শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

গল্প

মৌন শয়তান

আপডেট : ০১ জুন ২০১৯, ০০:০১

 ‘আলিমজানের মক্তবটা চেনেননি?’

‘ওখানে থাকেন তিনি!’ আমি বললাম।

‘আরে নাহ। ডাইনে-বাঁয়ে না তাকায়া সোজা এই নাক বরাবর হাঁটবেন। কিছুদূর যাওয়ার পর দেখবেন, একটা উঁচা ডিবি। এই ধরেন গিয়া হাত তিনেক। ওইটা দেখার সঙ্গে সঙ্গে রুমাল চাপা দিবেন নাকে। রুমাল না থাকলে হাত চাপা দেবেন।’

‘কেন?’

‘ওইখানে শয়তান গো পেশাবখানা।’

‘বুঝলাম না।’

‘শয়তান চেনেন?’

‘চিনি না, তবে বুঝি।’

‘কী বোঝেন?’

‘মানুষদের খারাপ পথে নিয়া যায়, নিজেও খারাপ কাজ করে।’

‘এই শয়তান সেই শয়তান না। এই শয়তানের দুই কান, দুই চক্ষু, দুই হাত, দুই পা। বড়ই খতরনাক। সারা রাস্তায় ড্যাংড্যাংয়াইয়া হাঁটে, ওইখানে আসলেই প্যাট ভারী হয়া যায় তাগো। কাপড় খু্ইল্যা উবুদ হয়া ঝাইর্যা দেয় ঝরঝর কইর্যা।’

‘প্রস্রাব পেলে মানুষ প্রস্রাব করবে না!’

‘করবে, তয় এই রাস্তায় কেন?’

‘এই রাস্তায় করলে সমস্যা কী?’

‘ওস্তাগ ফেরুল্লা। আন্নে তওবা পড়েন। নাইলে আপনের সঙ্গে কোনো কথা নাই।’

‘তওবা  পড়ব কেন!’

‘এইড্যা কোন রাস্তা জানেন না?’

‘না।’

‘রাস্তায় ঢোকার মাথায় একটা সাইনবোর্ড আছে, ওইড্যা পড়েন নাই?’

‘না, চোখে পড়ে নাই তো ওইটা।’

‘কয়েক শ মিটিমিটি বাতি লাগানো আছে ওহানে। রাইত তো রাইত, দিনের বেলাতেও ঝকঝক কইর্যা জ্বলে। সবার চোখে পড়ে ওইড্যা, আপনের চোখে পড়ল না! আপনের চোখে সমস্যা আছে, যান আগে ডাক্তার দেখান।’

‘সত্যি আমি খেয়াল করিনি।’

‘আপনার চোখে না হয় সমস্যা, নাকে তো নাই।’

‘না, আমার চোখেও সমস্যা নাই, নাকেও নাই।’

‘ওই সাইনবোর্ডের নিচে প্রতিদিন দু-দ্যাড় শ প্যাকেট আগর বাতি জ্বলে। এক মাইল দূর থাইক্যা তার সুবাস পাওয়া যায়। মানুষ অনেক সময় রাস্তা ভুল করে, কিন্তু ওই সুবাসের তোড়ে ঠিকই রাস্তাটা চিনা ফালায়। যান, আপনের সঙ্গে আর কোনো কথা নাই। প্রথম আইসছেন, তাই মাফ করি দেওয়া হইল। আপনি নাক বরাবর হাঁটতে থাকেন। দাঁড়ান—’ হাত টেনে ধরেন মানুষটি। পাঞ্জাবির পকেট থেকে ছোট একটা বোতল বের করে খুলে ফেলেন ক্যাপটা। সেখান থেকে কিছু একটা নিয়ে হাতে লাগিয়ে দেন আমার, ‘সুবাস নেন, বালা-মুশিবত থাকব না, কাইট্যা যাইব সব।’

 

