বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

গল্প

তুমি এবং আমার একটি গল্প

আপডেট : ৩১ মে ২০১৯, ২৩:৫৪

তোমার সঙ্গে আমার দেখা হয়েছিল আমারই একটি গল্পপাঠের আসরে। আমি একজন তরুণ গল্পকার। বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ চুকিয়ে মাত্র একটি মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে চাকরিতে ঢুকেছি। দেখতে আমি তেমন একটা কিছু নই। তবে চাকরির কারণে পোশাক-পরিচ্ছদে যথেষ্ট পরিমাণ স্মার্ট হয়ে চলতে হয় বলে আমাকে লোকজনের বেশ চোখে পড়ে।

গল্পকার হিসেবেও বেশকিছু পাঠক, সমালোচক এবং প্রকাশকের চোখে পড়েছি বলে মনে হয়। কারণ, পত্রিকায় ছাপানো গল্পের পরিমাণ খুব বেশি নয় এবং বইয়ের সংখ্যাও মাত্র দুটি, এতদসত্ত্বেও লোকজন যখন বলাবলি করে তখন বলতেই পারি যে আমি বেশ পরিচিত ও সেইসঙ্গে জনপ্রিয়ও হয়ে উঠেছি।

এই জন্য ‘প্রতিভা’ নামের সাহিত্য সংগঠনটি আমাকে যখন গল্প পাঠের জন্য আমন্ত্রণ জানাল তখন আমি বিস্মিত হইনি। তবে একটা দ্বিধা ছিল। আমার গল্পপাঠ শুনতে ক জন সুধী শ্রোতাই আর সমবেত হবেন? বিশেষ করে তাঁরা যখন ডাকসাইটে বুদ্ধিজীবী ইরফান ওয়াদুদকে আমার গল্পের ওপর আলোচনা করার আমন্ত্রণ জানানোর কথা আমাকে জানাল, তখনো আমার বিশ্বাস হতে চায়নি যে ওয়াদুদ সাহেবের মতো এমন একজন লোক আমার মতো একজন তরুণের ওপর কথা বলতে আসবেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তা-ই হয়েছে।

ওয়াদুদ সাহেব দেশের শ্রেষ্ঠ সম্মাননা, পদক আর পুরস্কারগুলোকে ডমিনেট করেন। অর্থাত্ কিনা তাঁরই ইচ্ছার ওপর নির্ভর করে, কে পুরস্কার পাচ্ছেন কিংবা কে পাচ্ছেন না।  

সে যা হোক। অনুষ্ঠানটি শেষপর্যন্ত সুন্দরভাবে উতরে গেল। আমার গল্পপাঠের সময় প্রায় দেড় ঘণ্টাব্যাপী উপস্থিত দর্শকশ্রোতা পিনড্রপ সাইলেন্সের মধ্যে বসে থাকল। কিন্তু প্রতিটি পাঠের পরে মুখর হয়ে উঠত সারা হল করতালিতে। বিশেষ করে ‘শাড়ির মধ্যে লেগে থাকা কেঁপে কেঁপে ওঠা দাগগুলোকে’ শিরোনামের গল্পটি পাঠের পর করতালি তো আর থামতেই চায় না। করতালির একটি ঢেউ শেষ হতে না হতে আরেকটি করতালির ঢেউ আসছিল এবং এভাবে তিনবার তিনটি মুখর ঢেউয়ের স্পর্শে আমি প্রায় ডুবে গিয়েছিলাম।

হলের সামনের লনে জটলার মধ্যে তোমাকে আমি আবিষ্কার করলাম অনুষ্ঠানটি শেষ হওয়ার পর। তুমি ভিড়ের ভেতর থেকে উঠে এলে যেন এক অদ্ভুত ভঙ্গিতে। তুমি এগিয়ে এসে আমার দিকে বিস্ময়মাখা হাসি ছড়িয়ে দিয়ে বললে, ‘আমার নাম সাদাফ, আপনার গল্পের নায়িকার নামে নাম আমার। অদ্ভুত গল্প। প্রথমে সাদামাঠাই লাগছিল, কিন্তু শেষপর্যন্ত কোথায় নিয়ে গেলেন আপনার সাদাফকে, সেইসঙ্গে রেদোয়ানকেও।’

