একটি দেশ মূলত সমৃদ্ধ হইয়া থাকে তাহার বিভিন্ন ধরনের সম্পদের মাধ্যমে। একটি মর্যাদাপূর্ণ রাষ্ট্র যেমন তাহার জনগণের নিরাপত্তার দায়িত্ব লইয়া থাকে, তেমনি জনগণেরও দায়িত্ব বর্তায় স্ব স্ব দেশের সম্পদের সুরক্ষায়। বিশেষ করিয়া কোনো অবস্থাতেই রাষ্ট্রীয় সম্পদের ক্ষয়ক্ষতি পৃথিবীর কোনো দেশই মানিয়া লয় না। সকল দেশই নিজস্ব বিভিন্ন আইন দ্বারা তাহার রাষ্ট্রীয় সম্পদ বিনষ্টকারীদের অপরাধী হিসাবে গণ্য করিয়া থাকে। কারণ রাষ্ট্রের সম্পদ নিরন্তর ধ্বংস সাধন করা হইলে মাত্রা অনুযায়ী তাহার মূল্য দিতে হয় সংশ্লিষ্ট দেশটির জনগণকেই। গত শতাব্দীর দুইটি ভয়ংকর বিশ্বযুদ্ধে আমরা দেখিয়াছি, প্রতিটি পক্ষই তাহার প্রতিপক্ষের সকল ধরনের সম্পদ ধ্বংস করিতে কুণ্ঠাবোধ করে নাই যুদ্ধ জয়ের নিমিত্ত। আমরা দেখিয়াছি, একাত্তরে দেশের সম্পদ কীভাবে ধ্বংস করা হইয়াছিল রাষ্ট্র হিসাবে আমাদের পিছাইয়া রাখিবার জন্য। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর জাপান-জার্মানসহ ইউরোপের অনেক দেশ তাহাদের সম্পদের ব্যাপক ধ্বংসের কারণে সকল দিক দিয়া পিছাইয়া পড়িয়াছিল কয়েক যুগ ধরিয়া। যদিও বিশ্বযুদ্ধকালীন সম্পদ ধ্বংসের সহিত কোনো কিছু তুলনা চলে না। তাহা ছাড়া এইক্ষেত্রে সম্পদ ধ্বংস হয় প্রতিপক্ষের দ্বারা; কিন্তু এই একবিংশ শতকে কোনো স্বাধীন সার্বভৌম দেশের নিজের জনগণ যদি রাষ্ট্রীয় সম্পদ ধ্বংস করে, তাহা ডালের অগ্রভাগে বসিয়া ঐ ডালটি কর্তন করিবার মতোই আত্মঘাতী বলিয়া বিবেচিত হইতে পারে।
গত এক দশকে বিশ্বব্যাপী অস্থিরতা বাড়িয়াছে। প্রথম বিশ্ব হইতে শুরু করিয়া তৃতীয় বিশ্বের কোথাও নিরবচ্ছিন্ন শান্তির শুভ্রচিত্র নাই। দেশে দেশে বিক্ষোভ, সহিংসতা, হামলার ঘটনা এখন যেন এই ধরিত্রীর সাধারণ নৈমিত্তিক ঘটনায় পরিণত হইয়াছে। ভারতীয় উপমহাদেশও ইহার বাহিরে নহে। নানান সময়ে এই অঞ্চলের বিভিন্ন প্রান্তে বিক্ষোভ, সহিংসতা দানা বাঁধিয়াছে। ভারত, পাকিস্তান, বাংলাদেশ, শ্রীলঙ্কা, মালদ্বীপ—ঘুরিয়া ফিরিয়া সর্বত্রই অস্থিরতার অসি-ছড়ি ঘুরাইয়াছে। সম্প্রতি একটি আইন প্রণয়নকে ঘিরিয়া ব্যাপক বিক্ষোভ দানা বাঁধিয়াছে ভারতে। বিক্ষোভের সহিত সেইখানে ট্রেন, স্কুলবাস, মোটরসাইকেল, গাড়ি, দোকানপাটে হামলা হইয়াছে, জ্বালাও-পোড়াও হইয়াছে। দেশটির প্রধানমন্ত্রী তাত্পর্যপূর্ণভাবে গত সপ্তাহে বলিয়াছেন, ‘যদি আপনাদের (জ্বালাও-পোড়াওকারীদের) আমাকে পছন্দ না হয়, তাহা হইলে আপনি মোদিকে গালাগালি দিন, বিরোধিতা করুন, মোদির কুশপুতুল জ্বালান; কিন্তু দেশের সম্পদ জ্বালাইবেন না। গরিবদের বাহন জ্বালাইবেন না, গরিবদের ঘরবাড়ি জ্বালাইবেন না।’ কথাটি এই কারণে তাত্পর্যপূর্ণ যে, একজন প্রধানমন্ত্রী নিজের কুশপুতুল দাহ করিবার কথা নিজেই বলিতেছেন দেশটির সম্পদ ধ্বংসের পরিবর্তে। ভারতে অবশ্য ২০১৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে দেশটির সুপ্রিম কোর্ট বলিয়াছে—বিক্ষোভের নামে রাষ্ট্রীয় সম্পদ ধ্বংস করা যাইবে না, তাহা রাজনৈতিক দল কিংবা অরাজনৈতিক যেই কারণেই হউক না কেন। টাইমস অব ইন্ডিয়ার একটি প্রতিবেদনে বলা হইয়াছে, সম্পদ ধ্বংসের চেষ্টা কঠোরভাবে দমনের পাশাপাশি এই জন্য দায়ী ব্যক্তিদের নিকট হইতে ক্ষতিপূরণ আদায় করিবার কথাও বলিয়াছে সর্বোচ্চ আদালত। তবে দেশের সম্পদের পরিবর্তে একজন সরকারপ্রধানের ‘নিজের কুশপুতুল’কে পোড়াইতে বলিবার মতো বিষয়টি যথেষ্ট অর্থবহ।