দুই

নাক বরাবর তাকাই আমি। মাথার সিঁথির মতো একটা রাস্তা চলে গেছে দক্ষিণে। সাদা মাটির রাস্তা। দূর্বা ঘাস আর বুনো লতায় ছেয়ে গেছে আশপাশ। কাঠসর্বস্ব কতগুলো খেজুর গাছ দাঁড়িয়ে আছে সারিভাবে, যেন কালের সাক্ষী হয়ে জানান দিচ্ছে তারা মানুষদের—হে মানুষ দেখ, একদিন বেঁচে ছিলাম আমরাও।

কিছুদূর গিয়েই থমকে দাঁড়াই। রাস্তার পাশে মহীরুহ হয়ে উঠেছে একটা আকন্দ গাছ। তার একটাতে দুটো ভ্রমর। এক হয়ে বসে আছে চুপচাপ। একটা টুনটুনি এসে লুকিয়ে পড়ল পাতার আড়ালে। খাবার খোঁজার ব্যস্ততায় এতই মগ্ন সে, আশপাশে তাকানোর সময় নেই তার।

দুটো প্রজাপতিও উড়ে গেল পাশ দিয়ে।

আসন্ন শীতের গীত গাইছে বাতাস, সোনা রঙের রোদও। ঘাসের ডগাগুলোও কেমন লকলকিয়ে উঠেছে একেকটা। তার একটু দূরে দুধেল গাইটা জাবর কাটছে আপন মনে। আর লেজ তুলে দৌড়ানো বাছুরটা থমকে দাঁড়ায় হঠাত্। মাকে দেখে, দেখে নিজেকেও, তারপর আবার দে ছুট।

কোথাও একটা ফুল ফুটেছে অথবা অনেকগুলো। অচেনা সুবাস। তবে মুগ্ধ করা। তা ছাপিয়ে কেউ একজন চিত্কার করে উঠল। আবার স্থির। আবার চোখের চঞ্চলতা। ভুবন চিলের ডানা মেলানো আকাশ ভ্রমণ। মাঝে মাঝে তার শব্দ। যেন অবিকল মানুষ, শব্দ করেই তার যাপিত জীবন।

ক্লান্ত চাকায় একটা রিকশা চলে যায় পাশ দিয়ে।

‘যাবেন।’

উত্তর দেওয়ার প্রয়োজন বোধ করেন না রিকশাওয়ালা। কিংবা গভীর কিছু ভাবছেন তিনি। শুনতে পাননি আমার কথা। অথবা বাড়িতে অপেক্ষা করা বউয়ের কথা ভাবছিলেন। সানকিতে ভাত, সঙ্গে ধঞ্চে শাকের ভাজি। পাশে পুড়ে যাওয়া একটা লাল মরিচ। অথবা এসবের কোনোকিছুই না। হিসাব মেলাচ্ছেন তিনি। জীবনের না, আজকের।

প্রতিটা দিনই যে একেকটা জীবন। তাদের। নিম্ন কিংবা মধ্যবিত্তের।

উঁচু ঢিবিটার কাছে এসে আমার নিজেরই পেট ভারী হয়ে যায়। আশপাশে তাকাই। কেউ নেই। ভেজা চুপচুপে ঢিবির গায়ে মুক্তমনে জল বিয়োগ। আচ্ছা, জীবনানন্দ তো এ রকম পথের পর পথ হাঁটতেন। তিনি কি এরকম করেছেন কখনো, পথে—পথের পাশে!

দশ-বারো মিনিট হাঁটার পর আলিমজানের মক্তব। টিনের লম্বা ঘর। তার বারান্দায় সারি করে বসা মক্তবের ছেলেরা। দুলে দুলে তারা সুর করে পড়ছে—আলিফ যবর আ, বে যবর বা...। বিকেলের ফুরফুরে হাওয়ায় গোল টুপি পরা হুজুর। ক্ষীণকায় দেহে ঝিমাচ্ছেন তিনি। সামনে একটা কঞ্চির বেত পড়ে আছে অবহেলায়। পাশে একটা পানের খিলি। একটা মাছি বসে আছে তার ওপর। চুপচাপ।

বারান্দায় গিয়ে বসি তার। হুজুর এক পলক আমার দিকে তাকান। গন্তব্যর সঠিক রাস্তার কথা জিজ্ঞেস করি। পাশ থেকে পানটা হাতে নেন তিনি। মুখে পুরে সরু করে ফেলেন চোখ দুটো। কাগজে লাগানো চুন আঙুলে ছোঁয়ান, তারপর জিভে।

‘আন্নে কইনতন আইছেন?’