আমার গল্পের নায়িকা সাদাফ দেখতে হুবহু তোমার মতোই সুন্দরী কি না আমি জানি না, কিন্তু তোমাকে দেখে তো আমি চমকেই উঠেছিলাম। তোমাকে বোঝাতে পারব না, কী রকম একটা অচেনা শিহরণ আমার শরীরে বিদ্যুত্ কিংবা এই জাতীয় কোনোকিছুর মতো বয়ে গিয়েছিল। মুহূর্তেই আমার মনে হয়েছিল, তোমাকে নিয়ে আমি একটি গল্প লিখব। কিন্তু আমি জানি, তুমি হলে এমনই একটা সৌন্দর্য যাকে নিয়ে গল্প লেখার বদলে কবিতা লিখতে পারলেই মানানসই হয়।

আমি হেসে বললাম, ‘আমার গল্পের নায়িকার নামে নাম বলেই কি আপনাকে একটু বেশি আচ্ছন্ন করেছে?’

‘মোটেই না।’ তুমি দৃঢ়কণ্ঠে বললে। ‘হলভর্তি সকলের নাম কি আর সাদাফ? আপনি দেখেননি গল্পপাঠ শেষে কী রকম সাড়া পড়ে গিয়েছিলো!’

আমারও তা-ই মনে হয়েছে। গল্পটি হয়তো কোথাও ভালো হয়ে থাকবে।

‘অ্যাপারেন্টলি সাদামাটা, কিন্তু ভেতরে গল্পটি হয়তো অনেক ক টা স্তরকে ধারণ করতে পেরেছে, যা হতে পারে, স্রোতাকে স্পর্শ করেছে।’

আরো অনেকেই আমার সঙ্গে কথা বলতে চাচ্ছিল। তুমি সেটা বুঝতে পেরে দ্রুত সরে যেতে যেতে বললে, ‘আমি গেটের পাশে আমগাছটির নিচে অপেক্ষা করব। যদি অনুমতি রাখেন আপনার সঙ্গে আরো কিছু কথা বলতে চাই।’

আমি তোমাকে মাথা নেড়ে হাসিমুখে সায় দিই। আবার একইসঙ্গে অবাকও হই, তোমার ভালো লাগার ভেতরকার একটি ডেসপারেট ইনগ্রেডিয়েনটকে দেখে। প্রায় আধঘণ্টা পর আমি গাছটির নিচে পৌঁছাতে পারি। গিয়ে দেখি, তুমি সেখানে দাঁড়িয়ে আছ। আমি তোমার সামনে উপস্থিত হতে পেরে সত্যি সত্যি হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম। সেটা তুমিও বুঝতে পেরেছিলে কি না আমি সেটা জানি না। তোমার সঙ্গে আমিও কথা বলব বলে—আমার সঙ্গে যে দু-একজন থেকে যেতে পারত, কিংবা গাড়িতে আমার সঙ্গী হতে পারত—আমি তাদের কৌশলে এড়িয়ে এসেছিলাম। যদিও যাদের আমি এড়িয়ে এসেছিলাম তাদের কেউ কেউ এর কারণটি যে তুমি, সেটা বুঝতে ভুল করেনি। দু-একজন হয়তো মুচকিও হেসেছিল এই তরুণ গল্পকারের কাণ্ড দেখে। তবে ‘প্রতিভা’র সভাপতি বিশেষ কার্যকরী ভূমিকা নিয়েছিল, যার জন্য আমি তার কাছে কৃতজ্ঞ। তা না হলে আরো দেরি হয়ে যেত আমার ফ্রি হতে হতে। অন্যদিকে তুমি একজন মেয়ে মানুষ, মিরপুর দশ নম্বর গোল চত্বর, তোমার গন্তব্যস্থলে পৌঁছানোর কাজটা একটু কষ্টসাধ্য হয়ে পড়ত বৈকি। শাহবাগ থেকে তার দূরত্ব তো আর কম নয়! অবশ্য আমি তখনো তো আর জানি না যে তুমি মিরপুর দশ নম্বরে থাকো! এছাড়া আমি মনে মনে এ-ও ঠিক করে ফেলেছিলাম যে, তুমি রাজি হলে আমার গাড়িতে আমি তোমাকে ড্রপ দেওয়ার উদ্যোগ নেব। সাদাফ, একবার ভেবে দেখ মানুষের কোনোকিছুকে ভালো লাগলে তার জন্য সে কত দ্রুত চিন্তা করতে পারে! সত্যি, আমি খুব দ্রুতই চিন্তা করেছিলাম।

