু করলেন—কোনোরকম বাধা যেন না আসে পড়াতে। তিনি শেষ অধ্যায়টি পড়া শুরু করলেন। অনায়াসে উপন্যাসের চরিত্রগুলোর নাম ও তাদের অবয়ব তাঁর মনের পর্দায় ভেসে উঠল। উপন্যাসটি তত্ক্ষণাত্ তাঁর ওপর নিয়ন্ত্রণ নিয়ে ফেলল যেন।
শব্দে শব্দে উপন্যাসের নায়ক-নায়িকার দোদুল্যমান গুপ্তচিন্তার ভেতর নিজেকে গেঁথে দিয়ে অপেক্ষা করতে থাকলেন পরিণতির। পাহাড়ের কেবিনে তিনি শেষ দৃশ্যের মুখোমুখি।
প্রথমে নারী চরিত্রটি পৌঁছাল, চেহারায় তার স্পষ্ট উদ্বেগের ছাপ। এরপর তার প্রেমিকের প্রবেশ, গাছের ডালে আঁচড়ে গেছে তার গাল। সোহাগভরা চুমু দিয়ে রক্তপড়া বন্ধ করতে গেল মেয়েটি কিন্তু ছেলেটি সরিয়ে নিল নিজেকে। বুকে রাখা চাকুটি উষ্ণ হয়ে উঠছে। তার নিচেই অপেক্ষমাণ তাদের প্রেমের কাঙ্ক্ষিত স্বাধীনতা লাফ দিয়ে বেরিয়ে আসার জন্য প্রস্তুত। তাদের কামোদ্দীপক আলাপ পৃষ্ঠার ভেতর থেকে সাপের মতো হিসহিস করে উঠে আসছিল।
পরিকল্পনা ছিল যথার্থ। সেই সময়ের প্রতিটি মুহূর্ত হয়ে উঠেছিল গুরুত্বপূর্ণ, ঠিক ঠিক কাজে লাগাতে হবে তা। ফের খতিয়ে দেখা হয়েছিল খুঁটিনাটি সব সম্ভাবনা ও শঙ্কা, একটি হাত শুধু একটি গাল ছুঁয়ে আদর করতে পারবে নিশ্চিন্তে, এই আশায়। তখন সন্ধ্যা নামতে শুরু করেছে। কেউ কারো দিকে আর না তাকিয়ে তারা তাদের নির্ধারিত কাজের দিকে মন দেয়। কেবিনের দরজার কাছে এসে আলাদা হয় দুজন দুদিকে। নারী চরিত্রটি গেল উত্তরদিকে। প্রেমিক ঘুরে দাঁড়িয়ে তার সাবধানে দ্রুত সরে পড়ার দৃশ্যটি দেখে নিয়ে সেও পালটা দৌড় দিল অন্যপাশে। ঝোপের ভেতর দিয়ে হামা দিয়ে বাড়ির দরজার কাছে পৌঁছাল। কুকুরগুলোর ঘেউ ঘেউ করার কথা নয়, তা তারা করেওনি। এস্টেট ম্যানেজারের এই মুহূর্তে এখানে থাকার কথা না। তিনি ছিলেনও না। সে কয়েক পা এগিয়ে ভেতরে প্রবেশ করে। কানের কাছে ধপধপ শব্দ ছাপিয়ে প্রেমিকার চাপা কণ্ঠ শোনা যায়—প্রথমে নীলরঙা চেম্বার, এরপর হলরুম, এরপর কার্পেট মোড়ানো সিঁড়ি; উঠেই দুটি দরজা। প্রথম ঘরে কেউ নেই, দ্বিতীয় ঘরে কেউ নেই। তারপর বসার ঘরের দরজা, আর তারপর—হাতে উঠে এল চাকু, বড় খোলা জানালাটি দিয়ে আসছে আলো, আরাম-চেয়ারের উঁচু প্রান্ত আর উপন্যাসের শেষ দৃশ্যে মগ্ন হয়ে বসে থাকা সেই লোকটির মাথা।
[লেখক সম্পর্কে: মার্কেস, ফুয়েন্তেস ও য়োসার মতো কোর্তাসার ছিলেন ল্যাটিন আমেরিকার বুমসাহিত্যের অন্যতম পুরোধা। বাস্তবতা-অধিবাস্তবতা—সবকিছুই তাঁর গল্পে এমনভাবে মিশে থাকে যে আলাদা করা যায় না। কোর্তাসারের জন্ম ১৯১৪ সালের ২৬ আগস্টে। তখন তাঁর বাবা-মা বেলজিয়ামে থাকতেন। জার্মান বাহিনী বেলজিয়াম দখল করে নেওয়ায় তাঁরা চলে যান সুইজারল্যান্ডে, এরপর স্পেন হয়ে আর্জেন্টিনায় এসে থিতু হন। গল্প, উপন্যাস, নাটক, কবিতাসহ প্রায় সব ক্ষেত্রেই কোর্তাসারের অবদান রয়েছে। ১৯৮৪ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি দুরারোগ্য লিউকোমিয়ায় আক্রান্ত হয়ে প্যারিসে মারা যান কোর্তাসার।]