আমি আমার ঠিকানা বলি।

‘ওইহানে যাওয়ার মতলব কী?’

‘তেমন কিছু না।’

‘অ্যাতো দূরর থাইক্যা আইছেন, কিছু না কিছু মনস্কামনা তো আছেই।’

‘না, তেমন কোনো কারণ নাই।’

চোখ দুটো আরো সরু হয়ে যায় হুজুরের। চুনের আঙুলটা আরো একবার জিভে ছুঁইয়ে তিনি সামনে বসা ছাত্রদের দিকে তাকান, ‘বাবারা, তোমরা আজ বাড়িত যাও। ছুটি। কাইল বালো কইর্যা পইড়্যা আইসো।’

সবাই চলে যাওয়ার পর হুজুর কাছে এসে বসেন আমার। মোসাফা করার ভঙ্গিতে হাত দুটো চেপে ধরেন, ‘বড় বালা জায়গায় যাইতাছেন।’

‘আপনার এখানে সব ছেলে দেখলাম। কোনো মেয়ে পড়তে আসে না?’ জিজ্ঞেস করলাম।

‘না।’

‘কেন?’

‘আপনি শিক্ষিত মানুষ, এইড্যা কি বলার দরকার আছে?’

‘তবু একটু শুনতে ইচ্ছে করছে।’

পান চাবানোর সবটুকু রস চুষে পেটে ঢুকালেন হুজুর। তারপর দু-তিনবার চাবাতে চাবাতে সোজা হয়ে বসেন তিনি। হাতের চুনটুকু নিচের ছালার সঙ্গে মুছতে মুছতে বলেন, ‘মাইয়ারা হচ্ছে পর্দার জিনিস। তাগো বাইরে আসার দরকার কী! ভাত রাইনবো, স্বামীর খেদমত কইরবো, বাচ্চা বিয়াইবো, ওইগুলা লালন-পালন কইরবো। ব্যাস, আর কোনো কাম নাই।’

‘এখানে কোনো স্কুল নেই?’

‘আছে। ওইটা শয়তানের কারখানা।’

‘কী হয় ওখানে?’

‘বেলেল্লাপনার একটা সীমা আছে! ছেলেমেয়েরা সব একসঙ্গে বইসা ক্লাস করে। সব জাহান্নামি, খাঁটি জাহান্নামি।’

‘আমি যে জায়গাটায় যেতে চাচ্ছি, সেখানে যেতে আমার কতুটুকু সময় লাগতে পারে?’

‘এই ধরেন গিয়া মিনিট পঁচিশেক।’

‘আমি তাহলে উঠি।’

‘হুজুরের নাম নিয়া হাঁটা শুরু করেন। সব ক্লান্তি দূর হয়া যাইব। আন্নে সোজা গিয়া বামে মোচর নিবেন। তারপর বাঁশঝাড়। ওর নিচ দিয়া যাওনের সময় একটা মাটির কলস দেখতে পাবেন, লাল সালুতে বান্ধা। ওইখানে কিছু দিয়া যাবেন। বহুত ফায়দা হবে।’

 

তিন

বাঁশঝাড়ের কাছে আসতেই কেমন স্থির হয়ে যায় বুকের ভেতরটা। এত সবুজ কেন চারপাশ! গাঢ় ছায়া। অন্তহীন প্রশান্তি!