আমগাছটির পাশে ছিল বিদ্যুতের একটি উঁচু খুঁটি। ঠিক তার ওপরে যেন তাকে ছুঁতে ছুঁতে আকাশজুড়ে উঠে এসেছিল একটি গোল তশতরির মতো চাঁদ। আর তার নিচে তুমি স্থির দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছিলে আমার জন্য। অপেক্ষা করছিলে ঠিক চাঁদের নিচে।

একবার নানা দ্বিধায় এবং কনফিডেন্সের অভাবে ‘প্রতিভা’র অনুষ্ঠানটিতে আমি যোগ দিতে পারব বলে মনে হয়নি। কিন্তু এ অনুষ্ঠানটিতে আমি গল্প না পড়লে তোমার সঙ্গে কি আমার আর দেখা হতো? না হলে আমি জীবনের একটি আশ্চর্যকে উন্মোচন করার নিবিড় সুযোগ থেকে বঞ্চিত হতাম। হতাম না বলো? এত তাড়াতাড়ি নিজেকে মুক্ত করতে পারব বলে ভাবিনি। আমার কপাল ভালো, সাদাফ। শেষপর্যন্ত আমি ঠিক ঠিক চলে আসি তোমার কাছে, হলের গেটের আমগাছটার কাছে।

 

দুই

আমার নাম হাবিবুল ইমদাদ। আমার গল্পের প্রশংসা করতে করতে আমার নামেরও তুমি প্রশংসা করলে। বললে, আমার নামটি বেশ আনকমন। চাঁদের আলোটাকে রাত্রিতে শহরের বিদ্যুতের আলোর পাশে আরো একটু কী রকম যেন ভিন্ন বলে মনে হয়। যেমন এ মুহূর্তে আমি হাবিবুল ইমদাদ আর তুমি সাদাফ চৌধুরী যে চাঁদের আলোর নিচে, আমগাছটার নিচে এবং বিদ্যুতের খুঁটির নিচে দাঁড়িয়ে আছি সেটা একটু অন্যরকমের বলেই মনে হতে পারে!

তুমি সেই প্রসঙ্গে অবশ্য গেলে না। তুমি আমার গল্পটি নিয়ে তখনো তোমার অনুভূতিকে নানা বাক্যে উপস্থাপিত করছিলে।

তুমি বললে, ‘ইমদাদ ভাই, সেন্ট্রাল রোড কিংবা এ জাতীয় কোনো একটা রাস্তায় আপনার গল্পের নায়িকা সাদাফের বাসা। তারই আশপাশে একটা দোকানের আড়ালে সাদাফকে অনুসরণ করার উদ্দেশ্যে গল্পের নায়ক রেদোয়ান অপেক্ষা করছে, সিগারেট টানছে। তারপর ধরুন সাদাফদের বাড়ির সামনে যানজট, দুই রিকশাওয়ালার গালিগালাজ, শবযাত্রা ইত্যাদি সবকিছুকেই ছোট ছোট বাক্যে খুব সুন্দর করে মূর্ত করেছেন আপনি।’

