শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

সময় এখন বৈশ্বিকভাবে পরস্পরের পাশে থাকিবার

আপডেট : ০৫ এপ্রিল ২০২০, ২২:০৯

শতাধিক বত্সর পূর্বে কবি নবকৃষ্ণ ভট্টাচার্য পিপীলিকার খাদ্য সঞ্চয়ের চিত্র আঁকিয়াছেন ছড়ার ছন্দে : ‘পিপীলিকা, পিপীলিকা/ দলবল ছাড়ি একা/ কোথা যাও, যাও ভাই বলি।’ পিপীলিকা উত্তরে বলিয়াছে—‘শীতের সঞ্চয় চাই/ খাদ্য খুঁজিতেছি তাই।’ নবকৃষ্ণ-বর্ণিত পিপীলিকার দশা দেখা দিয়াছে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মধ্যে। এই ক্ষেত্রে ‘শীতের সঞ্চয়’ বিষয়টি হইয়া উঠিয়াছে ‘করোনার সঞ্চয়’। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে পিপীলিকার মতো নিজেদের খাদ্য মজুতে বিশেষ মনোযোগ দিতেছে। বহু দেশের মানুষ আতঙ্কগ্রস্ত হইয়া খাদ্যপণ্য, মুদিখানার জিনিসপত্র ক্রয় করিয়া ঘরে মজুত করিতে ব্যস্ত হইয়া পড়িয়াছে। ইহাতে প্রতিটি দেশেই ছোটো-বড়ো দোকানগুলির পণ্যমজুত দ্রুত খালি হইয়া যাইতেছে। এমনিতেই করোনা মহামারি রুখিতে বিশ্বের বহু দেশ লকডাউন ঘোষণা করিয়াছে এবং তাহার ফলে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য ও খাদ্যের জোগানও প্রায় তলানিতে গিয়া ঠেকিয়াছে।

তাত্পর্যপূর্ণ বিষয় হইল, খাদ্যশস্যের জোগান বা উত্পাদন লইয়া বিশ্বের কোথাও কিন্তু কোনো সমস্যা নাই। সমস্যা প্রধানত মানুষের মানসজগতে। ভবিষ্যত্ আতঙ্কের কারণে সকলেই ‘সেভ সাইডে’ থাকিতে চাহিতেছে। পিপীলিকার মতো শীতের তথা করোনার সঞ্চয় করিয়া রাখিতেছে। ইহার প্রভাব পড়িতেছে বিভিন্ন দেশের খাদ্যনীতির উপর। যুদ্ধের সময় লোকে যেমন খাদ্যপণ্য মজুত করা শুরু করে এই ক্ষেত্রেও তেমনটা দীর্ঘ মেয়াদের হইতে পারে বলিয়া আশঙ্কা করা হইতেছে। ফলে, পণ্যের মূল্যবৃদ্ধি এবং ঘরে খাদ্য মজুতের প্রবণতা—উভয়ই বাড়িবে। এই ব্যাপারে জাতিসংঘের ফুড অ্যান্ড অ্যাগ্রিকালচার অর্গানাইজেশনের (এফএও) জ্যেষ্ঠ অর্থনীতিবিদ ও এশিয়া অঞ্চলের চাউলের বাজারবিশ্লেষক ডেভিড ডাউই-এর সতর্কবার্তা প্রণিধানযোগ্য। তিনি বলিয়াছেন, এশিয়ার দেশগুলি খুব একটা সতর্ক না হইয়াই চাউলের রপ্তানি বন্ধের সিদ্ধান্ত লইতেছে। তাহারা কেবল নিজেদের জন্য পর্যাপ্ত সরবরাহ নিশ্চিত করিতে চাহিতেছে। অনেক দেশ আবার মনোনিবেশ করিতেছে বাড়তি আমদানির দিকে। খাদ্যপণ্য মজুতের এই ঘটনা আরো একটি প্রশ্নে অবতারণা করিতেছে—ইহা কি ‘খাদ্য জাতীয়তাবাদের’ নূতন প্রবাহ—যাহা পরবর্তীকালে গোটা বিশ্বের খাদ্য সরবরাহ প্রক্রিয়া এবং বাণিজ্যিক লেনদেন ব্যাহত করিবে?

এমনিতেই করোনা ভাইরাসের যেই বিরূপ প্রভাব অর্থনীতির উপর পড়িতে চলিতেছে তাহা ক্রমশ স্পষ্ট হইতেছে। তাহার উপর বাণিজ্যে নিয়ন্ত্রণ চালু হইলে বৈশ্বিক পরিস্থিতি যে আরো খারাপ হইবে তাহা বলিবার অপেক্ষা রাখে না। অথচ মার্কিন কৃষি বিভাগ ইউএসডির তথ্য বলিতেছে—২০১৯-২০ মৌসুমে বিশ্বব্যাপী মোট ৫০ কোটি টন চাউল উত্পাদিত হইতে যাইতেছে, যাহাতে এই মৌসুমে বৈশ্বিক মজুত বাড়িয়া দাঁড়াইবে ১৮ কোটি টনে। মনে রাখিতে হইবে—এই মজুত এযাবত্কালের মধ্যে সর্বোচ্চ; কিন্তু বৈশ্বিক বাণিজ্য-শৃঙ্খলা এলোমেলো হইবার কারণে সকল হিসাবনিকাশ উলট-পালট হইয়া যাইতেছে। অবস্থাদৃষ্টে জাতিসংঘের তিন সংস্থা বিশ্বকে সতর্ক করিয়াছে আসন্ন খাদ্যসংকটের ব্যাপারে। গোটা বিশ্বে খাদ্যপণ্য সরবরাহের জন্য প্রতিটি দেশ যদি একে অপরের সহিত সহযোগিতা না করে, তাহা হইলে পরিস্থিতি আরো জটিল হইবে। এই অসহযোগিতা এক ধরনের কৃত্রিম সংকট তৈরি করিবে। সুতরাং বিশ্বব্যাপী লকডাউন পরিস্থিতির মধ্যে বিশ্ববাণিজ্য যেন যতটা সম্ভব মুক্তভাবে চলিতে পারে। মনে রাখিতে হইবে, সময় এখন বৈশ্বিকভাবে পরস্পরের পাশে থাকিবার।