শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

বাড়াবাড়ি, ভারসাম্য ও ঝড়ের সাতকাহন

আপডেট : ১৫ নভেম্বর ২০১৯, ২১:৫৮

বাড়াবাড়ি ভালো নহে—বহুল উচ্চারিত এই কথাটি আমরা হরহামেশাই শুনিয়া থাকি। কিন্তু আমরা কি কখনো নিরিবিলি চোখ বুজিয়া অন্তরের গভীরে ঢুকিয়া অনুসন্ধান করিয়া দেখিয়াছি—কেন বাড়াবাড়ি ভালো নহে? কিংবা ‘বাড়াবাড়ি ভালো নহে’—ইহা জীবনভর অসংখ্যবার শুনিবার পরও কেন তাহার গুরুত্ব অনেকেই তোয়াক্কাই করেন না। অন্তত যতক্ষণ না ঐ বাড়াবাড়ির বিষফল তাহারা হাতে পাইতেছেন! আমরা কি দেখিতেছি না—কী একটি অপূর্ব নিয়মানুবর্তী ও শৃঙ্খলা মহাবিশ্বের সকল কিছুর মধ্যে প্রকাশ পাইতেছে? কী বিস্ময়কর ভারসাম্য বজায় রহিয়াছে এই জগত্ জুড়িয়া!

মহান সৃষ্টিকর্তা মানুষকে সৃষ্টি করিয়াছেন জ্ঞান-বুদ্ধি, বিবেক-বিবেচনা, আত্মমর্যাদাবোধ দিয়া। আর তাহার পর সতর্ক করিয়াছেন বাড়াবাড়ি না করিতে। কিন্তু কথায় আছে—সূর্যের চাইতে বালির গরম বেশি। এইজন্য আমরা দেখিতে পাই, বালির উত্তাপ অর্জন করিয়া যাহারা নিজেদের প্রবল ক্ষমতাধর মনে করিয়া আসিতেছেন, তাহারাই একসময় সূর্যবিহনে শীতল বালিয়াড়িতে পড়িয়া আহাজারি করিতে থাকেন। কিন্তু পরিতাপের বিষয় হইল—বালির সাময়িক উত্তাপযুক্ত ক্ষমতা পাইয়াই বাড়াবাড়ি রকমের গরম দেখাইবার সময় বুঝিতে পারেন না—এই সাময়িক উত্তাপ একদিন ফুরাইয়া যাইবেই। এইভাবে ইতিহাসের পরতে পরতে দেখা যায়, যাহারা বাড়াবাড়ি করেন, তাহারা ভুলিয়া যান দিল্লির শেষ বাদশাহ বাহাদুর শাহ জাফরের  উক্তিখানি—ওকত অ্যায়েসা নেহি রহেঙ্গা। কেন ঝড় উঠে—আমরা কি তাহা জানি না? বিজ্ঞান বলে, কোনো স্থানে বাতাস খুবই গরম হইয়া গেলে উহাকে ঠান্ডা করিতে ঝড় সৃষ্টি হইবেই। একইভাবে প্রতিনিয়ত বিশ্রী আর ভ্যাপসা গরমের দাপট মিলাইতে সাগরের বুকে নিম্নচাপ সৃষ্টি হইবেই। তাহা কেবল সময়ের ব্যাপার। আরো বেশি বাড়াবাড়ি হইলে সেই নিম্নচাপ হইতে ভয়ানক ঝড় আসিয়া লন্ডভন্ড করিয়া দিবে সকল কিছু। চমকপ্রদ ব্যাপার হইল, ঝড় কখন সৃষ্টি হইবে কেহ বলিতে পারে না। আজকের ঝকঝকে নীল আকাশ দেখিয়া বুঝিবার উপায় থাকে না যে, কয়েক দিন পরও হানা দিতে পারে প্রবল কোনো ঝড়। অর্থাত্ প্রকৃতিতে অধিক উত্তাপ দীর্ঘকাল বজায় থাকিলে উহার ভারসাম্য আনিতে বড়ো ঝড় সৃষ্টি হইতেই হয়। এমনিভাবে মানবসমাজেও সকল কিছুর মধ্যে একটি নির্দিষ্ট সহ্যসীমা রহিয়াছে। ইলাস্টিকের যেমন সহ্যের সীমা অতিক্রম করিলে উহা ছিঁড়িয়া যায়, তেমনি বিশ্বব্যাপী সমাজ-রাষ্ট্রে আমরা ইহার প্রতিফলন দেখিতে পাই প্রতিনিয়ত। সুতরাং সহ্যের ইলাস্টিক ছিঁড়িয়া না যাওয়া অবধি তাহা টানিয়া যাওয়াটা কোনো ক্ষমতাধরের জন্যই বুদ্ধিমানের কাজ নহে। মনে রাখিতে হইবে, বিশ্বজগতে বাড়াবাড়ির স্থান নাই। জগতের সকল কিছুর ভিতরেই রহিয়াছে এক আশ্চর্য ভারসাম্য। ইহাই শৃঙ্খলা, ইহাই নিয়ম, ইহাই প্রকৃতির আইন। মহান সৃষ্টিকর্তারও নির্দেশ রহিয়াছে, কেহ যেন বাড়াবাড়ি না করে।

প্রশ্ন হইল, এত কিছুর পরেও আমরা কেন বাড়াবাড়ি করিতে ভয় পাই না? প্রকৃতপক্ষে যাহারা যথার্থ জ্ঞানী, তাহারা নিশ্চয়ই বাড়াবাড়ি করিতে ভয় পান। অন্যদিকে যাহারা অপরিণামদর্শী, তাহারাই কেবল সীমা লঙ্ঘনের বিপদ অনুধাবন করিতে ব্যর্থ হন। পৃথিবীর পরাশক্তিধর রাষ্ট্রসমূহ হইতে শুরু করিয়া সকল ক্ষমতাধারীকে ইহা বুঝিতে হইবে। নচেত্ সমাজ-রাষ্ট্রের শৃঙ্খলার ভারসাম্য বিঘ্নিত হইবে বারবার। আর ইহার জন্য অনেক বেশি মূল্য চুকাইতে হইবে সংশ্লিষ্ট সমাজ-রাষ্ট্রকে।