আমি মিটিমিটি হাসি। সাদাফের দিকে তাকিয়ে বলি, ‘চেষ্টা করেছি ফুটিয়ে তুলতে।’ তুমিও হাসলে এবার! তোমার দাঁতগুলো চাঁদ আর বিদ্যুতের মেশামেশি হওয়া আলোয় কেমন যেন চিকচিক করে উঠল।

তুমি বললে, ‘রিকশাওয়ালাদের অকথ্য গালাগালির সময় একটি অ্যাম্বুলেন্স এসে তীব্রভাবে ককানোর চিত্রটাও সুন্দর। বিশেষ করে রিকশাওয়ালাদের গালিগুলো সাদাফের মুখের ওপর গিয়ে পড়েছে বলে যেখানে গল্পের নায়কের মনে হয়েছিল, সেখানটায় নায়কের সেই মুহূর্তের মনোভাবটি ফুটে উঠেছে। অবশ্য এখানে সে মনে হওয়াটা গল্পের নায়ক রেদোয়ানের নয়। গল্পকারই বর্ণনা করেছেন। কিন্তু পাঠকের কাছে এই মনে হওয়াটাকে রেদোয়ানেরই বলে মনে হবে। কারণ গল্পের নায়ক সেই মুহূর্তে তার প্রেমিকাকে সন্দেহ করছে অন্য কোনো পুরুষকে নিয়ে। নিজের ভালোবাসার নারীকে নিয়ে নায়কের মনে সন্দেহ সৃষ্টি হওয়া এবং তার কারণে যে দ্বন্দ্বের মধ্যে পড়ে নায়ক, তার উপস্থাপনটাও ছোট ছোট বাক্যে সুন্দর এসেছে।’

‘একটি রিকশাায় দুজন প্যাসেঞ্জার ছিল—পিতা আর তার কন্যা। অশ্লীল গালিগালাজের মধ্যে তারা পরস্পরের দিক থেকে মুখ ঘুরিয়ে নিয়ে পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার দৃশ্যটিকে একটি বাক্যে আপনি ফুটিয়ে তুলেছেন। চমত্কার।’ তুমি আরো বলতে থাকলে, ‘সেন্ট্রাল রোড থেকে হাতিরপুল হয়ে কাঁচাবাজারের পাশ দিয়ে কাটাবন পর্যন্ত রেদোয়ানের ও সাদাফের আগেপিছে যাওয়ার বর্ণনাটি শুনতে শুনতে আমার চোখে ঐ এলাকার সম্পূর্ণ চিত্রটা ফুটে উঠেছিল। বিশেষ করে রেদোয়ানের মনের মধ্যকার বিরোধগুলো এবং সেইসঙ্গে রিকশাওয়ালার সঙ্গে বাক্যবিনিময় খুব ভালো এনেছেন আপনি, ইমদাদ ভাই! সেন্ট্রাল রোড এলাকায় আমার খালার বাসা। ইউনিভার্সিটি থেকে হাতিরপুল, কাটাবন ইত্যাদি হয়ে সেন্ট্রাল রোড এলাকায় যাওয়াআসা করি আমি। আমি চিনি এলাকাটাকে। আমার কাছে সম্পূর্ণ এলাকাটাই আপনার গল্পের দু-একটি বাক্যের আঁচড়ে চমত্কারভাবে ফুটে উঠেছে।’

আমি অনেকক্ষণ ধরেই গল্পের প্রসঙ্গ থেকে তোমাকে অন্যদিকে নিয়ে যেতে চেষ্টা করছিলাম। কিন্তু পারছিলাম না।

আমি, হাবিবুল ইমদাদ, একজন বাস্তবের সাদাফের কাছে খানিকটা যে অসহায় বোধ করছিলাম সেটা কি তুমি টের পাওনি, সাদাফ? আমি তোমাকে একপর্যায়ে থামিয়ে দিয়ে বললাম, ‘থাক এবার গল্পের কথা। আপনার কথা বলুন। কী নাম আপনার?’ 

