লেবুর উপকারিতার কথা কে না জানেন। কিন্তু লেবু বেশি চটকাইলে এমনই তেতো হইয়া যায় যে, তাহা আর খাওয়ারই উপযোগী থাকে না। অনেক মহৌষধ আছে যাহা জীবনদায়ী, কিন্তু তাহাতে কোনো ধরনের ভেজাল ঢুকিলে সেই মহৌষধই হইয়া পড়ে জীবনের জন্য হুমকিস্বরূপ। আমাদের এই সবুজ ধরিত্রীর শক্তির মূলে রহিয়াছে সূর্যের পরিমেয় আলো। কিন্তু সূর্যের শক্তিতে কতিপয় বালুকণা যদি শক্তি অর্জন করিয়া সূর্যের চাইতেও অধিক তেজ দেখায়, তবে তাহা সবিশেষ দুঃখের।
আমাদের প্রাত্যহিক-সামাজিক কিংবা রাষ্ট্রীয় জীবনেও আমরা এইসকল বিষয়ের সহিত কিছু সাদৃশ্য খুঁজিয়া পাই বটে। ইহাকে অতি সরল কয়েকটি শব্দে অনুধাবন করা যায়। তাহা হইল—নিজ নিজ বলয়ে থাকিয়া ‘সীমা লঙ্ঘন না করা’। স্বয়ং সৃষ্টিকর্তা এই ‘সীমা লঙ্ঘনের’ ব্যাপারে বারংবার সতর্কতা উচ্চারণ করিয়াছেন। সীমা লঙ্ঘনের মাধ্যমে অশান্তি, বিশৃঙ্খলার পরিণাম কখনই ভালো হয় না। ইহার অসংখ্য উদাহরণ ইতিহাসের পাতায় ছত্রে ছত্রে ছড়াইয়া আছে। পেরুতে দুই মেয়াদে দশ বত্সর ধরিয়া ক্ষমতায় থাকা সাবেক প্রেসিডেন্ট অ্যালান গার্সিয়া গত বুধবার আত্মহত্যা করিয়াছেন তাহার বিরুদ্ধে আনীত একটি ঘুষের মামলার গ্রেফতার এড়াইতে। গত দুই সপ্তাহে আলজেরিয়া ও সুদানের প্রবল প্রতাপশালী দুই প্রেসিডেন্টের পতন দেখাইয়া দেয় যে, মধ্যাহ্নের আগুনঝরানো সূর্যকেও একটি সময়ে অস্তাচলে ডুবিতেই হয়।
ইহা স্বতঃসিদ্ধ যে, মধ্যাহ্নের দুর্দান্ত-প্রতাপশীল সূর্যকেও একটি সময় অস্তাচলে যাইতে হইবে। কিন্তু সেই অস্তাচলের ঘটনাটি যেন মেঘাচ্ছন্ন ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ উত্তাল পরিবেশের ভিতর দিয়া না ঘটে। বিদায়ের সেই ক্ষণটিতে যেন আকাশ নানান রঙে রঞ্জিত থাকে, তাহা সূর্যের জন্য যেন সম্মানের হয়। ইহার জন্য সূর্যের ন্যায় নেতাদের সতর্ক থাকিতে হইবে তপ্ত বালুকণাদের ব্যাপারে। সেইসকল বালুকণা যেন সীমা লঙ্ঘন না করে। করিলে তাহার দায় কিন্তু সূর্যের ঘাড়েই বর্তায়। মনে রাখিতে হইবে—একজন প্রকৃত নেতা তাহার জনগণ ও কর্মীদের নেতৃত্ব দিবেন, কিন্তু কখনই নিজে অন্যদের দ্বারা পরিচালিত হইবেন না। যদি পরিচালিত হন, তবে তাহার নেতৃত্বের ক্যারিশমায় কালিমা লাগিতে বাধ্য। অনেক ক্ষেত্রে মনে করা হইতে পারে যে, বালুকণাদের সীমা লঙ্ঘনের সুযোগ না দিলে তাহারা সূর্যের তাপ ধরিয়া রাখিবে না। কিন্তু প্রকৃত নেতৃত্বের ক্ষেত্রে ইহা সত্য নহে। সূর্য আপন শক্তিতেই দেদীপ্যমান। সুতরাং জনগণ যদি সূর্যশক্তিমান নেতার নেতৃত্বে ভীষণভাবে উচ্ছ্বসিত থাকে, তাহার শক্তিতে উদ্দীপ্ত বালুকণাদের ঝড়ে দিশেহারা হইতে দেওয়াটা ভালো কথা নহে। ইহা যেন কোটি কোটি একর উর্বর জমির মধ্যে মাত্র লক্ষ একর বালুকণাদের তপ্ত বালুঝড়ের মতো। যাহারা ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে থাকেন, তাহারাও ত্যক্তবিরক্ত হইতে পারেন বালুকণাদের নিরন্তর ঝাপটায়। সকলেরই তো সহ্যের একটি সীমা রহিয়াছে। সকলেই চাহেন সম্মানের সহিত বাঁচিতে।
সুতরাং সহ্যের ইলাস্টিক ছিঁড়িয়া না যাওয়া অবধি তাহা টানিয়া যাওয়াটা বুদ্ধিমানের কাজ নহে। ইহাতে শেষাবধি উন্নয়নের রঙিন চাদর আসন পাতিবে বটে, কিন্তু স্বস্তি পাইবে না কেহ। এইভাবে চলিতে পারে না। চলা উচিতও নহে।