মনোবিজ্ঞান বলে, প্রকৃতিগতভাবে মানুষ অবাধ্য প্রজাতির প্রাণী। মানুষ ভিতরে ভিতরে ভীষণভাবে স্বাধীন ও মুক্ত থাকিতে চাহে, যাহা তাহাকে অবাধ্য করিয়া তোলে। তবে কিছু নিয়ম যদি সমাজের সকলের ভালোর জন্য চালু হয়, তাহা বাধ্য হইয়া মানুষকে মানিয়া চলিতে হয় বটে। করোনা তেমনি কিছু নিয়ম অবাধ্য মানবজাতির উপর চাপাইয়া দিয়াছে। এই নিয়মগুলি ‘ডু অর ডাই’-এর মতো। উভয় সংকটে পড়িয়াছে মানুষ। তাহার প্রভাব পড়িতেছে মানসিক স্বাস্থ্যে। করোনা ভাইরাসের কারণে মানবজাতি বিশেষ কিছু শৃঙ্খলে আটকাইয়া গিয়াছে। কোলাকুলি, করমর্দনের মতো কিছু অভ্যাস যেমন ত্যাগ করিতে হইতেছে, তেমনি কিছু অভ্যাস হইয়া উঠিয়াছে আবশ্যিক। মাস্ক পরা, হাত ধোয়া ছাড়াও শারীরিকভাবে দূরত্ব বজায় রাখিয়া চলাটা একরকম বাধ্যতামূলক হইয়া পড়িয়াছে। করোনাকে প্রতিহত করিতে যেইভাবে সারা বিশ্বের মানুষ দিনের পর দিন ধরিয়া গৃহে অন্তরিন থাকিতে বাধ্য হইতেছে, এমন অভিজ্ঞতা পৃথিবীতে জীবিত সকল প্রজন্মের কোনো মানুষই ইতিপূর্বে কখনো অর্জন করে নাই। এই কারণে ইহা অভাবিত।
ব্যাপক যোগাযোগের এই বিশ্বে করোনা-সৃষ্ট ‘লকডাউন’ সকল মানুষের মনেই কমবেশি অভিঘাত সৃষ্টি করিতেছে। দিন যত যাইতেছে এবং পরিস্থিতির যত অবনতি ঘটিতেছে ততই মানসিক অবসাদ জাঁকাইয়া বসিতেছে। অস্থির হইয়া উঠিতেছে মন। এই অস্থিরতার মাত্রা প্রত্যেক ব্যক্তির ক্ষেত্রে আলাদা। ইহা নির্ভর করিতেছে ব্যক্তির পারিবারিক, সামাজিক, কর্মক্ষেত্র, আর্থিক ইত্যাদি নানান অবস্থানের উপর। জাতিসংঘের একটি প্রতিবেদনে বলা হইয়াছে, করোনার কারণে শিশু ও তরুণরা বন্ধুদের হইতে বিচ্ছিন্ন, স্কুলে যাইতে পারিতেছে না। ফলে তাহাদের মনে একধরনের বিষণ্নতা সৃষ্টি হইতেছে। ইহা ছাড়া স্বাস্থ্যকর্মীদের চোখের সামনেই শত শত মানুষ আক্রান্ত অথবা মৃত্যু হইতেছে। ইহাও তাহাদের অনেকের মনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলিতেছে। সবচাইতে বড়ো সমস্যায় পড়িয়াছে নারী ও শিশুরা। তাহা স্বীকার করিতেছে, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও জাতিসংঘ। বিশেষ করিয়া শহুরে মধ্যবিত্ত পরিবারগুলির বড়ো একটি অংশ একই সমস্যায় আকীর্ণ। ফলে একাকিত্বের শিকার হইতেছে শিশুরা। শিশুদের প্রবণতা বাড়িতেছে মোবাইল বা কম্পিউটারের চোখ আটকাইয়া রাখিবার। সমীক্ষাতেও দেখা গিয়াছে ৮৮ শতাংশ বাবা-মা বলিয়াছেন, লকডাউনের সময়ে তাহাদের সন্তানদের ব্যবহারে অনেক পরিবর্তন আসিয়াছে, অসহিষ্ণু হইয়া উঠিয়াছে। ছোটো ছোটো বিষয়ে বিরক্তি প্রকাশ পূর্বের তুলনায় অনেক বাড়িয়াছে। অন্যদিকে ঘরবন্দি মেয়ে আরো বেশি করিয়া গার্হস্থ্য হিংসার শিকার হইতেছে। নিরাপত্তা, আর্থিক সুরক্ষা, মানসিক স্বাস্থ্য—সকল দিক হইতেই মেয়েদের উপরে চাপ পড়িতেছে বেশি।
প্রকৃত অর্থে, প্রতিটি ব্যক্তিই তাহার নিজস্ব মানসিকতার উপর বাঁচেন। মানুষে মানুষে প্রচুর মিল দেখিলেও প্রতিটা মানুষ তাহার নিজস্ব শারীরিক ও মানসিক গঠন লইয়া স্বয়ংসম্পূর্ণ, ইউনিক। সুতরাং করোনার এই জটিলতা সামলাইবার পাশাপাশি মনোবিদেরা মানসিক স্বাস্থ্যের সমস্যাগুলি কীভাবে সামলাইবেন—তাহা গবেষণার বিষয়।