তুমি হাসলে। বললে, ‘অর্ধেকটা এবং আসল অংশটা তো জেনেই গেছেন। আপনার গল্পের নায়িকার নামে নাম। সাদাফ। পুরো নাম আমার সাদাফ চৌধুরী। ইউনিভার্সিটিতে সমাজবিজ্ঞান পড়ছি।’

একটু থেমে তারপর আবার বললে, ‘আপনার নায়িকা অবশ্য ইকোনোমিকেসর ছাত্রী।’ বলে হাসলে আবার।

আমি তোমাকে জিজ্ঞেস করি, ‘বাসা কোথায়, সাদাফ, আপনার?’

‘মিরপুর দশ নম্বর গোল চত্বরে। জানেন, আমাদের পাড়াটা এক্কেবারে গাছগাছালিতে ভরা। আজ পূর্ণিমা তো, চাঁদটা আমাদের পাড়ায় এলে পাগল হয়ে ওঠে।’

‘তা-ই!’ আমি বলি। তারপর একটু উদ্বেগ ফুটিয়ে বলি, ‘সাদাফ, রাত ন টার ওপরে বেজে গেছে কিন্তু। কিভাবে যাবেন? অনেক দূরের পথ।’

তুমি বললে, ‘হ্যাঁ, এবার যেতে হয় কিন্তু ইমদাদ ভাই। আমি শাহবাগ থেকে ভলবো বাসে চেপে এক্কেবারে বাসার সামনে গিয়ে নামব। আপনার ভিজিটিং কার্ডখানা কি দেবেন? আর আপনি চা খেতে আসুন একদিন আমাদের বাসায়। আমার ছোটবোন শাবানাকে একেবারে চমকে দেবো আপনাকে বাসায় এনে। আপনার সঙ্গে যে আমার পরিচয় আর আড্ডা হলো, সে কথা আমি শাবানাকে গিয়ে বলব। ও কিন্তু প্রথমে বিশ্বাসই করবে না।’

আমি তোমাকে এবার এই জায়গাটিতে থামাতে চেষ্টা করি। হা-হা করে হাসি। আমি জানি একটা তৃপ্তিরও হাসি এটা। জানি না তোমার কাছেও সেটাকে তা-ই মনে হয়েছিল কি না!

আমি তোমাকে বলি, ‘সাদাফ, আমার সঙ্গে গাড়ি আছে। আমি আপনাকে পৌঁছে দিই আপনার বাসায়? তাহলে তাড়াতাড়ি পৌঁছে যেতে পারবেন।’

আমার প্রস্তাবে তাত্ক্ষণিকভাবে কোনো সাড়া দিলে না তুমি। আমার মনে হলো তুমি কিছুটা ভেবে নিচ্ছ। তুমি ভাবছ, এই প্রস্তাবমতো সদ্যপরিচিত একজন মানুষের গাড়িতে করে যাওয়া ঠিক হবে কি না?

স্বাভাবিক। সেটাই স্বাভাবিক। সেই জন্যই আমি আর একবার জোর করে বললাম। তোমাকে আমি জানালাম, এতে করে আমি খুশিই হব বরং। আর, তাছাড়া আমি আরো কিছুক্ষণ হয়তো তোমার সঙ্গ কামনা করছিলাম, সাদাফ। তুমিও সেটা বুঝতে পেরেছ বলে আমার মনে হলো।

তুমি একটা অদ্ভুত মেয়ে সাদাফ। আমার গল্পের সেই নায়িকা সাদাফেরই মতো। আমি তোমাকে চাঁদের আলোর নিচে গল্পের সাদাফের সঙ্গে আন্তরিকভাবে মিলিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করলাম। তুমি সেলোয়ার-কামিজ পরেছ। শাড়ি পরলে ভালো হতো। তুমি একদিন গল্পের সাদাফের মতো অলিভ রঙের একখানা জামদানি পরে এসো এই চাঁদের নিচে।

