নবাগত প্রাণকে ভালোবাসে না, আদর করে না—এমন প্রাণী পৃথিবীতে বিরল। শিশুর প্রতি ভালোবাসা সহজাত। তাহার পরও মানব শিশু যুগ যুগ ধরিয়া অধিকার বঞ্চিত হইয়া আসিতেছে। আমরা প্রতি বত্সর ১৭ মার্চ জাতীয় শিশু, ২৯ সেপ্টেম্বর জাতীয় শিশু অধিকার এবং ৩ অক্টোবর বিশ্ব শিশু দিবস পালন করি মহাআড়ম্বরে। শিশুর অধিকার নিশ্চিত করিতে জাতিসংঘ শিশু অধিকার সনদে বাংলাদেশ স্বাক্ষর করিয়াছে ১৯৯০ সালে। কিন্তু এতদিন পরও নিশ্চিত হইতেছে না শিশুর অধিকার। আমাদের দেশে শিশুনীতি, শিশু আইন, শিশুশ্রম নিরসন নীতি, গৃহকর্মী সুরক্ষা ও কল্যাণ নীতি, নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন, পাচার প্রতিরোধসহ নানা বিষয়ে শিশুদের সুরক্ষামূলক আইন রহিয়াছে বটে, কিন্তু প্রয়োগের অভাবে আমাদের শিশুদের সুরক্ষা নিশ্চিত করা সম্ভব হইতেছে না। গলদটা কোথায়? অনেকে এই জন্য আমাদের প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতা ও সমন্বয়হীনতাকে দায়ী করিয়া থাকেন।
আশার কথা হইল, সেই দুর্বলতা ও সমন্বয়হীনতা দূর করিতে যে সমন্বিত প্রয়াস দরকার, তাহার গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসাবে সম্প্রতি শিশু অধিকার রক্ষায় গঠিত হইয়াছে পার্লামেন্টারি ককাস। গত বুধবার জাতীয় সংসদের আইপিডি মিলনায়তনে আগামী পাঁচ বত্সরের জন্য শিশুর অধিকার রক্ষা বিষয়ক এই পার্লামেন্টারি ককাসটি গঠিত হইয়াছে যাহার সদস্য সংখ্যা ২৫। তাঁহারা শিশু অধিকার রক্ষা ও সচেতনতায় সংসদ ও সংসদের বাহিরে সোচ্চার ও সক্রিয় ভূমিকা পালন করিবেন বলিয়া আমরা আশা রাখি। জাতিসংঘের শিশু অধিকার সনদের চারটি মূলনীতি হইল—বৈষম্যহীনতা, সর্বোত্তম স্বার্থ, বাঁচিয়া থাকা ও বিকাশ এবং শিশুদের অংশগ্রহণ। এই চারটি ক্ষেত্রেই শিশুদের অধিকার রক্ষায় আমরা পিছাইয়া রহিয়াছি। একজন শিশুর খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, স্বাস্থ্য ইত্যাদি নিশ্চিত করিবার দায়িত্বে নিয়োজিত অভিভাবকরা অনেক ক্ষেত্রে তাহার পরিপূর্ণ অধিকার বাস্তবায়ন করিতে পারিতেছে না। কেননা সমাজ ও রাষ্ট্র যতদিন না শিশুর অভিভাবকের অধিকার আগে নিশ্চিত না করিতে পারিবে, ততদিন শিশুর অধিকার পরিপূর্ণভাবে বাস্তবায়ন করা সম্ভব হইবে না।
কয়েকদিন আগে চাকরিচ্যুত এক ভদ্রলোক তাহার ক্ষুধার্ত শিশুটির জন্য দুধের প্যাকেট চুরি করিতে গিয়া ধরা পড়েন। সংবাদপত্রে প্রকাশিত খবর অনুযায়ী পুলিশ ও দোকানের মালিক তাহার করুণ কাহিনি শুনিয়া সদয় হন। পুলিশ অফিসার নিজের টাকা দিয়া দুধের মূল্য পরিশোধ করিয়া দেন এবং দোকানের মালিক ঐ লোকটিকে তাহার দোকানে একটি চাকরি দেন। অর্থাত্ শিশুর অভিভাবকের অভাব বা কর্মসংস্থানের সংকট না কাটিলে শিশুর পুষ্টি সমস্যা দূর হইবে না। দূর হইবে না বহুল আলোচিত শিশুশ্রমের বিষয়টিও। আমাদের মোট জনসংখ্যার ৪০ শতাংশের বেশি শিশু; যাহার মধ্যে ১৫ শতাংশের অধিক শিশু দরিদ্র। এই দরিদ্র শিশুদের মধ্যে রহিয়াছে শ্রমজীবী, গৃহকর্ম ও ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিয়োজিতরা। রহিয়াছে প্রতিবন্ধী শিশু, পথশিশু, বাল্যবিবাহের শিকার শিশু এবং চর, পাহাড় আর দুর্গম এলাকার অধিকার বঞ্চিত শিশু। ২০৩০ সালের মধ্যে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করিতে হইলে এইসব অধিকারহারা ও সুবিধাবঞ্চিত শিশুর কথা ভাবিতে হইবে। তাহাদের পিতা-মাতার আয়-উপার্জনের ব্যবস্থা করিতে হইবে। বন্ধ করিতে হইবে শিশুর উপর শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন। ইহাছাড়া শিশুর অধিকার সমন্বিতভাবে রক্ষার জন্য যে আলাদা অধিদফতর বা শিশু অধিকার কমিশন গঠনের কথা বলা হইতেছে তাহাও গুরুত্বের সহিত বিবেচনা করিতে হইবে।