শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

করোনা সংক্রমণে মোনালিসা!

আপডেট : ২৯ মে ২০২০, ২১:৫০

দেখা যায়, একজন হতদরিদ্র মানুষের পরিবারেও একটি স্বর্ণের আংটি, নিদেনপক্ষে একটি স্বর্ণের নাকফুল থাকে। ইহা যে কেবল অলংকার হিসাবে ব্যবহারের জন্য তাহাই নহে, ইহার একটি অর্থনৈতিক দৃষ্টিকোণ রহিয়াছে। মানুষ ভাবে বিপদের দিনে, কঠিন সময় আসিলে উহার বিক্রয়মূল্য সাময়িকভাবে হইলেও কাজে লাগিবে। আজ মানুষের সম্মুখে বুঝি সেই বিপদের সময় আসিয়া উপস্থিত হইয়াছে। ঠিক ঐ স্বর্ণের মতোই চিত্রকর্মেরও একটি বিক্রয়মূল্য থাকে। বাংলাদেশসহ বিশ্বব্যাপী দুই-এক হাজার টাকা হইতে শুরু করিয়া কয়েক বিলিয়ন ডলার মূল্যের চিত্রকর্ম রহিয়াছে। ইহা রহিয়াছে কাহারো ব্যক্তিগত সংগ্রহে অথবা রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন। শত বিপদেও এই সকল চিত্রকর্ম বিক্রয়ের কথা না ভাবিয়াছে ব্যক্তি, না ভাবিয়াছে রাষ্ট্র। যতই অর্থনৈতিক মূল্য থাকুক, এই সকল চিত্রকর্মের সহিত মূল্যবোধ, আভিজাত্য, Aesthetic Dimensions বা নান্দনিক মাত্রা যুক্ত থাকে। কিন্তু আজ এমন এক সময় উপস্থিত হইয়াছে, করোনার অর্থনৈতিক সংকট এমন গভীর স্তরে পৌঁছাইয়াছে যে, ঐ সকল চিত্রকর্ম বিক্রয়ের চিন্তা মাথায় চলিয়া আসিয়াছে। জানা গিয়াছে, শিল্পাচার্য জয়নুল অবেদিনের একটি চিত্রকর্ম নিলামে তুলিবার সিদ্ধান্ত লইয়াছে তাহার পরিবার। ঐ চিত্রকর্মের বিক্রয়লব্ধ অর্থ দেশে করোনার দুর্বিপাকে পড়া চারুশিল্পীদের জন্য ব্যবহার করা হইবে। ১৯৭০ সালে অঙ্কিত চিত্রকর্মটির ভিত্তিমূল্য নির্ধারণ করা হইয়াছে ৮ লক্ষ টাকা। ইহা শুধু বাংলাদেশেই ঘটিতেছে না। সম্প্রতি প্যারিসের প্রযুক্তিবিদ ও ডিজিটাল কনসালট্যান্ট স্টিফেন ডিসটিনগুইন ফরাসি সরকারকে পরামর্শ দিয়াছেন লিওনার্দো দা ভিঞ্চির ভুবনবিখ্যাত চিত্রকর্ম মোনালিসা কোনো এক আরব ধনকুবেরের নিকট ৫০ বিলিয়ন ইউরো মূল্যে বিক্রয় করিতে। শুধু তাহাই নহে, যুক্তরাষ্ট্রের জাদুঘরগুলির রাজস্ব নামিয়া আসিয়াছে শূন্যের কোঠায়। তাই দেশটির বাল্টিমোর মিউজিয়াম অব আর্ট, ম্যাসাচুসেটসের বের্কশায়ার মিউজিয়ামসহ বেশ কয়েকটি মিউজিয়াম তাহাদের সংগ্রহে থাকা কিছু কিছু শিল্পকর্ম বিক্রয় করিয়া দেওয়ার সিদ্ধান্ত লইয়াছে। যুক্তরাষ্ট্রের সোথবি অকশন হাউজের ভাইস চেয়ারপারসন নিনা ডেল রিও যথার্থই বলিয়াছেন, ‘হে ঈশ্বর, তুমি জানো, আমাদের সকল কিছু বিক্রয় করিতে হইতেছে। তাহা না হইলে আমাদের অস্তিত্বই হুমকির মুখে পড়িবে।’

ইহা হইতে বুঝা যায়, শুধু মানুষের জীবন এবং সেই সূত্রে শিল্পকারখানা, কৃষি অর্থনীতি বা পরিবহন খাতই আক্রান্ত নহে; করোনা ভাইরাসের এই মহামারি প্রকারান্তরে সংক্রমিত করিতেছে মোনালিসা, জয়নুল আবেদিনের শিল্পকর্ম অথবা বিভিন্ন দেশের মিউজিয়ামগুলিতে থাকা মূল্যবান সংগ্রহকে। পৃথিবীতে একটি দেশ দুর্ভিক্ষপীড়িত হইলে অন্য দেশ হইতে খাদ্য বোঝাই এয়ার ক্যারিয়ার অথবা জাহাজ আসিয়া ভিড়িত। কিন্তু এখন এমন এক বাস্তবতা উপস্থিত হইয়াছে যে কে কাহাকে দেখিবে, সকলেরই চক্ষু অশ্রুসিক্ত। তাই এই মহামারিতে টিকিয়া থাকিতে হইলে নিজের পায়ের উপর ভরসা রাখিতে হইবে সর্বাগ্রে। সকল দেশকেই ভাবিতে হইবে, ‘আংটিখানা বিক্রয় করিবার পর’ কিছুকাল চলিবে, কিন্তু তাহারও তো পর আছে!