শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

বিশ্ববিদ্যালয়ে নিম্নগামী শিক্ষা ও গবেষণা

আপডেট : ১১ ডিসেম্বর ২০১৯, ২১:০৮

বিগত চার দশকে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক বিভিন্ন ক্ষেত্রে অসামান্য অগ্রগতি হইয়াছে, তাহা আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থার গবেষকদের দৃষ্টি এড়ায় নাই। কেবল সাক্ষরতা নহে, শিক্ষিতের হারও বাড়িয়াছে প্রত্যাশামতো, কিন্তু উচ্চশিক্ষার মান নিম্নগামী। দেশ জুড়িয়া প্রতিষ্ঠিত হইয়াছে অসংখ্য সরকারি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়। তাহাতে শিক্ষার্থীর কমতি নাই, কিন্তু যোগ্য শিক্ষকের অভাবনীয় অভাব। উপরন্তু অধিকাংশ সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে চলিতেছে সীমাহীন নৈরাজ্য। অনেক পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় এমন সকল অনাচারে জর্জরিত, যাহা দূর করা বর্তমান রাজনৈতিক বাস্তবতায় প্রায় অসম্ভব। বর্তমানে ১৪টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের বিরুদ্ধে তদন্ত করিতেছে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি)। অভিযুক্তদের মধ্যে একাধিক সাবেক ভিসিও রহিয়াছেন। নিয়োগ বাণিজ্য, অর্থ আত্মসাত্ ও অনিয়মের মাধ্যমে পদোন্নতি-পদায়নসহ বিভিন্ন অভিযোগ রহিয়াছে তাহাদের বিরুদ্ধে। ইউজিসির দুর্নীতি তদন্তের পাশাপাশি বেশ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসিদের অনিয়ম, দুর্নীতি ও স্বেচ্ছাচারিতার প্রতিবাদে শিক্ষার্থীরা আন্দোলনেও নামিয়াছে। এই সকল অনাচার এবং ক্যাম্পাসে শিক্ষকদের দলবাজি শিক্ষার মানকে তলানিতে নিয়া গিয়াছে। পরিণতিতে আন্তর্জাতিক র্যাংকিংয়ে ১ হাজার বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকায় বাংলাদেশের কোনো প্রতিষ্ঠানের নাম নাই। অথচ নেপাল, পাকিস্তান ও ভারতের বিশ্ববিদ্যালয়গুলির নাম ঐ তালিকায় জ্বলজ্বল করিতেছে।

প্রকৃতপক্ষে, উচ্চশিক্ষা নিয়া আমাদের অহংকার করিবার সুযোগ নাই, বরং দুশ্চিন্তার বিস্তর কারণ রহিয়াছে। বলা অত্যুক্তি হইবে না, আমাদের পাবলিক ও প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলি বৈশ্বিক জ্ঞানকাণ্ড হইতে প্রায় পুরাপুরিই বিযুক্ত। বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে গবেষণার মান ও পরিমাণ ক্রমশ হ্রাস পাইতেছে। একটি বিশ্ববিদ্যালয় জ্ঞান সৃষ্টিতে কেমন অবদান রাখিয়াছে, তাহার প্রতিফলন ঘটে সেখানে পরিচালিত গবেষণায়। গবেষণা উচ্চশিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মুখ্য উদ্দেশ্যগুলির একটি হইলেও সেইদিকে নজর কম দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলির। গবেষণার পরিবর্তে বহুতল ভবন নির্মাণেই মনোযোগ বেশি তাহাদের। ইউজিসির তথ্য বলিতেছে, ২০১৭ সালে দেশের মোট ৩৭টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সাতটিতে কোনো গবেষণা প্রকল্পই পরিচালিত হয় নাই। ইহার মধ্যে চারটি বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণা খাতে কোনো অর্থই বরাদ্দ করা হয়নি। এইদিকে চলতি ২০১৯-২০ অর্থবত্সরে দেশের ৪৫টি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য ৮ হাজার ৮৮ কোটি টাকার বার্ষিক বাজেট ঘোষণা করিয়াছে ইউজিসি। তন্মধ্যে গবেষণায় বরাদ্দ দেওয়া হইয়া মাত্র ৬৪ কোটি ৪০ লক্ষ টাকা। যদিও উন্নয়ন বাজেটে বরাদ্দ ছিল ২ হাজার ৯৯৯ কোটি টাকা। এই পরিসংখ্যানগুলিই বলিয়া দেয় কেন বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলি র্যাংকিংয়ে পিছাইয়া থাকে।

শিক্ষাক্ষেত্রে বর্তমান সরকারের ব্যাপক সাফল্যের প্রদীপ কালির পর্দায় ঢাকিয়া যায় উচ্চশিক্ষাক্ষেত্রের দিকে তাকাইলে। শিক্ষার মানের অবনতি ও শিক্ষাঙ্গনের অস্থিরতায় তাহাদের শিক্ষাজীবন অনিশ্চয়তার সুতায় দোল খাইতেছে। ইউজিসির সমীক্ষাগুলিও ইহার প্রমাণ দিতেছে। মানোন্নয়নের জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপও তাহারা সুপারিশ করিয়াছে। আমাদেরকে গবেষণার দিকে অধিক মনোযোগ দিতে হইবে। বিশ্বের প্রতিটি দেশে গবেষণার জন্য শিক্ষাবৃত্তি চালু আছে, এই দেশেও আছে। তবে তাহা প্রয়োজনের তুলনায় নগণ্য। বরাদ্দ বাড়াইয়া গবেষক ও শিক্ষার্থীর কাছে সহজতর উপায়ে বণ্টন করা অত্যন্ত জরুরি। অর্থ ছাড়া গবেষণা হয় না—ইহা যেমন সত্যি, সেই সঙ্গে ইহাও সত্যি যে, পর্যাপ্ত অর্থের সরবরাহ থাকিলেই গবেষণা হইবে—এমন নিশ্চয়তাও নাই। গভীর পড়াশোনা, অভিনিবেশ, অনুধ্যান, গবেষণা, বুদ্ধিবৃত্তিক আদান-প্রদানের যে সংস্কৃতি বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে প্রত্যাশা করা হয়, আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে তাহার বড্ড অভাব। সেই সংস্কৃতিও ফিরাইয়া আনিতে হইবে। আর তাহার জন্য দলীয় অন্ধত্বও কাটাইতে হইবে। কারণ, গুণ ও মানসম্পন্ন এবং সৃষ্টিশীল উচ্চশিক্ষাই পারে একটি জাতির ভাগ্য পরিবর্তন করিতে।