আমাদের গায়েও এমন বুনোট মগ্নতা ছিল। বিকেলের আলো মরে যেতে যেতে সন্ধ্যা নামত হঠাত্। তারপর পশ্চিম আকাশ। নিপুণ শিল্পীর ইজেলে আঁকা যেন এক দগ্ধ সন্ধ্যা। বুক খালি করা দীর্ঘশ্বাস, মন খারাপ করা বিস্তীর্ণ প্রহর।

মগ্নতায় তবুও বসে থাকা। চুলোতে বলক দেওয়া দুধের সরের মতো তিরতির করে কাঁপা বাঁশপাতার ফাঁকে ঘোলাটে চাঁদ। মন ব্যাকুলিয়া প্রান্তর। উদাস জাগরণে হারিয়ে ফেলা নিজেকে।

এরই মাঝে দূরে উড়ে যাওয়া পাখির ঝাঁক, বাসায় ফেরার হর্ষধ্বনি। কখনো ভেসে যাওয়া মেঘের দূরন্তপনা। কখনো নীলচে কোনো ফুলের মগ্ন সুবাস। কেঁপে ওঠে মন, নেচে ওঠে হূদয়। তারপর হঠাত্ থই থই নির্জনতা। কোথাও কেউ নেই।

বাঁশের ছায়া বেয়ে আরো একটু এগিয়ে যাই। লাল সালু ঘেরা বিশাল একটা পাত্র, তার ওপর জরির সুতোয় ছাওনি দেওয়া। মাঝখানে কতগুলো খুচরো টাকা, কতগুলো কয়েন।

‘দুইটা নোট দিয়া যান এইখানে।’

চমকে যাই এবং থমকে দাঁড়াই। মাথায় পুরনো তেনার পাগড়ি জড়ানো একটা মানুষ। তাকিয়ে আছেন আমার দিকে। খেয়াল করিনি এতক্ষণ।

মানুষটা কুঁজো। কিন্তু চোখ দুটো উজ্জ্বল। কঙ্কালে জড়ানো শুকনো চামড়ার মতো তাঁর হাত। অনামিকায় একটা আংটি, লাল পাথরের। পরনে সাদা ধরধবে লুঙ্গি, গায়ের ফতুয়াটাও সাদা। গলায় একটা মালা, তসবির গোটার মতো।

মানিব্যাগ থেকে দুটো নোট বের করলাম একশ টাকার। লাল সালু জড়ানো পাত্রের ওপর রাখতেই মুচকি একটা হাসি দিলেন তিনি। খুশ গলায় বললেন, ‘আপনি যেইখানে যেতে চাচ্ছেন, সেটার রাস্তা এটা।’

‘রাস্তাটা এত নির্জন কেন?’

‘এই রাস্তার সবকিছু ধ্যান করে।’

‘গাছপালা, ঘাস, বাঁশ—সব!’    

‘হ্যাঁ, সব।’

‘কীসের ধ্যান করে?’

ঝট করে উত্তর দেন না মানুষটা। একদলা থুথু ফেলেন পাশের বালিতে। মাথায় নেতিয়ে পরা পাগড়িটা ঠিক করতে করতে বলেন, ‘জীবন বড় বিচিত্র। এখানে সবাই সবার ধ্যান করে।’ একটু থামেন মানুষটি, ‘ধ্যান করছেন আপনিও। সেটা মুখে না হোক, চিন্তায়। আপনার মাথাটা ভাবনায় ভরা, গিজগিজ করা ভাবনা।’

‘আমি কি এই সোজা পথ ধরে যাব?’

‘আপনাকে যেতে হবে না, এই পথই আপনাকে নিয়ে যাবে।’

‘এই নির্জন জায়গায় আপনি একা। ভয় লাগে না?’

‘আমি তো একা নই।’

‘কই, আর কাউকে তো দেখছি না!’

‘ওটা দেখার জন্য চোখ লাগে। আপনি সোজা চলে যান, চোখ খুলে যাবে আপনার।’ মানুষটা চোখ তুলে তাকান। দ্বিতীয়বারের মতো চমকে উঠি আমি। আমার মনে হলো—ওই মানুষটার কোনো চোখ নেই। জায়গাটা খালি। অন্ধকার, বিশাল দুটো কালো গর্ত সেখানে।

 

চার

আসমান সমান গেটটার কাছে এসে দাঁড়ালাম। সুতোর কাজ করা ঝালর, রঙিন কাপড় আর কাগজের বিচিত্র ফুলে ছেয়ে আছে পুরো গেট। তার সঙ্গে টানানো একটা ব্যানার। বারো শব্দের একটা নাম লেখা তাতে।

