সত্যজিত্ রায় ছোট্টবেলায় মাতার সহিত রবীন্দ্রনাথের নিকট উপস্থিত হইলে তিনি তাহার খাতায় একটি ছোট্ট কবিতা লিখিয়া দিয়াছিলেন। সেই কবিতাখানি আজ শুধু জনপ্রিয় কবিতা হিসাবে নহে, আমাদের যাপিত জীবনে, রাজনৈতিক জীবনে এক চরম বাস্তবতা হইয়া রহিয়াছে। কবিতায় তিনি লিখিয়াছিলেন, ‘বহু দিন ধরে’ বহু ক্রোশ দূরে/ বহু ব্যয় করি বহু দেশ ঘুরে/ দেখিতে গিয়াছি পর্ব্বতমালা,/ দেখিতে গিয়াছি সিন্ধু।/ দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া/ ঘর হতে শুধু দুই পা ফেলিয়া/ একটি ধানের শিসের উপরে/ একটি শিশির বিন্দু।’ আমাদের জাতীয় জীবনেও বহু ব্যয় করিয়াও এই শিশির বিন্দু দেখিতে পাইতেছেন না কর্তাব্যক্তিগণ। এই ঢাকা শহর হইতে জেলা, উপজেলা ও ইউনিয়ন পর্যায়ের মানুষকে যেন মনে হয় বহু দূরের বাস্তবতায় বসবাস করিতেছে। সত্য যে, উন্নয়ন হইতেছে, যোগাযোগ ব্যবস্থায় আমূল পরিবর্তন আসিয়াছে; কিন্তু যাহারা বলিতেছেন ঢাকায় দম বন্ধ পরিবেশ, বাক্স্বাধীনতা নাই, আইনের শাসন নাই, তাহারা ঢাকার বাহিরে গিয়া নিজেদের এলাকা দেখিয়া এই ধারণা করিতেছেন বলিয়া মনে হয় না। গ্রামবাংলা যেন রাজধানী হইতে দূরে সরিয়া যাইতেছে। কেন সরিয়া যাইতেছে তাহা দেখিতেও নিজ এলাকায় যাইতে হইবে। শুধু মুখে বিবৃতি দিলেই হইবে না, দেশটাকে টানিয়া তুলিতে হইলে এই মফস্বল তথা গ্রামের মানুষকে টানিয়া তুলিতে হইবে। যতদিন পর্যন্ত তাহাদের টানিয়া তোলা যাইবে না, ততদিন পর্যন্ত দেশের সত্যিকারের উন্নয়ন দৃশ্যমান হইবে না।
মূলত এই জনগোষ্ঠীকে টানিয়া তুলিতে হইলে সুনির্দিষ্ট পথ, সুনির্দিষ্ট দিকনির্দেশনা দিতে হইবে। অথচ আমরা বৈপরীত্যে ভরপুর কর্মকাণ্ড দেখিতে পাইতেছি দেশব্যাপী। নীতিনির্ধারকদের একটি অংশ এখন রাজাকারের প্রজন্ম খুঁজিতেছেন। ভালো কথা; কিন্তু যাহাদেরকে রাজাকারের সন্তান বলিয়া গালি দিতেছেন, তাহাদেরই মুক্তিযুদ্ধের চেতনার দলে আদর করিয়া জায়গা করিয়া দিতেছেন। শুধু সমর্থক হিসাবে বা সদস্য হিসাবে নহে, রীতিমতো নেতা বানাইয়া দিতেছেন। আর তাহারা নেতা হইবার কারণেই অত্যন্ত প্রতাপের সহিত ছড়ি ঘুরাইতেছে নিজ নিজ এলাকায়। কোন প্রক্রিয়ায়, কেন এবং কী করিয়া এইসব রাজাকারের সন্তান ক্ষমতাসীন দলের নেতা বনিয়া যাইতেছেন তাহা মানুষেরও অজানা নহে। অধিকন্তু আমরা প্রায়শই দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের মুখে এমন সকল কথা, এমন সকল প্রতিশ্রুতি শুনিতে পাই, যাহা বাস্তবতার সহিত সঙ্গতিপূর্ণ নহে। প্রশ্ন হইল, যাহা নিজেও জানেন বাস্তবায়নযোগ্য নহে, তাহা বলিবেন কেন? স্বাধীনতার ৪৮ বত্সর পর যে পাত্র নিজেরাই ফুটা করিয়া ফেলিয়াছেন, সেই পাত্রে পানি ঢালিতেছেন কেন? সুতরাং রাজধানীতে বসিয়া মুক্ত বাতাস গ্রহণ করিয়া রাজধানীর বাহিরের আবদ্ধ পরিস্থিতি বোঝা যাইবে না।
আরো বিষয় রহিয়াছে। খুঁজিয়া দেখিতে হইবে, কী কারণে বিভিন্ন অঞ্চলের উন্নয়ন উদ্যোগ বাস্তবায়িত হইতেছে না। সরেজমিনে গেলেই ইহার পিছনের গাফিলতি ও অপশক্তি দেখিতে পাওয়া যাইবে। অবশ্য যদি কাহারো দেখিবার চক্ষু খোলা থাকে। তখনই কেবল বোঝা যাইবে, বহু দিন ঘুরিয়াও, বহু ব্যয় করিয়াও শিশির বিন্দু দেখা হয় নাই।