তুমি মাথা নাড়লে। জানালে, তুমি আমার গাড়িতে যাবে। আমার ড্রাইভার দরজা খুলে ধরলে তুমি গাড়িতে উঠে বসলে। আমিও গাড়ির পেছন দিক দিয়ে ঘুরে গিয়ে গাড়িতে তোমার ডান পাশে বসলাম।

গাড়ি চলতে শুরু করলে তুমি কিছুক্ষণ বাঁ পাশে তাকিয়ে থাকলে। তারপর গাঢ় দৃষ্টিতে মুখ ঘুরিয়ে আমার দিকে তাকালে। আমি তোমার চোখের মধ্যে কী যেন খুঁজতে চেষ্টা করলাম। আমার মনে হলো হয়তো বা তুমি আমার মধ্যে কিংবা আমি তোমার মধ্যে কিংবা উভয়ে উভয়ের মধ্যে একজন বন্ধুকে খুঁজে পেয়ে গেলাম!

অনেকক্ষণ চুপ করে থেকে তুমি কথা বললে। আমাকে জিজ্ঞেস করলে তোমাকে বিষণ্ন মনে হচ্ছে কি না আমার কাছে? হ্যাঁ, তোমাকে হঠাত্ করেই কেন জানি না বিষণ্ন মনে হচ্ছে। পরিচয়ের সময় তোমাকে যেমন উত্ফুল্ল দেখাচ্ছিল, এমনকি আগপর্যন্তও তোমাকে যতটা সজীব মনে হচ্ছিল, এখন আর সেটা মনে হচ্ছে না।

‘কেন সাদাফ?’

তুমি কথা বলা শুরু করলে।

‘জানেন, ইমদাদ ভাই, সবচাইতে বেশি মর্মস্পর্শী মনে হয়েছে আমার কাছে গল্পের শেষ অংশটাকে। যেখানে নায়িকা সাদাফ তার শাড়ি খুলে খুলে শাড়ির ওপর জমে থাকা দাগগুলোকে দেখাচ্ছে তার সন্দেহপ্রবণ মনের প্রেমিককে। তার শাড়ির ভাঁজে ভাঁজে অন্য পুরুষের কোনো চিহ্ন যে লেগে নেই, সেটাই গল্পের নায়িকা বোঝাতে চেষ্টা করছিল তার প্রেমিক রেদোয়ানকে।’

‘জানেন, আপনার গল্পটি শুনে আমারও একখানা জলপাই রঙের জামদানি পরতে খুব ইচ্ছে হয়েছিল। আমার ইচ্ছে হয়েছিল—’

সাদাফ, তোমাকে আমি এই জায়গায় থামিয়ে দিয়েছিলাম। অবাক হয়ে প্রশ্ন করেছিলাম, ‘আপনারও ইচ্ছে হয় আমার গল্পের নায়িকার মতো শাড়ি পরতে? কেন, সাদাফ?’

সাদাফ, তুমি হেসে উঠলে। আঙুল দিয়ে কপাল চুলকাতে চুলকাতে কিছুক্ষণ চোখ বন্ধ করে থাকলে। তারপর তুমি বললে, ‘এই জন্য যে, তাহলে আমিও আপনার গল্পের মায়িকার মতো আমার প্রেমিকপ্রবরকে শাড়ির এক-একটি প্যাঁচ খুলে দেখিয়ে দিতে পারতাম শাড়িতে লেগে থাকা দাগগুলোকে। বলতে পারতাম, এই দেখ রশিদ, এটা হলো বৃষ্টির দাগ, এটা চাঁদের ভেতর থেকে উপচে পড়া একটি অচেনা আলোর দাগ।’

এরপর তুমি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললে, ‘আর এটা? এটা হলো তোমার শরীর থেকে নেমে আসা এবং জমে থাকা সেই দাগ, যেটা পূর্ণিমার রোদ লাগলে ঝকমক করে ওঠে চিরকাল!’ v