গেটটা পেরুতেই ডানপাশে মস্ত বড় একটা তামার ডেকচি, তার ওপর লম্বা একটা কাঠ। আগরবাতির চরম সুবাস আসছে সেখানে রাখা মাটির পাত্র থেকে। সঙ্গে ধোঁয়ার ঊর্ধ্বমুখী কুণ্ডলী, যেন আসমানে যাচ্ছে তারা, ওখানেই তাদের আশ্রয়।

মাটি বিছানো একটা উঠোন। মৃদু পায়ে তা পেরুনো। হন্তদন্ত একজনের ছুটে আসা। দু হাত এগিয়ে দিয়ে মোসাফা করতে করতে কান বিস্তৃত একটা হাসি তার, ‘আপনি ঢাকাততন আইছেন, সাম্বাদিক। হুজুর কইছেন। সোজা হাডি যান। তয় মাথা নিচু কইর্যা হাঁইটবেন, রুকুর মতো।’

‘হুজুর বলে দিয়েছেন ওভাবে হাঁটতে?’

‘না না, এইটাই নিয়ম। তারপর বামে একটা পিলার থুইয়া ডাইনের গলিত হুত করি হান্দি যাইবেন। দেইখবেন, মানুষে সয়লাব। বসি পইড়বেন ওইখানে। তারপর যথাসময়ে ডাক পড়ব আপনার। আপনার অনেক উঁচা কপাল।’

‘উঁচা কপাল মানে?’

‘হুজুর যার তার সঙ্গে রাতের আহার খান না। যারে পছন্দ করেন, তার সঙ্গে খান। তিনি আপনারে পছন্দ কইরছেন। রাতে তিনি আপনের সঙ্গে আহার সারবেন।’ 

গুনগুন শব্দে ভরে গেছে চারপাশ। কেউ কেউ হঠাত্ বলে উঠছেন—বাবা...। কারো কারো মাথার ওপর হাত, যেন কারো সাহায্যের আশায় নিমগ্ন তারা। গলার ভেতর থেকে কারো আধিভৌতিক শব্দ বের হচ্ছে, কেউ কেউ মাথা ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে শুয়ে পড়েছেন মাটিতে।

 

পাঁচ

চার ঘণ্টা পর অবশেষে হুজুরের ডাক পেলাম। ঠাণ্ডা রাত, ঠাণ্ডা পরিবেশ। বিনয়ে গদগদ হয়ে নুয়ে পড়া একজন বললেন, ‘আসেন। হুজুর বইসা আছেন আপনার জন্য।’

হুজুরের দেখা পেলাম। গদিনসীন। মখমলের চাদরে ছাওয়া একটা খাটে বসে আছেন তিনি। পা দুটো মেলে দেওয়া। সদ্য কৈশোর পেরুনো দুটো বালিকা বসে আছে পাশেই। নিবিষ্ট মনে পা দুটো মর্দন করছে তাঁর। তাদের সেই মর্দনে ভক্তি, ভয়, সমীহ আর চিকন আড়ষ্ঠতা।

হুজুর বেশ ওজনদার। একটু কাত হতেই খাটটা ক্যাট ক্যাট করে উঠল। শরীরে চর্বির আদিখ্যেতায় চকচক করছে সবকিছু—গাল, ঠোঁট, মুখ, হাতের আঙুল। কেবল টেনিস বলের মতো ফুলে ওঠা দু গালের চাপে চোখ দুটো ঈষত্ ছোট হয়ে এসেছে। পেটটাও পোয়াতি গরুর মতো যা-তা রকম বেড়েছে। নড়তে-চড়তে একটু কষ্টই হয় তার।

উঠে বসলেন হুজুর। মুখে মিষ্টি একটা হাসি। পাশেই কারুকাজ করা লম্বা একটা চেয়ার। সেখানে বসলেন তিনি। তাঁর সামনে কিছুটা দূরে কয়েকটা চেয়ার রাখা। হাত ইশারা করলেন। বসলাম আমিও।

