শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

শিক্ষক কনভেনশনে বিশ্ববিদ্যালয় পরিস্থিতির মূল্যায়ন

আপডেট : ১৬ এপ্রিল ২০১৯, ২১:৩৭

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে গত বৃহস্পতি ও শুক্রবারে অনুষ্ঠিত হইয়া গেল দুইদিনের এক শিক্ষক কনভেনশন। শিক্ষকদের সংগঠন ‘বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নেটওয়ার্ক’-এর উদ্যোগে আয়োজিত এই কনভেনশনে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা নানান অধিবেশন ও কর্মশালায় অংশগ্রহণ করেন। বিভিন্ন অধিবেশন ও কর্মশালায় উচ্চশিক্ষার নানান সংকট লইয়া আলোচনা হয়, মিথস্ক্রিয়ানির্ভর তর্ক-বিতর্কের ভিতর দিয়া সংকটগুলির সমাধানও অনুসন্ধান করা হয়। বাংলাদেশে একসময় বিশ্ববিদ্যালয় বলিতেই ১৯৭৩ সালের অধ্যাদেশনির্ভর স্বায়ত্তশাসিত চারটি ও প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের কথা ভাবা হইত। কিন্তু এখন বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা যেমন বৃদ্ধি পাইয়াছে, তেমনই ইহার প্রকৃতিও বিচিত্র হইয়াছে। প্রায় ৪০টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের বাহিরে রহিয়াছে প্রায় ১০০টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়। পাবলিক ও প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের যেমন প্রকৃতিগত পার্থক্য রহিয়াছে, তেমনই পুরাতন স্বায়ত্তশাসিত বিশ্ববিদ্যালয়গুলির সহিত ১৯৭৩ অধ্যাদেশের বাহিরের সাধারণ এবং বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়গুলির মধ্যেও রহিয়াছে প্রকৃতিগত পার্থক্য। এইদিকে বিশ্ববিদ্যালয়গুলির সার্বিক মানের অবনমন হইয়াছে বলিয়া একটি ধারণা ধীরে ধীরে সমাজে প্রতিষ্ঠিত হইয়াছে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে দলীয় রাজনীতি শিক্ষাগত মানের উপরে প্রভুত্ব করিতেছে। অল্প কয়েকটি বাদ দিয়া বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলি কেবল সনদ বিক্রির ভবনে পরিণত হইয়াছে।

এই পরিপ্রেক্ষিতে বিশ্ববিদ্যালয়গুলির সার্বিক পরিস্থিতি লইয়া আয়োজিত কনভেনশন গুরুত্ববহ ঘটনা হিসাবে প্রতীয়মান হইয়াছে। কনভেনশনের ‘বিশ্ববিদ্যালয়, সমাজ ও রাষ্ট্র’ শীর্ষক উদ্বোধনী অধিবেশনে বিশিষ্ট চিন্তক ও শিক্ষাবিদগণ বাংলাদেশের সমাজ ও রাষ্ট্রের সহিত বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্পর্কের পর্যালোচনা করেন, ঐতিহাসিক ও বর্তমান প্রেক্ষাপটে। তাহারা বলেন, সরকারি কর্তৃত্ব দলীয় রাজনীতিবাহিত হইয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বায়ত্তশাসন হরণ করিতেছে এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার উপর রাজনীতির চর্চা প্রভুত্ব করিতেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরে পদ-সম্পদের বাঁটোয়ারা দলীয় ভিত্তিতেই হইয়া থাকে। অন্যদিকে বিশ্বব্যাংকের ন্যায় বৈশ্বিক প্রতিষ্ঠান নয়া উদারবাদের নীতি অবলম্বনে বিশ্ববিদ্যালয়ের মঞ্জুরী কমিশনের মাধ্যমে, মানোন্নয়নের নাম দিয়া সর্বজনের বিশ্ববিদ্যালয়গুলির মধ্যে বেসরকারিকরণের উপাদান প্রবিষ্ট করিতেছে। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনের ২০ বত্সর মেয়াদি (২০০৬-২০২৬) কৌশলপত্র বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরীণ আয় বৃদ্ধি করিতে ও সরকারি বরাদ্দ কমাইতে নীতিগত চাপ প্রয়োগ করিতেছে। এই দুই অভিঘাতে বিশ্ববিদ্যালয়গুলি নাকাল হইতেছে এবং সমাজে তাহার গুরুত্ব হারাইয়া ফেলিতেছে। কনভেনশনে স্বাভাবিক ও দৈনন্দিন পাঠদানে শিক্ষকদের অবহেলা এবং গবেষণা-তহবিলের অপ্রতুলতা লইয়া বিশদ আলোচনা হয়। বস্তুত বাংলাদেশের গবেষকরা উচ্চশিক্ষার জন্য বিদেশেই যাইয়া থাকেন, দেশের পিএইচডির মানও নাই, মূল্যও নাই।

কনভেনশনে তিয়াত্তরের অধ্যাদেশের ব্যবহার-অপব্যবহার নিয়াও বিস্তর আলাপ হয়। পাকিস্তানি সামরিক শাসকগণ পাকিস্তান আমলে বিশ্ববিদ্যালয়কে নিয়ন্ত্রণে আনিতে নানান উদ্যোগ লইয়াছিল। তাহার বিপরীতে তিয়াত্তরের অধ্যাদেশ একটি অর্জন হিসাবে ধরা হয়। কিন্তু অধ্যাদেশটি শতবর্ষের পর বিশ্ববিদ্যালয় কোন স্থানে পৌঁছাইবে তাহার দিকনির্দেশনা দেয় নাই, কেবল শিক্ষকদের রাজনীতি করিবার স্বাধীনতা দিয়াছে। অন্যদিকে যেইসকল বিশ্ববিদ্যালয়ে ওই অধ্যাদেশ দ্বারা পরিচালিত নহে, সেইখানে পরিস্থিতি আরো শোচনীয়। সকল ক্ষমতা উপাচার্যের নিকট কেন্দ্রীভূত, এবং সেই উপাচার্য যেহেতু দলীয় আনুগত্যে মনোনীত হন, তাই শিক্ষকদের স্বাভাবিক মতপ্রকাশেরও স্বাধীনতা নাই। পরামর্শ আসিয়াছে, তিয়াত্তরের অধ্যাদেশের আলোকে, উহার সীমাবদ্ধতাগুলি বাদ দিয়া সকল বিশ্ববিদ্যালয়কে যুগোপযোগী বিধির আওতায় আনিতে হইবে।