ফিলিপাইনে একটি মৃত তিমির পেট হইতে বাহির হইয়াছে ৪০ কেজি প্লাস্টিক বর্জ্য। ক্ষুধার্ত অথচ পেটভর্তি প্লাস্টিকে। সেই প্লাস্টিকের বর্জ্যই কাড়িয়া লইয়াছে তিমিটির প্রাণ। গত বত্সর থাইল্যান্ডে একটি তিমির মৃতদেহ পাওয়া গিয়াছিল, যাহার পেটে ছিল ৮০টি প্লাস্টিক ব্যাগ। শুধু প্লাস্টিক বর্জ্যের কারণে প্রতি বত্সর প্রায় ১০০ মিলিয়ন সামুদ্রিক প্রাণী মারা যাইতেছে। প্লাস্টিক দূষণের প্রভাব শুধু জলজ প্রাণীর উপরই নহে, সামুদ্রিক পাখির উপরও রহিয়াছে। অস্ট্রেলিয়ার বিজ্ঞানীদের গবেষণাপত্র হইতে জানা যায়, শঙ্খচিলসহ সামুদ্রিক পাখির ৯০ শতাংশের পাকস্থলী এখন প্লাস্টিক দূষণে আক্রান্ত। প্লাস্টিকের বিষে অকালে মারা যাইতেছে সামুদ্রিক পাখি, স্তন্যপায়ী প্রাণী, কাছিম ও মাছসহ নানা ধরনের সামুদ্রিক জীব। নষ্ট হইতেছে জলজ লতা-গুল্ম ও উদ্ভিদ-প্রবাল।
পৃথিবীর অস্তিত্ব টিকিয়া আছে সামুদ্রিক সিস্টেমের কারণে। খাদ্য ও অক্সিজেন সরবরাহের মাধ্যমে সমুদ্রগুলি পৃথিবীর প্রাণীকুলের অস্তিত্ব রক্ষা করে। বিশ্ব অর্থনীতির সঙ্গেও সাগরের সম্পর্ক অনাদিকাল হইতে। কিন্তু মানুষের ফেলা সিগারেটের ফিল্টার হইতে শুরু করিয়া প্লাস্টিকের ব্যাগ, নানা ধরনের মোড়ক, বোতল ও ক্যানে দূষিত হইতেছে সাগর-মহাসাগর। সিএনএন জানাইতেছে, বিশ্বে প্রতি বত্সর ৩৩০ মিলিয়ন টনের বেশি প্লাস্টিক উত্পাদিত হয়। ইউএন এনভায়রনমেন্টের তথ্যানুযায়ী, বত্সরে ৮ মিলিয়ন টনের বেশি প্লাস্টিক সমুদ্রে নিক্ষিপ্ত হইতেছে। এই ধারা অব্যাহত থাকিলে ২০৫০ সাল নাগাদ সমুদ্রে মাছের চাইতে প্লাস্টিকের পরিমাণ বেশি হইবে। নূতন গবেষণায় দেখা যাইতেছে, সমুদ্রগুলিতে সম্মিলিতভাবে প্রায় ২ লক্ষ ৬৯ হাজার টন ওজনের পাঁচ ট্রিলিয়নের অধিক প্লাস্টিকের টুকরা ভাসিতেছে, যাহা খাদ্যশৃঙ্খলের ক্ষতি করিতেছে। এইসকল তথ্য বলিয়া দেয়, আমরা সত্যিই এক প্লাস্টিকের গ্রহ হইতে যাইতেছি। কেননা, বর্তমানে বিশ্বের মোট প্লাস্টিকের মাত্র ৫ শতাংশ পুনর্ব্যবহূত হইতেছে, বাদবাকি বর্জ্য হিসেবে জমা হইতেছে সমুদ্রে ও স্থলভূমিতে ।
প্লাস্টিক আমাদের জীবন সহজ করিয়া দিয়াছে ঠিকই, কিন্তু এই প্লাস্টিকই আমাদের গিলিয়া খাইতেছে। প্লাস্টিক অপচনশীল। ইহার আয়ুষ্কাল কমপক্ষে ৫০০ বত্সর। একপর্যায়ে প্লাস্টিক ভাঙিয়া ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কণায় পরিণত হয়। এই ক্ষুদ্র কণা মাইক্রোপ্লাস্টিক নামে পরিচিত। মাইক্রোপ্লাস্টিক খাদ্যচক্রে প্রবেশ করিয়া শেষ গন্তব্য হিসেবে মানুষের শরীরে ঢুকিতেছে। ওশ্যান কনসার্ভেন্সি ও ম্যাককিনসে সেন্টার ফর বিজনেস অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টের ২০১৫ সালের প্রতিবেদন অনুযায়ী, প্রতিবত্সর সমুদ্রে যে পরিমাণ প্লাস্টিক বর্জ্য ফেলা হয় এশিয়ার পাঁচটি দেশ তাহার ৬০ শতাংশের জন্য দায়ী। দেশগুলি হইল— চীন, ইন্দোনেশিয়া, ফিলিপাইন, ভিয়েতনাম ও থাইল্যান্ড। সমুদ্র দূষণে তাহাদের দায় অনেক। ‘সায়েন্স’ পত্রিকায় প্রকাশিত এক তথ্য হইতে জানা যায়, প্রতিবত্সর যে পরিমাণ প্লাস্টিক ভূমি হইতে সাগরে প্রবেশ করে, তাহাতে বাংলাদেশ দশম স্থানে আছে। এই বর্জ্যের উত্স গঙ্গা, যমুনা ও ব্রহ্মপুত্র অববাহিকার দেশ চীন, ভারত, নেপাল ও বাংলাদেশ। আমাদের পদ্মা, মেঘনা, যমুনা হইয়া এইগুলি সাগরে যাইতেছে। তবে প্লাস্টিক দূষণে যতটুকু দায় আমাদের, তাহার তুলনায় শতগুণ দায় উন্নত দেশগুলির। দায় যাহারই থাকুক, প্লাস্টিক ও অন্যান্য দূষণে পৃথিবীর জলভাগ ও স্থলভাগ উভয়ই ভয়াবহভাবে বসবাসের অনুপযোগী হইয়া উঠিয়াছে। পৃথিবীকে মহাবিপর্যয় হইতে রক্ষা করিতে সর্বসম্মিলিতভাবে উদ্যোগ গ্রহণের সময় আসিয়াছে।