বালিকা দুটো পা থেকে সরে এসেছে দু পাশে। পর্দার ওপাশ থেকে নত মস্তকে একটা লোক প্রবেশ করলেন। হুজুরের কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করলেন কিছুক্ষণ। মাথা কাত করে সম্মতি জ্ঞাপন করলেন হুজুর।

পা মেলে দিয়ে চেয়ারে হেলান দিলেন এবার হুজুর। আগের পর্দার পাশ দিয়েই মাঝবয়সী একটা ভদ্রলোক ঢুকলেন, সঙ্গে একজন মহিলা। সম্ভবত স্বামী-স্ত্রী। হুজুরের মেলে দেওয়া দু পায়ে হুমড়ি খেয়ে পড়লেন তাঁরা। কপাল ঠেকালেন, কাতরতার চরম আবেগে কেঁদেও উঠলেন। তারপর তাঁদের হাতে রাখা টাকার দু-দুটো বান্ডিল মেলে দিলেন হুজুরের পায়ের পাশেই। হুজুর শুধু তাঁর বিভিন্ন রঙের বিভিন্ন পাথরের আংটিবহুল ডান হাতটা উঁচু করলেন। আশীর্বাদের ভঙ্গি করলেন। তারপর তাঁর বর্ণিল সুতোর কারুকাজ করা টুপিটা ঠিক করলেন, একটু নেমে এসেছিল ওটা সামনে। হাতটা নেমে এল দাড়িতে। কয়েকবার সেখানে আঙুল সঞ্চালন করে ঠেস দিলেন আবার চেয়ারে।

পুরুষ আর মহিলাটা বের হয়ে গেলেন রুম থেকে। কোনায় দাঁড়ানো ক্ষীণ দেহের লোকটাকে ইশারা করলেন। ভেতরের দিকে গেলেন তিনি। একটু পর চার-পাঁচ জন মানুষ এসে দাঁড়ালেন হুজুরের পাশে। এলাকার জনপ্রতিনিধি, আইনরক্ষাকারীর বড় কর্মকর্তা, দলের স্থানীয় সাধারণ সম্পাদক এবং মোটা গোঁফের দুজন। পরিচিত মুখ সব। ক্ষমতাবানও।

একে একে হুজুরের পাশে দাঁড়ালেন তাঁরা। কেউ হাত টিপতে লাগলেন, কেউ মাথা, কেউ ঘাড়। মেয়ে দুটো নতজানু হয়ে বসে পড়ল পায়ে। ইবাদতের মতো মনোযোগী হয়ে পা টিপতে লাগল তারা আগের মতোই।

হুজুর হাসছেন। তাঁর সমস্ত মুখ চিকচিক করছে সেই হাসিতে। সেই হাসিতে বিগলিত হয়ে যাই আমিও। অফিস অ্যাসাইনমেন্ট ভুলে যাই। আমার আর জিজ্ঞেস করা হয় না—গত দু মাস আগে যে মেয়েটা অজানা এক আগুনে পুড়ে মারা গেল এই মসনদের বড় পুকুরটার পাশে, আগুনটা কোথা থেকে এল? ময়নাতদন্তে একটা ভ্রূণ পাওয়া গেছে মেয়েটার পেটে। অবিবাহিত ওই তরুণীর পেটে কে স্থাপন করেছে সেই একটু একটু করে বড় হতে থাকা মানবদেহ? অথবা আরো কিছু অজানা তথ্য।

 

ছয়

বের হয়ে আসি আমি ওই খাসকামরা থেকে। সিরীয় বংশোদ্ভূত মার্কিন লেখক ওসামা অ্যালোমার হঠাত্ ধাক্কা দেন আমাকে—অন্যায় দেখে যে মানুষ চুপ করে থাকে, সে আসলে একটা মৌন শয়তান।

রাস্তায় পা দিয়ে দেখি—সব জায়গায় সেই মৌন শয়তানের ছড়াছড়ি। হঠাত্ পাশে একটা সেলুনের আয়নায় চোখ যায় আমার। চমকে উঠি—আয়নায় নিজেকে দেখি, ভালো করে দেখি, কিন্তু ওটা আমি নই। আস্ত একটা শয়তানকে দেখা যায় আয়নায়, খাঁটি একটা মৌন শয়তান! v