শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

‘কী ঘর বানাইমু আমি শূন্যের মাঝার’

আপডেট : ১৬ নভেম্বর ২০১৯, ২২:০৮

মরমি কবি হাছন রাজার প্রখ্যাত একটি গানের দুইটি লাইন হইল—‘লোকে বলে-বলেরে ঘরবাড়ি ভালা না আমার/ কী ঘর বানাইমু আমি শূন্যের মাঝার।’ তৃতীয় বিশ্বের কোনো কোনো জনপদে উন্নয়নের ছাপ পাওয়া যায় হাছন রাজার গানের ভিতর দিয়া। বিশ্বের যে কোনো উন্নত দেশ তাহার রাজধানীকে তৈরি করিয়া থাকে সবচাইতে পরিকল্পিত ভাবে। কারণ রাজধানীই হইল একটি দেশের উন্নয়নের প্রধান আলয় তথা ঘরবাড়ি; কিন্তু উহা ভালো না হইলে দেশের বাকি উন্নয়ন যেন শূন্যের উপর তৈরি হইয়া যায়।

এই বত্সর ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (ইআইইউ) সূচকে বাংলাদেশের রাজধানীকে বলা হইয়াছে বিশ্বের অন্যতম নিকৃষ্ট নগরীর একটি। এই সূচক মাপা হইয়াছে ডিজিটাল নিরাপত্তা, স্বাস্থ্যসেবা, অবকাঠামোগত এবং নাগরিকদের নিরাপত্তাকে বিবেচনায় রাখিয়া। সূচকে শীর্ষে রহিয়াছে জাপানের রাজধানী টোকিও। ইহার পর রহিয়াছে সিঙ্গাপুর, আমস্টারডামের মতো মহানগর। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) ২০১৬ সালের সর্বশেষ জরিপ অনুযায়ী বর্তমানে ঢাকার জনসংখ্যা ১ কোটি ৮০ লক্ষ। ঢাকার আয়তন দেশের মোট আয়তনের মাত্র ১ শতাংশ হইলেও জিডিপির ৩৬ শতাংশ এই শহরটি হইতেই আসে। ইহাই স্বাভাবিক। অথচ ইহার প্রতি ইঞ্চিতে ইঞ্চিতে রহিয়াছে অপরিকল্পনার দুর্বিষহ ছাপ। তথ্যপ্রযুক্তির অবাধ এই আধুনিক দুনিয়ায় যে কেহ অনুসন্ধান করিলে জানিতে পারিবেন, উন্নত বিশ্বের দেশসমূহ তাহাদের রাজধানীকে সবচাইতে উপযুক্ত হিসাবে গড়িয়া তুলিতে কত শত মিলিয়ন ডলার খরচ করিয়া থাকে কেবল যথাযথ পরিকল্পনা প্রণয়নে। সুতরাং এই অপরিহার্য পরিকল্পনা প্রণয়ন ব্যতীত একটি রাজধানী নিকৃষ্ট না হইয়া যাইবে কোথায়? ইহার সহিত জড়িত রহিয়াছে আমাদের প্রকৃত শিক্ষা ও মানসিকতার অনুন্নয়ন। অবকাঠামোগত উন্নয়নের পাশাপাশি আমাদের শিক্ষা, দৃষ্টিভঙ্গি ও মানসিকতার যদি উন্নয়ন না ঘটে তবে ঐ যান্ত্রিক উন্নয়ন বহুলাংশে মূল্যহীন হইয়া পড়ে। এখন বলা হইতেছে, শুধু উপজেলা নহে, বরং ইউনিয়ন, ওয়ার্ড এবং গ্রাম পর্যন্ত নাগরিক সুবিধা নিশ্চিত করা হইবে। গ্রাম হইবে শহর!

বেশ, ভালো কথা। এইক্ষেত্রে একটি গল্পের অবতারণা করা যাইতে পারে। এক অশিক্ষিত ব্যক্তি নূতন একটি মোবাইল ফোন ক্রয় করিয়াছে। সংযোগ লইবার পর আহ্লাদিত হইয়া তাহার গিন্নি বলিল, ‘দাও তোমার ফোনটা মায়ের সঙ্গে একটু কথা কই।’ স্বামীর মোবাইলে ন্যূনতম টাকা না থাকিবার দরুন গিন্নি শুনিতে পাইল—‘এই কলটি করার জন্য আপনার যথেষ্ট পরিমাণ ব্যালেন্স নেই।’ মোবাইলে অন্য নারীর কণ্ঠ শুনিয়া গিন্নি কান্নাকাটি শুরু করিয়া দিল—‘তোমার ফোনে টাকা নাই, তা ঐ মহিলা জানে আর আমি তোমার বিয়া করা বউ জানি না!’ সুতরাং আমরা প্যারিস, নিউ ইয়র্কের মতো শহর চাই আর আমাদের মানসিকতা পড়িয়া থাকিবে আইয়ামে জাহেলিয়ার সময়ের মতো—তবে সেই উন্নয়নের কোনো মূল্য থাকে না। সেই কারণে ভাঙা ঘর বজায় রাখিয়া অপরিকল্পিত উন্নয়নের ক্ষেত্রে হাছন রাজার সুরেই বলিতে হয়, ‘কী ঘর বানাইমু আমি শূন্যের মাঝার’। অতএব, উন্নয়নের সুপরিকল্পনার পাশাপাশি উন্নয়ন ঘটাইতে হইবে আমাদের শিক্ষা ও মানসিকতার।